গতানুগতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে সাধারণত শহুরে আফগান নারীদের অধিকার নিয়েই বেশি আলোচনা করা হয়। আড়ালে রয়ে যায় গ্রামীণ আফগান নারীদের চাওয়া-পাওয়ার কথা। অথচ এরাই মূলত আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল নারী। কারণ আফগানিস্তানের ৭০% মানুষই গ্রামে বসবাস করে। সেই নারীদের কথাই নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের একটি দীর্ঘপাঠ প্রবন্ধে তুলে এনছেন সাংবাদিক আনন্দ গোপাল।
সেই সাথে প্রবন্ধটিতে উঠে এসেছে আমেরিকান বাহিনীর এবং তাদের সহযোগী আফগান ন্যাশনাল আর্মির সীমাহীন অমানবিকতার কথা, আফগান জনগণের উপর চালানো তাদের গণহত্যার কথা এবং তালেবানদের বিজয়ের পেছনের কারণগুলোর কথা।
আমাদের এই সিরিজটি দীর্ঘ এই চমৎকার প্রবন্ধটিরই অনুবাদ। মোট সাতটি পর্বে করা অনুবাদ সিরিজটির এটি ষষ্ঠ পর্ব। সবগুলো পর্বের লিঙ্ক এখানে: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব
নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাকে তালেবান ইসলামিক আমিরাত অফ আফগানিস্তান বলে অভিহিত করে। তারা দাবি করে, যখন বিদেশীরা থাকবে না, তখন তারা একটি শান্ত, স্থিতিশীলতার যুগের নেতৃত্ব দেবে। এই গ্রীষ্মে আফগান সরকারব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ছিল, তখন আমি ইসলামি আমিরাতের ডি-ফ্যাক্টো রাজধানী হেলমন্দ প্রদেশে ভ্রমণ করেছিলাম- আমেরিকা-পরবর্তী আফগানিস্তান কেমন, তা বোঝার জন্য।
আমার যাত্রা শুরু হয় লস্করগাহ থেকে। শহরটি তখনও আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। শহরের উপকণ্ঠে ছিল একটি সিমেন্টের ভবন, যার উপর আফগান সরকারের পতাকা উড়ছিল। এই চেকপয়েন্টের পরে কাবুল সরকারের আর কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। কাছেই একটি পিকআপ ট্রাক স্থির বসেছিল। পিকআপের উপর গাদাগাদি করে অবস্থান করছিল সিআইএর সমর্থনপুষ্ট আফগান গোয়েন্দা সংস্থার বেতনভুক্ত কুখ্যাত মিলিশিয়া সাঙ্গোরিয়ানের আধ ডজন সদস্য। এর মধ্যে দুজন যোদ্ধার বয়স বারো বছরের বেশি বলে মনে হচ্ছিল না।
জীর্ণ একটি টয়োটা করোলায় চড়ে দুই স্থানীয় লোকের সাথে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কারো নজরে না পড়েই আমরা চেকপয়েন্ট পার হয়ে গেলাম। শীঘ্রই আমরা উত্তপ্ত মাটির বৃক্ষহীন দিগন্তে গিয়ে পৌঁছলাম, যেখানে আমাদের পায়ের নিচে বলতে গেলে কোনো রাস্তা ছিল না। আমরা আমেরিকান এবং ব্রিটিশদের দ্বারা নির্মিত আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশের পরিত্যক্ত ফাঁড়িগুলো অতিক্রম করলাম। সেগুলো পার হতেই কতগুলো বৃত্তাকার মাটির দুর্গ এবং পেটের উপর ভর দিয়ে শুয়ে থাকা একাকী এক তালেবান স্নাইপারের অবয়ব দৃশ্যমান হলো। তার পেছনে উড্ডীয়মান সাদা পতাকা ইসলামি আমিরাতের প্রবেশপথ ঘোষণা করছিল।
আমাদের পেছনে ফেলে আসা পৃথিবীর সাথে তালেবানদের রাজ্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল বন্দুকধারীদের অনুপস্থিতি। আফগানিস্তানে আমি চেকপয়েন্টগুলোতে ঢোলা ট্রাউজার পরা এবং সুরমা চোখে দেওয়া পুলিশ, মুখ ঢাকা টুপি পরা মিলিশিয়া, আর গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টদেরকে গাড়ি পরিদর্শন করতে দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এখানে আমাদেরকে তালেবানদের খুব কম চেকপয়েন্টই অতিক্রম করতে হয়েছে। এবং যখন আমরা কোনো চেকপয়েন্টের সামনে পড়েছি, তখন তারা খুবই বিশৃঙ্খলভাবে আমাদের গাড়ি পরীক্ষা করেছে। “তালেবানকে সবাই ভয় পায়,” আমার ড্রাইভার হাসতে হাসতে বলেছিল। “এখানে আমাদের মনের ভেতরেই চেকপয়েন্ট আছে।”
মানুষ যদি তাদের নতুন শাসকদেরকে ভয় পায়, তাহলে তারা তাদের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধও অনুভব করে। এখানে-সেখানে গ্রামবাসীরা দল বেঁধে রাস্তার পাশের জালের নিচে বসে তালেবদের সাথে চা পান করছিল। গ্রামীণ সাংগিনের একটি কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের সামনে গ্রামাঞ্চলের দৃশ্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ল। ছেলেরা খালের উপর সাঁতারের প্রতিযোগিতা করছিল, গ্রামের পুরুষরা এবং তালেবানরা স্বচ্ছ ফিরোজা জলে পা ডুবিয়ে বসে ছিল। আমরা সবুজ ফসলি জমি এবং ফলের গাছের ছাউনি পার হলাম। মহিলাদের একটি দল বাজারের রাস্তা ধরে হাঁটছিল, আর কুচিওয়ালা ফ্রক পরা দুটি মেয়ে লাফালাফি করছিল।
আমরা গেরেশ্কের নিকটবর্তী হলাম। শহরটি তখনও সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। যেহেতু শহরটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে লাভজনক টোল-আদায়ের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তাই বলা হতো, শহরটির নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, সে-ই হেলমন্দ নিয়ন্ত্রণ করবে। তালেবানরা আক্রমণ শুরু করেছিল এবং কামানের আওয়াজ সমগ্র সমভূমিতে ছড়িয়ে পড়ছিল। বিমান হামলার ভয়ে পরিবারগুলোর একটি স্রোতধারা বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছিল। তাদের গাধাগুলো বিশালাকৃতির পোটলার ওজনের ভারে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ছিল। রাস্তার ধারে নীল রঙের বোরকা পরা এক মহিলা ঠেলাগাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়ির ভেতরে ছিল চাদরে মোড়ানো একটি শরীর। কিছু তালেবান সদস্য পাহাড়ের চূড়ায় জড়ো হয়ে নিহত এক সহযোদ্ধাকে কবরে নামিয়ে দিচ্ছিল।
আমি ওয়াকিল নামের এক চশমা পরা তালেবান কমান্ডারের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। আমার দেখা অন্য অনেক যোদ্ধার মতো তিনিও কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, কয়েক বছর মাদ্রাসায় পড়েছেন এবং আমির দাদো, নাইন্টি থার্ড ডিভিশন আর মার্কিন বাহিনীর হাতে কয়েক ডজন আত্মীয়-স্বজনকে হারিয়েছেন। কোনো বিদ্বেষ ছাড়াই এমনভাবে তিনি তার পরিবারের উপর নেমে আসা দুর্যোগের কথা বর্ণনা করছিলেন, যেন আমেরিকান যুদ্ধ একটি প্রাকৃতিক বিষয়।
ওয়াকিলের বড় ভাই ছিলেন এক তালেবান কমান্ডার। তিনি যুদ্ধে মারা যাবার পর ত্রিশ বছর বয়সেই ওয়াকিল কমান্ডার পদমর্যাদা অর্জন করেছিলেন। তিনি খুব কমই হেলমন্দ ছেড়ে বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন। গেরেশ্ক দখল করার প্রত্যাশায় তার মুখ বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কারণ এটি ছিল এমন একটি শহর, যেখান থেকে তিনি মাত্র কয়েক মাইল দূরে থাকতেন, কিন্তু বিশ বছর ধরে তিনি সেখানে যেতে পারেননি।
আমি যখন নোট নিচ্ছিলাম, তখন তিনি হেসে উঠে বলেছিলেন, “লেখার কথা ভুলে যান। আমার সাথে এসে দেখুন কীভাবে আমরা শহরটি জয় করি!” দিগন্তে ভেসে যেতে থাকা একটি হেলিকপ্টারের দিকে তাকিয়ে আমি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। তিনি দ্রুত চলে গেলেন। এক ঘণ্টা পর আমার ফোনে একটি ছবি ভেসে উঠল- ওয়াকিল নাইন্টি থার্ড ডিভিশনের সাথে সম্পৃক্ত এক সরকারি কর্মকর্তার পোস্টার নামিয়ে ফেলছেন। গেরেশ্কের পতন ঘটে গেছে।
তালেবান জেলা গভর্নরের বাড়িতে একদল তালেব গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে দান করা ঢেঁড়শ ও নান রুটি খেতে বসেছিল। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, যুদ্ধ শেষ হলে তাদের পরিকল্পনা কী? অধিকাংশই বলল, তারা কৃষিকাজে ফিরে যাবে, অথবা ধর্মীয় শিক্ষা অন্বেষণ করবে। আমি ইরাক থেকে আফগানিস্তানে এসেছি শুনে হামিদ নামের এক তরুণ কমান্ডার অভিভূত হলো। সে জানালো, তার স্বপ্ন একদিন সে ব্যাবিলনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাবে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনার কী মনে হয়, যুদ্ধ যখন শেষ হবে, তারা কি আমাকে ভিসা দেবে?”
এটা স্পষ্ট ছিল যে, পরবর্তীতে কী ঘটবে তা নিয়ে তালেবানরা বিভক্ত ছিল। আমার সফরের সময় আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কয়েক ডজন তালেবান সদস্য তাদের আমিরাতের দর্শন সম্পর্কে লক্ষণীয় বিপরীতমুখী বক্তব্য দিয়েছিল। রাজনৈতিক মনোভাবের তালেবরা, যারা বিদেশে বসবাস করেছে এবং যাদের দোহায় বা পাকিস্তানে ঘরবাড়ি আছে, তারা আমাকে সম্ভবত হিসাব-নিকাশ করেই বলেছে যে, পূর্বের তুলনায় এখন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি বিশ্বজনীন। গত দুই দশকের বেশিরভাগ সময় হেলমন্দ এবং পাকিস্তানের মধ্যে কাটানো এক পণ্ডিত বলেছিলেন, “নব্বইয়ের দশকে আমরা অনেক ভুল করেছিলাম। তখন আমরা মানবাধিকার, শিক্ষা, রাজনীতি সম্পর্কে জানতাম না। আমরা কেবল ক্ষমতার জোরে সবকিছু দখল করেছিলাম। কিন্তু এখন আমরা এসব বুঝতে পারছি।” সেই পণ্ডিতের আশাব্যঞ্জক চিত্র অনুযায়ী তালেবানরা পূর্ব শত্রুদের সাথে মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগি করবে, মেয়েরা স্কুলে যাবে এবং মহিলারা পুরুষদের সাথে “কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে” কাজ করবে।
কিন্তু বাস্তবে হেলমন্দে এই ধরনের তালেব খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। সেখানকার সাধারণ তালেবরা ছিল হামদুল্লাহর মতো — সরু চেহারার একজন কমান্ডার, যিনি আমেরিকান যুদ্ধে তার পরিবারের এক ডজন সদস্যকে হারিয়েছিলেন এবং যিনি জীবনকে পরিমাপ করতেন বিয়ে, জানাজা এবং যুদ্ধের মাধ্যমে। তিনি বলেছিলেন, তার এলাকার জনসাধারণ এত অবর্ণনীয় দুর্দশা ভোগ করেছে যে, তাদের পক্ষে কখনোই ক্ষমতা ভাগাভাগি করা সম্ভব হবে না। তার মতে, গত বিশ বছরের ধ্বংসযজ্ঞের শুধুমাত্র একটিই সমাধান আছে: পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া। তিনি আমাকে গর্বের সাথে বলেছিলেন, তিনি তালেবানদের কাবুল জয়ের অভিযানে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, যে শহরটি তিনি কখনও দেখেননি। তিনি অনুমান করেছিলেন, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সেখানে পৌঁছতে পারবেন।
গ্রামীণ জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ নারী-অধিকার প্রশ্নে হামদুল্লাহর মতো পুরুষরা একেবারেই অবস্থান পরিবর্তন করেনি। হেলমন্দের গ্রামাঞ্চলের অনেক অংশে মহিলাদের বাজারে যাওয়া নিষেধ। সম্প্রতি সাংগিনের এক মহিলা বাজার থেকে তার বাচ্চাদের জন্য বিস্কিট কেনার পর তালেবানরা তাকে, তার স্বামীকে এবং দোকানদারকে মারধর করে। তালেবান সদস্যরা আমাকে বলেছিল, তাদের পরিকল্পনা তারা মেয়েদেরকে মাদ্রাসায় যাওয়ার অনুমতি দেবে, কিন্তু সেটা শুধুমাত্র বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত। আগের মতো গৃহস্থালি কাজ ছাড়া মহিলাদের চাকরি-বাকরিও নিষিদ্ধ করা হবে। পাজারো রাগান্বিত স্বরে মন্তব্য করেছিল, “এরা একেবারেই বদলায়নি।”
হেলমন্দ ভ্রমণের সময় আমি রাষ্ট্র হিসেবে তালেবানদের খুব কম চিহ্নই দেখতে পাচ্ছিলাম। অন্যান্য বিদ্রোহী আন্দোলনের বিপরীতে তালেবান বলতে গেলে কোনো ধরনের পুনর্গঠনের কাজই করেনি। তাদের কঠোর বিচার ব্যবস্থার বাইরে তারা কোনো ধরনের সামাজিক সেবাও প্রদান করেনি। তারা কোনো ধরনের বিরোধিতাও সহ্য করে না: পান কিল্লায়ে তারা শায়েস্তা গুল নামের এক গ্রামবাসীকে আফগান সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে রুটি দেওয়ার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।
তা সত্ত্বেও অনেক হেলমন্দবাসী তালেবানের শাসনকেই পছন্দ করে। এমনকি আমি যেসব মহিলাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তারাও। মনে হচ্ছিল তালেবানদের আন্দোলনটি জয়লাভ করেছে গতানুগতিকভাবে, তাদের বিরোধীদের চরম ব্যর্থতার কারণে। স্থানীয়দের জন্য কোয়ালিশন বাহিনী এবং তাদের আফগান মিত্রদের অধীনের জীবন ছিল ভয়াবহ রকমের অনিশ্চিত। এমনকি খোলা মাঠে চা পান করা, কিংবা বোনের বিয়েতে যাওয়ার জন্য গাড়ি চালানোও ছিল জীবন বাজি রাখার মতো কাজ। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপরীতে তালেবানরা যা প্রস্তাব করেছিল, তা ছিল একটি সহজ দর কষাকষি: আমাদের কথা মেনে চলো, তাহলে আমরা তোমাদেরকে হত্যা করব না।
গ্রামবাসীদের সাথে আমার প্রতিটি কথোপকথনে এই নির্মম হিসাব-নিকাশের বিষয়টি উঠে এসেছিল। ইয়াখ চাল গ্রামে আমি তালেবানদের হাতে সম্প্রতি দখল হওয়া একটি আফগান সেনা চৌকির ধ্বংসাবশেষ দেখেছিলাম। সেখানে টুকরো ধাতু, দড়ি, চুল্লি আর নুড়ি পাথর ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। চৌকিটি যেদিন দখল হয়েছিল, তার পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা বিক্রি করার মতো জিনিস কুড়ানোর জন্য সেখানে ছুটে গিয়েছিল। আব্দুর রহমান নামের একজন কৃষক যখন তার ছোট ছেলেকে নিয়ে সেখানকার আবর্জনার মধ্য দিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে হাঁটছিলেন, তখন দিগন্তে আফগান সেনাবাহিনীর গানশিপ এসে উপস্থিত হয়।
গানশিপটি এত নিচু দিয়ে উড়ছিল যে, “কালাশনিকভ দিয়েও এতে গুলি চালানো যেত,” আব্দুর রহমান স্মরণ করেছিলেন। সে সময় আশেপাশে কোনো তালেবান ছিল না, ছিল শুধু বেসামরিক মানুষ। কিন্তু তারপরেও গানশিপ গুলি ছুঁড়তে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা ডানে-বামে পড়ে যেতে শুরু করে। সামনে চলে যাওয়ার পর গানশিপটি আবারও ফিরে এসে আক্রমণ অব্যাহত রাখে। আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “অনেক মানুষ মাটিতে পড়ে চিৎকার করছিল। তাদের শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাদের মধ্যে অনেকে ছিল ছোট বাচ্চা।” গ্রামবাসীদের হিসাব অনুযায়ী সেদিন কমপক্ষে পঞ্চাশজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
পরে আমি সেই আফগান আর্মি হেলিকপ্টারের পাইলটের সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমি আমার ক্রুদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন তারা সেখানে গুলি করেছিল। তারা বলেছিল, ‘আমরা জানতাম তারা বেসামরিক নাগরিক, কিন্তু ক্যাম্প ব্যাস্টিয়ন আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল তাদের সবাইকে হত্যা করতে।” ক্যাম্প ব্যাস্টিয়ন ছিল একটি সাবেক ব্রিটিশ ঘাঁটি যা আফগানদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।
আমরা যখন ফোনে কথা বলছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তেও আফগান আর্মি হেলিকপ্টারগুলো গেরশ্কের জনবহুল কেন্দ্রীয় বাজারের উপর গুলিবর্ষণ করে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করছিল। হেলমন্দে অবস্থিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, “যখন সরকারি বাহিনী একটি এলাকায় পরাজিত হয়, তখন তারা বেসামরিক জনগণের উপর তার প্রতিশোধ নেয়।” হেলিকপ্টারের পাইলটও এটি স্বীকার করেছিলেন। তিনি যোগ করেন, “আমরা সামি সাদাতের নির্দেশে এগুলো করেছি।”
জেনারেল সামি সাদাত ছিলেন আফগান সেনাবাহিনীর সাতটি কোরের মধ্যে একটির প্রধান। আমির দাদোর প্রজন্মের ক্ষমতাশালীরা ছিল প্রদেশ ভিত্তিক এবং নিরক্ষর। কিন্তু সাদাত যুক্তরাজ্যের একটি স্কুল থেকে স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড লিডারশিপের উপর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন এবং মিউনিখের ন্যাটো মিলিটারি একাডেমিতে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন ব্লু সী লজিস্টিকস নামের একটি কাবুল-ভিত্তিক কর্পোরেশনের সিইও, যা তালেবান-বিরোধী বাহিনীকে হেলিকপ্টারের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে সাঁজোয়া যানবাহন পর্যন্ত সব কিছু সরবরাহ করত। এবং এই প্রতিষ্ঠানের সিইও থাকার সময়ও তিনি তার সামরিক বাহিনীর পদ ধরে রেখেছিলেন।
আমার হেলমন্দ সফরের সময় সাদাতের অধীনস্থ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারগুলো প্রায় প্রতিদিন গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল: সাংগিনের বাইরে একটি সাবেক ঘাঁটিতে পুরাতন ধাতু কুড়ানোর সময় বারোজন আফগানকে হত্যা করা হয়, সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত ক্যাম্প ওয়ালিদে প্রায় একইরকম একটি ঘটনায় হত্যা করা হয় চল্লিশজনকে; গেরেশ্ক বাজারে বিমান হামলায় হত্যা করা হয় বিশজনকে, যাদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু; তালেবানদের হাতে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বন্দী আফগান সৈন্যদেরকে তাদের নিজদের কমরেডরাই বিমান হামলা চালিয়ে হত্যা করে। (বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও জেনারেল সাদাত কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।)
ইয়াখ চাল ফাঁড়িতে হত্যাকাণ্ডের আগের দিন সিএনএন জেনারেল সাদাতের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল। “হেলমন্দ জায়গাটি সুন্দর। এখানে যদি শান্তি ফিরে আসে, তাহলে পর্যটন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে,” তিনি বলেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, তার সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত উচ্চ এবং তালেবানকে পরাজিত করার ব্যাপারে তিনি আত্মবিশ্বাসী। “আপনাকে খুব আশাবাদী বলে মনে হচ্ছে,” স্বস্তির সাথে বলেছিল উপস্থাপিকা। “আপনার কথা শুনতে আশ্বস্তকর শোনাচ্ছে।”
সাক্ষাৎকারটি আমি লস্করগাহের নিকটবর্তী একটি গ্রামের ফেরিওয়ালা মোহাম্মদ ওয়ালিকে দেখিয়েছিলাম। ইয়াখ চাল গণহত্যার কয়েকদিন পর তার এলাকার সরকারি মিলিশিয়ারা তালেবানদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এর পরপরই জেনারেল সাদাতের ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারগুলো এলোপাথাড়িভাবে মানুষের বাড়িঘরে আক্রমণ শুরু করে। তারা ওয়ালির বাড়ির উপর গুলি চালালে মাথায় গুলির টুকরোর আঘাতে তার মেয়ে মারা যায়। তার ভাই মেয়েটির নিথর শরীর কোলে নিয়ে উঠোনে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, “আমরা বেসামরিক মানুষ!” কিন্তু হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়ে তাকে এবং ওয়ালির ছেলেকেও হত্যা করা হয়। ওয়ালির স্ত্রী হেলিকপ্টারের গুলিতে পা হারায় এবং তার অন্য একটি মেয়ে কোমায় চলে যায়।
ওয়ালি যখন সিএনএনের ক্লিপটা দেখছিল, তখন তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। “কেন তারা এগুলো করছে?” সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। “তারা কি আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করছে?”
পরবর্তী এবং সর্বশেষ পর্বে থাকছে তালেবানদের অধীনে সাংগিনবাসীর জীবনযাপনের চিত্র এবং তাদের মনোভাবের বিবরণ। পড়তে ক্লিক করুন এখানে।