ইউরোপ জুড়ে তখন সোভিয়েত আগ্রাসন চরম আকার ধারণ করেছিল। ফলে তাদের আঞ্চলিক শক্তি খর্ব করার জন্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে একত্রিত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। যার ভিত্তিতে ১৯৪৯ সালে বেশ কয়েকটি ইউরোপিয়ান দেশ মিলে একটি সামরিক জোট গড়ে তোলে। যার নাম দেওয়া হয় ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা ন্যাটো (NATO)। প্রতিষ্ঠার সময় এই সংস্থায় ১২টি দেশ যোগ দেয়। ইউরোপের বাহিরে আমেরিকা এবং কানাডা ন্যাটো’র সদস্যপদ লাভ করে তখন। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি দেশ এই সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়।
বর্তমানে এই জোটে ২৯ টি দেশ চুক্তিবদ্ধ। প্রতিষ্ঠাকালীন দেশগুলো হলো- বেলজিয়াম, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পর্তুগাল, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। অন্যান্য দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে সদস্যপদ লাভ করে। জার্মানিকে প্রথমদিকে দূরে রাখলেও পরে সদস্য হিসেবে নেওয়া হয়। সামরিক জোটটির মূল উদ্দেশ্য হলো, জোটভুক্ত যেকোনো দেশ আক্রমণের শিকার হলে, বাকি দেশগুলো প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংস্থাটি বিভিন্ন মিশন পরিচালনা করে আসছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেও নানা সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উঠা-নামা করেছে। ফলে ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে সেটা নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়না।
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর, আটলান্টিকের ওপার থেকে আমেরিকানরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। জোটের ভেতর-বাইরে সবখানে আলোচনার ঝড় ওঠে। খোদ আমেরিকান প্রশাসন দুইভাগে বিভক্ত হয়। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনসহ প্রশাসনের একপক্ষের মতে, পূর্বদিকে জোটের নিরাপত্তা বলয় বাড়ানোর এটাই সুযোগ। এই পক্ষটি ভেঙ্গে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোতে গণতন্ত্র কায়েমের জন্য জোর দাবি জানাতে থাকে। অপর আরেক পক্ষ মনে করে, পেন্টাগনের উচিৎ নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া। কারণ, ইতোমধ্যে তাদের সোভিয়েতকে ভাঙার উদ্দেশ্য সফল হয়ে গিয়েছিল।
আমেরিকানদের এমন দ্বিধাবিভক্ত আচরণের কারণে ইউরোপিয়ান দেশগুলোও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে শুরু করে। যুক্তরাজ্য মনে করেছিল, জোটকে সম্প্রসারণ করলে জোটের ভেতর ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হবে। অন্যদিকে ফ্রান্সের নেতাদের মুখে ভিন্ন সুর। ফ্রান্স ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে আরও সুসংহত দেখতে সচেষ্ট ছিল। তাছাড়া তরুণ রাষ্ট্র রাশিয়ার ব্যাপারেও তাদের ভাবনা ছিল বিদ্বেষভাবাপন্ন।
ন্যাটো সম্প্রসারণের ব্যাপারে রোনাল্ড ডি আসমত লিখেছিলেন,
“আমেরিকার কাছে ন্যাটোর ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এটা তাদের কাছে এক লিট্মাস পরীক্ষার মতো। এখানে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকার নাক গলানোর ভাগ্য নির্ধারিত করে দেবে। বিশেষ করে, একনায়কতন্ত্রের দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাদের নীতির ওপর প্রভাব ফেলবে এই সিদ্ধান্ত”।
১৯৯৪ সালে ক্লিনটন প্রথম ইউরোপ সফরের প্রাক্কালে একটি নতুন ঘোষণা দেন। তার মতে, ন্যাটোর বিস্তৃতি ঘটবে কিনা-এই ব্যাপারটা এখন মূল্যহীন। তারচেয়ে এই বিস্তৃতি কখন ঘটবে, এটা একটা দারুণ প্রশ্ন হতে পারে! ক্লিনটনের এমন ঘোষণার কিছুদিন আগেই জোটের নেতারা একটি শান্তি চুক্তিতে সই করেন। এই চুক্তিতে ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো সহ, পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের মধ্যকার সম্পর্ক বাড়ানোর প্রতি জোর দেওয়া হয়।
ন্যাটোর কর্মকাণ্ড
ন্যাটোর সদর দপ্তর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিত। যেকোনো নতুন সিদ্ধান্ত জোটের সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত হয়ে থাকে। তবে জোটের স্বতন্ত্র দেশগুলো ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ২০১১ সালে আমেরিকা, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন মিলে জাতিসংঘ স্বীকৃত নো ফ্লাই জোনে নজরদারি শুরু করে। পরবর্তীতে অবশ্য নজরদারির দায়িত্ব ন্যাটোর ওপর ন্যস্ত করা হয়। তাছাড়া জোটের কেউ চাইলে ন্যাটোর অপারেশন থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে। লিবিয়ায় সেনা অভিযানের সময় জার্মানি এবং পোল্যান্ড নিজেদের বিরত রেখেছিল।
কৌশলগত সামরিক অভিযানে ন্যাটোর দুইটি ভাগ রয়েছে। একটি অংশ বেলজিয়ামে অবস্থিত ন্যাটোর সদর দপ্তর থেকে পরিচালিত হয়। মিত্র দেশগুলোর জন্য ভার্জিনিয়ার নরফোকে আলাদা একটি কমান্ড সেন্টার রয়েছে। কমান্ডারদের প্রধান হিসেবে একজন আমেরিকান জেনারেলকেই নিয়োগ দেওয়ার অলিখিত রীতি রয়েছে ন্যাটোতে। সাধারণত জোটভুক্ত দেশগুলোর সেনাবাহিনী নিজ দেশের হয়ে কাজ করে। কেবল ন্যাটো কোনো সামরিক অভিযান চালালে, দেশগুলো প্রয়োজন অনুসারে সৈন্য সহায়তা দিয়ে থাকে। তাছাড়া নিজের সবচেয়ে সেরা কূটনীতিকদের সদস্য দেশগুলোতে নিয়োগ দেয় সবাই। এভাবে তাদের কার্যক্রমকে সমন্বয়ের মাধ্যমে জটিল থেকে শৃঙ্খলার আওতায় নিয়ে এসেছে ন্যাটো।
সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে ন্যাটো জোটের দেশগুলো বেশ উদার! ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, জোটভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত সামরিক ব্যয় প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার! যেখানে যুক্তরাষ্ট্রেরই এককভাবে ৭০ শতাংশ ব্যয় রয়েছে। যা স্নায়ু যুদ্ধের সময়কালের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। অবশ্য এই ব্যয়ের সঙ্গে ন্যাটোর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ এই ব্যয় দেশগুলোর নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য করা হয়। একটি চুক্তি অনুসারে, ন্যাটো জোটের দেশগুলো নিজেদের জিডিপি’র ২ শতাংশ সামরিক কাজে ব্যয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। যদিও ২০১৯ সালে এসে দেখা যায়, মাত্র ৮ টি সদস্য রাষ্ট্র এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটাতে পেরেছে। যাদের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম।
বাজেট বাস্তবায়নের প্রতি ইউরোপীয়দের এমন আলসেমি, ট্রাম্প প্রশাসনের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তারা চাইছেন, ইউরোপের দেশগুলো যেন চুক্তির শর্ত পূরণ করে। নয়তো আমেরিকানদের প্রতিরক্ষা কার্যক্রমকে সমর্থন জানাতে হবে সবাই। যা কোনো পক্ষের জন্যই সুখকর নয়।
বর্তমানে ন্যাটো এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে বেশ কিছু মিশন পরিচালনা করছে। আফগানিস্তানে সুরক্ষা সহায়তা, কসোভোতে শান্তিরক্ষা মিশন, ভূমধ্যসাগরে সামুদ্রিক নিরাপত্তা টহল, সোমালিয়ায় আফ্রিকান ইউনিয়ন বাহিনীকে সমর্থন প্রদান, পূর্ব ইউরোপের আকাশে নজরদারি এবং ইরাকে নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া-ইত্যাদি।
রাশিয়া-ন্যাটো দ্বন্দ্ব
রাশিয়া স্নায়ু যুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকে ন্যাটোর কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছে। তাদের মতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে নাক গলিয়ে আমেরিকা মূলত বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় দিয়েছে। কারণ ১৯৯০ সালে দুই জার্মানির পুনর্মিলনের পর, আমেরিকা পূর্বদিকে অগ্রসর না হওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিল। যদিও হোয়াইট হাউজ এমন প্রতিশ্রুতির কথা অস্বীকার করে সবসময়।
বেশিরভাগ পশ্চিমা নেতারা ন্যাটোর বিস্তৃতির ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। তারপরও রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সম্পর্কের শীতলতা কাটাতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে উভয় পক্ষের মাঝে একটি আলোচনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বারবার আলোচনার পরও, কেবল পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবে সম্পর্ক এগিয়ে যায়নি।
২০০৮ সালের বসন্তে ন্যাটোর বুখারেস্ট সম্মেলনের পর, দুই পক্ষের দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। জর্জিয়া এবং ইউক্রেনকে জোটের অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে এই বিপত্তি বাধে। রাশিয়া এই ব্যাপারটি নিয়ে অনেক আগে থেকেই জোটকে সতর্ক করে আসছিল। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ক্রিমিয়া অধিবেশন এবং পূর্ব ইউক্রেনে চলমান অস্থিতিশীলতা নিয়ে, জোটের সঙ্গে আরেক দফা দূরত্ব তৈরি হয় রাশিয়ার। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর ন্যাটো সেক্রেটারি-জেনারেল অ্যান্ডারস ফোগ রাসমুসেন বলেছিলেন, “আমরা স্নায়ু যুদ্ধের পর থেকে ইউরোপে রাশিয়ার দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়ে আসছি।“
এই বক্তব্যের সপ্তাহ খানেক পরেই ন্যাটো মস্কোর সঙ্গে সকল সামরিক ও বেসামরিক সহযোগিতা কার্যক্রম প্রত্যাহার করে নেয়।
ক্রিমিয়া অধিবেশনের পর প্রেসিডেন্ট পুতিন একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। যেখানে তিনি ন্যাটোর সঙ্গে চলমান শীতল সম্পর্কের ব্যাখ্যা দেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, “তারা আমাদের সঙ্গে বারবার মিথ্যা বলে আসছে। তাদের কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। যার ফলে শত্রুরা দ্রুতই আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসছে। আমাদের ব্যাপারে পশ্চিমাদের এমন ষড়যন্ত্র কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।”
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর, ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার চলমান বৈরিতা নিরসনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতর থেকেই রাশিয়ার প্রতি অসহযোগী মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন। তাদের মতে, ট্রাম্পকে ক্ষমতায় আনতে মস্কো কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক আচরণ সেদিকেই ইঙ্গিত করে। যার মাধ্যমে রাশিয়া আবারো ইউরোপ জুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ পাবে। ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার আরও একটি ব্যাপারে দ্বন্দ্ব রয়েছে। ইউরোপ জুড়ে ন্যাটোর ব্যালাস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রেমলিন হুমকি হিসেবে দেখে। যদিও ন্যাটোর দাবি, এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানকে লক্ষ্য করে তৈরি করা। যার সক্ষমতা মাঝারি মানের। ক্রেমলিন মনে করে, এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলে সেটা রাশিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিবে।
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী যেকোনো সময়ের চেয়ে, বর্তমানে রাশিয়া এবং ন্যাটোর বৈরিতা কিছুটা হলেও কমে এসেছে। তবে অনেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই মুহূর্তে রাশিয়ার তুলনায় সক্ষমতার দিক থেকে ন্যাটো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাছাড়া নিজেদের ভেতর ভুল বোঝাবুঝির কারণে ন্যাটো কিছুটা খারাপ সময় পার করছে। বিশেষ করে, তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার সাম্প্রতিক অস্ত্র চুক্তিকে জোটের অনেকে ভালভাবে নেয়নি। অনেক দেশই ন্যাটোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আবার যাচাই করার আবেদন করেছে। তারপরও সব ভেদাভেদ ভুলে ন্যাটো পুরো ইউরোপ জুড়ে নীরবে প্রতিরক্ষা বিপ্লব কার্যক্রম শুরু করতে চায়। যা রাশিয়াকে ইউরোপে একঘরে করে ফেলারই প্রয়াস। তবে রাশিয়াও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। চারদিক থেকে মেলে ধরা জাল ছিন্ন করতে তারাও নীরবে ছক কষছে। তাদের নীরব থাকার এই একটা মানেই হতে পারে। ফলে আদতে বর্তমানে দুই পক্ষের মাঝে যে নীরবতা, সেটা বড় কোনো ঝড়ের আগে বায়ুপ্রবাহ থেমে যাওয়ার মতোই।