শক্তিশালী অর্থনীতি হয়ে উঠার জন্য যতোগুলো উপাদান দরকার, তার প্রায় সবকিছুই আছে তুরস্কে। তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের ফাইন্যান্সিয়াল কাঠামোকে বিনিয়োগবান্ধব করে তুলেছিল কয়েক দশকে। তুরস্কের জনমিতি উচ্চ প্রবৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক, ভৌগলিকভাবেও তুরস্ক রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। এর পাশাপাশি, তুরস্কের কর কাঠামো বেশ কার্যকর, সেই সূত্রে তুরস্কের পাবলিক ফাইন্যান্সেরও অবস্থা ভালো ছিল একটা দীর্ঘ সময়। সবমিলিয়ে, তুরস্ককে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বিবেচনা করছিলেন সম্ভাবনাময় অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে।
অর্থনীতির বাইরেও তুরস্কের বহুবিধ গুরুত্ব রয়েছে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র তুরস্কই ন্যাটোর সদস্য, আবার ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের রয়েছে দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক বাহিনী। আর, উসমানিয়া খেলাফাতের উত্তরাধিকার হওয়ায়, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর কাছে প্রতীকী গুরুত্বও আছে তুরস্কের।
তবে, সবকিছু ছাপিয়ে তুরস্ক বর্তমানে আলোচিত তার অর্থনৈতিক সংকটের জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কে উচ্চ হারে মুদ্রাস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, অবমূল্যায়ন হচ্ছে তুরস্কের মুদ্রা লিরার। কোভিড-১৯ মহামারির আগে থেকেই ধুঁকতে থাকা তুরস্কের অর্থনীতির সংকট মহামারির সময়ে আরো গভীর হয়েছে। আমদানি করা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে রিজার্ভশূন্য হয়ে পড়েছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি
গত কয়েক দশকের মধ্যে তুরস্কের অর্থনীতি গত কয়েক মাসে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি প্রত্যক্ষ করেছে। সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তুরস্কের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ৪৮.৭ শতাংশ, যা ২০২২ সালের এপ্রিলের পরে সর্বোচ্চ। টার্কিশ স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসেই কনজ্যুমার প্রাইস বেড়েছে ৪৮.৭ শতাংশ, যেটি আগের বছরের ডিসেম্বরেও ছিল ৩৬.১ শতাংশ।
২০২২ সালে তুরস্কে যাতায়াত ভাড়া বেড়েছে ৬৮.৮৯ শতাংশ, খাদ্য আর নন-অ্যালকোহলিক পণ্যের দাম বেড়েছে ৫৫.৬১ শতাংশ, গৃহস্থালীর পণ্যের দাম বেড়েছে ৫৪.৫৩ শতাংশ। একই সময়ে যোগাযোগ খাতে ব্যয় বেড়েছে ১০.৭৬ শতাংশ, শিক্ষায় ব্যয় বেড়েছে ১৮.৬৭ শতাংশ। সবমিলিয়ে, জানুয়ারিতেই তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে ১১.১০ শতাংশ।
এরদোয়ানের জাস্টিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ২০০২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সময় তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ, যেদটি দুই বছরের মধ্যেই এরদোয়ানের সরকারের কমিয়ে আনে ৮.৬ শতাংশে। পরবর্তী দশক জুড়ে এরদোয়ান আর তার জাস্টিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি যে নিরঙ্কুশ জনপ্রিয়তা উপভোগ করেছে, তার মূল নিয়ামক ছিল অর্থনীতির বিকাশ, মুদ্রাস্ফীতি উঠানামা করেছে ৬ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যেই। তুরস্কের মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছানো শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে, পরের কয়েক বছর সেটি কেবলই বেড়েছে। মুদ্রাস্ফীতি তুরস্কের এমন একটি অবস্থার অবতারণা ঘটিয়েছে, সেই অবস্থাকে ব্যবহার করে এরদোয়ান ২০০২ সালে তার জাস্টিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন।
তুরস্কের মুদ্রার দরপতন
একটি দীর্ঘ সময় ধরেই তুরস্কের মুদ্রা আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল একটি মুদ্রা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন প্রতি ডলারের বিপরীতে লিরার মান ছিল ১.৩। ২০১২ সালের জানুয়ারিতেও লিরা ধরে রেখেছিল মান, প্রতি ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছিলো ১.৭৮ লিরা। মুদ্রা হিসেবে লিরার পতন শুরু হয় এরপর থেকেই, ক্রমাগত ডলারের বিপরীতে কমতে থাকে লিরার মান। তবে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত এই মান ৩ এর নিচে ছিল, অর্থাৎ, প্রতি ডলারের বিপরীতে ৩ লিরার কম পাওয়া যেত। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে প্রতি ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছিল ৬.৫২ লিরা করে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে একটা সময় প্রতি ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছিল ১৬.৬৯ লিরা করে। বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১৩.৩৬ লিরা করে পাওয়া যাচ্ছে।
তুরস্কের মুদ্রার মানে এই পতন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সংকটে ফেলেছে, সংকটে ফেলেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও। লিরার দরপতন হওয়ায় আমদানির জন্য তুরস্ককে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে, ফলে তারল্য সংকটে ভুগছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফরেন রিজার্ভ পৌঁছে গেছে ঋণাত্মক অঙ্কের ঘরে।
বিপর্যস্ত জনজীবন
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে ইস্তাম্বুল শহরের উপকণ্ঠে থাকা এক জুয়েলারি দোকানের কথা উঠে আসে। প্রতিবেদনে আলোচিত জুয়েলারি দোকানের মালিক আগে সপ্তাহে একবার স্বর্ণের দাম খেয়াল করতেন, প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়ায় এখন প্রতিদিন ৫০ বার খেয়াল করেন স্বর্ণের দামের দিকে। স্বর্ণের দামের মতো প্রতিনিয়ত উঠানামা করছে তুরস্কের অন্যান্য জিনিসের দামও, তুরস্কের মধ্যবিত্তদের যাপিত জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে এই অর্থনৈতিক সংকট, খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে নিম্নবিত্ত ও অতিদরিদ্রদের।
অবস্থা সামাল দিতে তুরস্কের সরকার নূন্যতম মজুরি ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু, ডলারের বিপরীতে তুলনা করলেও সেই মজুরি বৃদ্ধির তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই। আগে ন্যূনতম মজুরি ছিল ৩৮৯ ডলার, ন্যূনতম মজুরি ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করার পর এখন মজুরি ৩০৯ ডলার।
তুরস্কের এই অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে তুরস্কের মানুষের মাথাপিছু আয়েও। ২০১৩ সালে তুরস্কের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ১২৬০০ ডলার, ২০২০ সালে এসে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৮৫০০ ডলারে।
কেন দায় যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের উপর?
অর্থনৈতিক সংকটের মূল দায় গিয়ে পড়ছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের উপর, ক্ষমতায় থাকা জাস্টিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সরকারের উপর। তুলনামূলক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষকরা কয়েক বছর ধরেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে কর্তৃত্ববাদী শাসক বলে আখ্যায়িত করছেন, রাজনীতিবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এরদোয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছেন নাগরিক স্বাধীনতা আর রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করে তুরস্কে সর্বাত্মকবাদ প্রতিষ্ঠা করার। সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, বর্তমান সময়ে তুরস্কের নির্বাহী আর আইন বিভাগে সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াগুলোকে ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের একক কর্তৃত্ব।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রেও। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা থাকলেও, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বার বার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করেছেন, মতপার্থক্য হওয়ায় সরিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আর অর্থমন্ত্রীকেও। অর্থমন্ত্রী আর গভর্নরের সাথে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মতপার্থক্যের মূল জায়গা হলো, তিনি বিশ্বাস করেন, স্বল্প সুদের হারের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা সম্ভব। যেটি অর্থমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরেরা মানতে রাজি না।
ফলে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ন্যূনতম দুইবার এই ইস্যুতে অর্থমন্ত্রী বদল করেছেন, দুই বছরে তিনবার বদল করেছেন গভর্নরও, নিজের পছন্দের লোক বসিয়ে কমিয়েছেন সুদের হার। প্রায় সকল অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের মতে, এটিই সংকটের মূল কারণ। সবমিলিয়ে, এই সংকটের মূল দায় যেমন পড়ছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের উপর, এই সংকটের উপরই নির্ভর করবে এরদোয়ানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
এরদোয়ানের রাজনৈতিক ঝুঁকি
তুরস্কের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দুই দশক ধরেই নিরঙ্কুশ আধিপত্য উপভোগ করছেন, উপভোগ করছেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ২০০২ সালের পর থেকে তার দল সবগুলো নির্বাচনেই জয়লাভ করেছে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে কেন্দ্র করেই অনেক তুর্কি স্বপ্ন দেখছিলেন পুরনো গৌরব ফিরে পাওয়ার। দুই দশকের পথচলায় এরদোয়ান দেশে আর বিদেশে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন, মোকাবেলা করতে হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থানও। কিন্তু, এরদোয়ানের সামনে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যেটি তার জনপ্রিয়তায় চিড় ধরাচ্ছে, প্রশ্নের মুখে ফেলছে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা আর ভবিষ্যৎকে।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বর্তমানে এপ্রুভাল রেটিং মাত্র ৩৮.৬ শতাংশ, ডিসএপ্রুভাল রেটিং ৫৭.২ শতাংশ। একইরকম একটি অবস্থার মুখোমুখি এরদোয়ান হয়েছিলেন ২০১৫ সালে, এপ্রুভাল রেটিং নেমে গিয়েছিল ৪০ এর নিচে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সেই সংকট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু এবারের সংকট থেকে উত্তরণের সহজ কোনো পথ এরদোয়ানের সামনে নেই। তুরস্কের অর্থনীতির বর্তমান যে অবস্থা, তাতে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সবাই। এই অবস্থা থেকে তুরস্কে বের করে আনতে না পারলে, ২০২৩ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং তার জাস্টিজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির জন্য ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসা কঠিন হবে।
তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ভিন্ন এক পদ্ধতি নিয়েছেন। মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকলে অধিকাংশ দেশই সুদের হার বাড়িয়ে দেয়, মানুষের হাতে অর্থের প্রবাহ কমিয়ে জিনিসপত্রের দামকে নিয়ন্ত্রণে আনে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই প্রক্রিয়ার পুরো বিপরীত একটি পলিসি নিয়েছেন, সুদের হার কমিয়ে ঋণ নেওয়াকে উৎসাহিত করছেন। এই ঝুঁকির ফলাফল কতোটুকু ইতিবাচক হবে, তুরস্কের মানুষের যাপিত জীবনে টিউলিপ ফুলে রাঙানো ভোর আসবে কিনা, সেটির উত্তর সময়ই দেবে।