নদী, সমুদ্র, পাহাড়-পর্বতের ঢাল ইত্যাদি নানা উপকরণের মাধ্যমে সাধারণত একেকটি দেশের মানচিত্র নির্ধারিত হয়। অনেকক্ষেত্রে আবার ভৌগলিক রেখা পরিমাপ করে দুটি দেশের মধ্যকার সীমারেখা ঠিক করা হয়। এই সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয় একটি দেশের নাগরিকদের জাতীয়তা কী হবে, তাদের কথা বলার ভাষা কী হবে, কেমন হবে তাদের সংস্কৃতি, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেই দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন হবে। কারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি কেমন হবে এবং সেই দেশের মানুষ কতটা সুখে থাকবে।
একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সাধারণত সেই দেশের সব ধরনের অবকাঠামো ঠিক করা হয়। রাষ্ট্রের অর্থনীতি যতটা মজবুত বা শক্তিশালী হবে, দেশের মানুষের কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করা ততটাই সহজ হবে। ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে উন্নয়ন তো পরের কথা, নাগরিকদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতেই রাষ্ট্র হিমশিম খেয়ে যায়। অনেক রাষ্ট্রেই সরকার প্রধানের পতনের মূল কারণই থাকে এই অর্থনৈতিক দুর্দশা।
অর্থনীতিকে উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি ধরে নিয়ে অনেক রাষ্ট্র চলে গেছে উন্নয়নের চরম শিখরে। আবার অনেক রাষ্ট্র এখনও দুর্ভিক্ষের অভিশাপে পিশে মরছে। এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যই অনেক নাগরিক নিজেদের ভাগ্য বদলানোর জন্য এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে পাড়ি জমায়। শিক্ষা গ্রহণ কিংবা চাকরির খোঁজে বিদেশে গিয়ে অনেকেই সেই রাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। এরা তখন নিজ দেশের প্রবাসী বনে যায়।
অনেক সময় পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্রের সীমানা দিয়ে ঝগড়া-বিদাদ থেকে যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে যায়। কার আগ্নেয়াস্ত্র কত বেশি শক্তিশালী, কে কতটা পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষমতাধর এসব দেখানোর জন্যও মেতে থাকে অনেক রাষ্ট্র। সেই সাথে পৃথিবীতে সকল ধরনের আন্তর্জাতিক ব্যবসানীতিও নির্ভর করে এই আন্তর্জাতিক সীমারেখার উপর।
কিন্তু কেমন হতো যদি হঠাৎ করেই এই সকল সীমারেখা উঠিয়ে দিয়ে পুরো পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রকে এক করে দেয়া হয়? সবাই নিজেকে এক পৃথিবীবাসী হিসেবে কতটা মানিয়ে নিতে পারবে? পৃথিবীতে কি যুদ্ধের বদলে শান্তি বিরাজ করবে? কাল্পনিক ইউটোপিয়া রাষ্ট্র কি তখন বাস্তবে রূপ নেবে? চলুন, দেখে নেয়া যাক এরকম কল্পনার রাষ্ট্র আদৌ বাস্তবে রুপ দেয়া সম্ভব কি না।
শুরুতেই ইউটোপিয়া রাষ্ট্রের মূলভাব জেনে নেয়া যাক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ইউটোপিয়া হলো এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক তার নিজ নিজ আদর্শ মেনে চলতে পারবে, আদর্শ নিয়ে কোনো প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি থাকবে না। প্রত্যেকের নিজ নিজ ভোটাদিকার প্রয়োগের সুযোগ থাকবে। ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে কাউকে আলাদা করে দেখা হবে না। সর্বোপরি একটি সুন্দর এবং সুখী রাষ্ট্র হলো ইউটোপিয়া। কিন্তু বাস্তবে এই উপাদানগুলো কখনোই একসাথে পাওয়া সম্ভব না। অর্থাৎ ঝগড়া, মারামারি, বর্ণবাদ এগুলো সব দেশেই আছে। তাই ইউটোপিয়া একটি কল্পনা মাত্র। কিন্তু যদি পুরো পৃথিবীকে এক করে দেয়া হয় তাহলে কী হতে পারে?
প্রথমেই নজরে আসবে অর্থনীতির বিষয়টি। যেহেতু এখন পৃথক অর্থনীতির কোনো দেশ আর নেই, তাই পুরো পৃথিবীতে মুক্ত অর্থনীতি এবং মুক্ত বাণিজ্য বিরাজ করবে। মানুষজন সহজেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াত করতে পারবে। পাসপোর্ট এবং ভিসার ব্যবহার যেহেতু সীমারেখার সাথেই উঠে গেছে, তাই যে কেউ এখন এক দেশের অঞ্চল থেকে অন্য দেশের অঞ্চলে বিনা বাঁধায় যাওয়া আসা করতে পারবে। অর্থাৎ অর্থনীতির তখন ব্যাপক প্রসার হতে থাকবে। যেসব অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ চলছে বা অর্থনৈতিক দুর্দশা বিরাজমান, সেসব অঞ্চলের নাগরিকরা অন্য অঞ্চলে চলে যেতে পারে বা সেখান থেকে সাহায্য পেতে পারে।
শিক্ষাও তখন হয়ে যাবে উন্মুক্ত। যে কেউ চাইলে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে গিয়ে শিক্ষা নিতে পারে। পড়ালেখা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য তখন একটি রাষ্ট্রের কাছে কেন্দ্রীভূত না থেকে তা পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে। রাষ্ট্রগুলোয় তখন নিজেদের অন্য সবার থেকে আলাদাভাবে উন্নয়ন না করে, বৈশ্বিক উন্নয়নে কাজ করবে। অর্থাৎ সহজ কথায় পৃথিবীতে তখন থাকবে উন্নয়নের ছড়াছড়ি। পৃথিবীর নাগরিকরা সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। সবাই তার নিজ নিজ অধিকার ভোগ করতে পারবে। অর্থাৎ কাল্পনিক ইউটোপিয়া রাষ্ট্র বাস্তব হতে যাচ্ছে!
এবার দৃশ্যপটটা একটু পাল্টে দেই। কেবল অর্থনীতি, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে নজর না দিয়ে আরও বৃহৎ বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া যাক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যেখানে ছড়াছড়ি, সেখানে কোন রাষ্ট্রের অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি ঠিক করা হবে? দেখা যাচ্ছে, একটি রাষ্ট্রের অর্থনীতি অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক উঁচুতে অবস্থান করছে। তারা কি এত সহজে তাদের অর্থ-সম্পদ পুরো পৃথিবীতে বিলিয়ে দেবে? যদি করেও, এতে বিপুল পরিমাণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা যাবে। এখানে বিশ্ব অর্থনীতির মূল চাবিকাঠির অংশ তেল বাণিজ্য নিয়ে দেখা দেবে শঙ্কা। পুরো পৃথিবী এক হয়ে যাওয়ার ফলে কোনো রাষ্ট্র বা অঞ্চল আর নিজের কাছে বিপুল পরিমাণ তেল মজুদ রাখতে পারবে না। বৈশ্বিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে হলেও তাদের বর্তমান ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এরকম অর্থনীতি বিষয়ক আরও হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে, যেগুলো পুরো পৃথিবীর এক হওয়া নিয়ে বাঁধা সৃষ্টি করে।
এবার অর্থনৈতিক অবস্থার বাহিরের বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়া যাক। এখন যেহেতু পুরো পৃথিবী এক তাই আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এমনটাই ভাবছেন? আরও গভীরভাবে চিন্তা করুন। পুরো পৃথিবী এক হয়ে গেলেও একজন ব্যক্তি থাকতে হবে যে কিনা পুরো পৃথিবীর শাসন ব্যবস্থায় থাকবে। বর্তমানে যেমন প্রতিটি দেশের নিজ নিজ সরকার প্রধান আছে, তেমনই পুরো পৃথিবীর একজন সরকার প্রধান তখন থাকা লাগবে। কিন্তু কে হবে সেই ব্যক্তি? কোথা থেকে তাকে নির্বাচন করা হবে? তার চেয়েও বড় কথা- কেমন হবে পুরো পৃথিবী শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি? গণতান্ত্রিক পৃথিবী? সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা? নাকি পৃথিবীতে একনায়ক রাজ্যশাসন ব্যবস্থা সবাই মেনে নেবে? পৃথিবীতে বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রচলিত আইন ও শাসন ব্যবস্থা পাল্টে নতুন আইনের রুপরেখা কীরুপ হবে? কারা সেই ব্যক্তি হবেন যাদের পুরো পৃথিবীর মানুষ ভরসা করতে পারবে?
এছাড়াও পৃথিবীর একেক অঞ্চলে একেক সংস্কৃতি, ভাষা বিদ্যমান থাকায় তখন পুরো পৃথিবীর কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি এবং ভাষা নিয়ে দেখা দিবে আরেক সমস্যা। এসব কিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিবে যখন আপনি এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থায়ী বসবাসের জন্য চলে যেতে চাইবেন। স্বাভাবিকভাবেই আপনি ভালো এবং সুন্দর একটি জীবন যাপনের সুযোগ পেলে বর্তমান জায়গায় পড়ে থাকতে চাইবেন না। ধরে নিলাম, বর্তমানে যে জায়গায় আছেন, সেখানে খাবার সমস্যা, পানির সমস্যা, মৌলিক চাহিদাগুলো পাচ্ছেন না। আপনার কাছে সুযোগ আছে এর চেয়ে ভালো জায়গায় চলে যাওয়ার। দূরে কোনো এক অঞ্চলে গেলে আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আপনি যখন সেখানে যাবেন, সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা কি আপনাকে নতুনভাবে মেনে নেবে? আচ্ছা ধরে নিলাম আপনাকে তারা গ্রহণ করে নিলো। কিন্তু আপনি কি একা ভালো কিছুর আশায় সেখানে যাচ্ছেন? আপনার মতো আরো হাজারজন সেখানে গিয়ে হাজির হচ্ছে। তাহলে কাকে সেই অঞ্চলে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দেয়া হবে? তখন সেখানে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেবে। আপনাকে সেই অঞ্চল থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমনও হতে পারে সেখানের স্থানীয় বাসিন্দাদের বের করে দিয়ে বহিরাগতরা জায়গা দখল করে নিয়েছে!
এসব দিক বিবেচনায় আবাসন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। ভালো কিছুর আশায় পৃথিবীর মানুষ তখন সবকিছু হারিয়ে বসবে। নতুন করে দেখা দেবে কলহ। শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্য করার পরিস্থিতি নষ্ট হয়ে যাবে। পৃথিবীর মানুষ সম্মুখীন হবে বৈশ্বিক অশান্তির। অর্থাৎ ইউটোপিয়া কেবলই একটি কল্পনা। বাস্তবে এটির রূপ দেয়া আদৌ সম্ভব না। আর সীমারেখা ছাড়া একক পৃথিবী? ভুলে যান। এমন চিন্তা বাস্তবায়ন করতে গেলে পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি আগে নিয়ে রাখা দরকার।