সুদূর অতীত থেকেই বিভিন্ন সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল মধ্যপ্রাচ্য, বিভিন্ন ধর্মের পূণ্যভূমিগুলোও অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যেই। সময়ের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা পরিবর্তন হয়েছে। একসময় মনে করা হতো, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাগুলো, বলকান উপদ্বীপ আর মিসর নিয়ে তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। সে সময় এই অঞ্চলের পরিচিত ছিলো ‘নিকট-প্রাচ্য’ নামে, ভারতীয় উপমহাদেশের কয়েকজন ইতিহাসবিদ ব্যবহার করেছেন ‘মধ্য-প্রাতীচ্য’ শব্দটি। অঞ্চলটি এশিয়ার পশ্চিমে হওয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে ‘পশ্চিম-এশিয়া’ শব্দটিও।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য বলতে পশ্চিমে মরক্কো থেকে পূর্বে ইরাক পর্যন্ত সকল আরব দেশকেই বুঝায়, অন্তর্ভুক্ত হয় অনারব দেশ তুরস্ক, ইরান আর ইসরায়েলও। আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ‘বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের’ দেশ হিসেবে বিবেচনা করলেও এদের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য আরব দেশগুলোর সাথে কমই। একটি সময় সাতটি দেশ নিয়ে তৈরি হয়েছিলো আরবলীগ, সময়ের সাথে জাতিরাষ্ট্র তৈরি হওয়ায় বেড়েছে আরবলীগের সদস্যসংখ্যা। বর্তমান সময়ে বাইশটি দেশ আরব লীগের সদস্য।
বিভিন্ন কারণেই মধ্যপ্রাচ্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, ঈসায়ী ধর্মগুলোর পবিত্র প্রার্থনালয়গুলো মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে রয়েছে ধর্মীয় মেলবন্ধনও। ভৌগলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য সুদূর অতীত থেকেই কাজ করেছে ইউরোপ আর এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সেতু হিসেবে, সুয়েজ খাল নির্মাণের পর এই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও। বিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তেলের খনি আবিষ্কার হওয়া শুরু হয়, বদলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি।
বিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করে, শুরু হয় জাতিরাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াতে বিংশ শতাব্দী জুড়ে বিভিন্ন সময়ে সংঘাতে জড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, সংঘাতের কারণ হয়েছে গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদও। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মধ্যপ্রাচ্য, পারস্পরিক সংঘাত আর হবসের প্রকৃতির রাজ্যের মতো অরাজক পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যকে দাঁড় করিয়েছে ভয়াবহ এক মানবিক সংকটের মধ্যে দিয়ে।
বর্তমান সময়ে আধুনিক মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক দূর্যোগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেন, গৃহযুদ্ধ হচ্ছে লিবিয়া আর সিরিয়াতে। সামরিক শাসনের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা আর ভিত্তি খুঁজে পেতে ক্রমাগত রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা বাড়ছে মিসরে, ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে পরিবর্তন হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ। কেন এতো সংঘাতপ্রবণ মধ্যপ্রাচ্য?
ধর্মীয় বিভাজন
প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মীয় পূণ্যস্থান হিসেবে পরিচিতি ছিল মধ্যপ্রাচ্য। গত শতাব্দীর সংঘাতের মূল জ্বালানি হয়ে ছিল পূণ্যস্থানের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রিক রাজনীতি। আরব দেশগুলোর সাথে ইজরায়েলের যুদ্ধ হয়েছে চারবার। যুদ্ধের বাইরেও অবৈধভাবে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দুই ধর্মের লোকেরা আদর্শিকভাবেই থেকেছে মুখোমুখি অবস্থানে, এই শতাব্দীতেও আদর্শিক শত্রুতা বিরাজ করছে দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে। এই বিভাজন মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো রাজনৈতিক সংঘাতের সূচনা করেছে।
ইসলাম আর ইহুদিবাদের এই বিরোধীতার বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের মধ্যেও রয়েছে ধর্মীয় বিভাজন। প্রাথমিকভাবে এই বিভাজন সুন্নি আর শিয়া মুসলমানদের মধ্যে। শিয়া আর সুন্নিদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন শুরু হয় হযরত মুহাম্মদ (স.) এর উত্তরসূরি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। রাসূল (স.) উত্তরসূরি হিসেবে সুন্নিদের সমর্থন পেয়েছেন হযরত আবু বকর (রা.), শিয়াদের দাবি ছিলো উত্তরসূরি হবেন হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রক্তের সম্পর্কের কেউ। সুন্নিরা যেখানে বৈধ শাসকদের প্রতি আকুণ্ঠ সমর্থনকে ধর্মীয় দায়িত্বের নিরিখে দেখে, শিয়ারা বিশ্বাস করে বারো ইমামের উপর। শিয়া আর সুন্নিদের মধ্যে বিভাজন আছে ইমাম মাহদীকে নিয়েও।
সুন্নি আর শিয়াদের বিভাজনে নতুন করে রসদ জুগিয়েছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার প্রতিযোগিতা। দুই দেশকে চাইছে ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে নিজেদের প্রভাব বলয়ে থাকা দেশের সংখ্যা বাড়াতে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ছোট ছোট সংঘাতগুলোকে তারা বড় করছেন আঞ্চলিক স্বার্থকে মাথায় রেখে। তবে, অর্থনৈতিক দূরাবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলরা আর যোদ্ধাদের হারানোর ঘটনাকে শুধু প্রথাগত ভূরাজনৈতিক স্বার্থ দিয়ে বিবেচনার সুযোগ নেই। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সুন্নি আর ইরানের নেতৃত্বাধীন শিয়ারা আসলে ইতিহাসে নিজেদের স্থান চান, কাজগুলোকে দেখতে চান ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার জায়গা থেকে।
সংঘাতের অভিজ্ঞতা
ধরুন, আপনি আপনার বন্ধুর সাথে কোনো রেস্টুরেন্টে পিৎজা খেতে গেছেন দুজনেই বিল ভাগাভাগি করে দেবার শর্তে। ৭ টুকরায় বিভক্ত একটি পিৎজা থেকে আপনারা দুইজনেই ৩ টুকরা করে খেলেন। এখন পিৎজার শেষ টুকরাটা কে খাবে, এই সমস্যাটা আপনারা তিনভাবে সমাধান করতে পারেন। আপনারা সংলাপের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসতে পারেন কে পিৎজার শেষ অংশটি খাবে, এক আরেকজনকে হুমকি দিয়ে পিৎজার অবশিষ্ট টুকরোটা ছিনিয়ে নিতে পারেন, আবার একজন আরেকজনকে ঘুষ দিতে পারেন পিৎজার অবশিষ্ট অংশের দাবি ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষে মানুষে মতভিন্নতা হয়েছে, ছিল আদর্শিক বিভাজন, ছিল স্বার্থের দ্বন্দ্বও। মানুষ এ সকল মতভিন্নতা সমাধানের জন্য উপরের তিনটি পথের যেকোনো একটিকে নির্বাচন করেছে। উদার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ধারণ করা অংশটি মতভিন্নতাগুলোকে সামনে রেখে সংলাপের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, কখনো সিদ্ধান্তকে নিজের পক্ষে এনেছে অর্থের ব্যবহার করে। আর রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ক অংশ মতভিন্নতাকে রূপ দিয়েছে সংঘাতে।
মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা যেকোনো মতভিন্নতায় দ্রুত সংঘাতের দিকে ধাবিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই ইহুদিরা ইজরায়েল প্রতিষ্ঠা করতে ফিলিস্তিনিদের উপর সন্ত্রাসী আক্রমণ চালাতে থাকে, উচ্ছেদ করতে থাকে বসতভিটা থেকে। ফলাফলে, ১৯৪৮ সালে হয় প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ। একই বছর ইয়েমেনে এক অভ্যুত্থানে প্রাণ হারায় হাজার চারেক মানুষ। ১৯৫৮ সালের লেবানন সংকটে মারা যায় কয়েক হাজার মানুষ, বিপ্লব দমন করতে সরকারি বাহিনীর হাতে মারা যায় কয়েকশত ইরাকি।
ষাটের দশকে শুরুতেই গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইয়েমেন, দশকব্যাপী চলা গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারায় লক্ষাধিক মানুষ। ষাটের দশকে বেশ কয়েকটি সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা হয়েছে সিরিয়া, ইরাকে, সহিংসতা কেড়ে নিয়েছে হাজারো মানুষের প্রাণ। সত্তরের দশকে এসে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে লেবানন, এক যুগের গৃহযুদ্ধে মারা যায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
১৯৭৯ সালে ইরানে উচ্ছেদ হয় রাজতন্ত্র, বিপ্লবে প্রাণ হারায় প্রায় ছয় হাজার মানুষ। আশির দশকের শেষদিকে এসে আবার গৃহযুদ্ধে জড়ায় দক্ষিন ইয়েমেন, এবার নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় পাঁচ অঙ্কের সংখ্যা। আশির দশকে যুদ্ধে জড়ায় দুই প্রতিবেশী দেশ ইরান ও ইরাক, যাতে প্রাণ হারায় দুই দেশের প্রায় বারো লাখ মানুষ। নব্বইয়ের দশকে আবারো যুদ্ধে জড়ায় ইরাক, দখল করে নেয় কুয়েত। পরাশক্তির হস্তক্ষেপে স্বাধীনতা ফিরে পায় কুয়েত, যুদ্ধে নিহত হয় প্রায় অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যে, আরব বসন্তের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে গৃহযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যার হিসাব রাখতে ক্লান্তি তৈরি করেছে পরিসংখ্যানবিবদদেরও।
সন্ত্রাসবাদ
মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা মতভিন্নতা আর জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত সংঘাতে জড়ালেও, পুরো বিংশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ তেমন প্রভাব বিস্তার করেনি। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ছিল আফ্রিকা, ইউরোপ বা এশিয়ার যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে কম। কঠোর সামাজিক জীবন আর স্বীয় গোত্রের মানুষের মধ্যে সহমর্মিতাই সন্ত্রাসবাদ বিস্তার করতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
ক্ষুদ্র পরিসরে যতোটুকু সন্ত্রাসবাদের উপস্থিতি ছিল, তা ছিল ফিলিস্তিন ইস্যুকে কেন্দ্র করে গরে উঠা সংগঠনগুলো। এই সমীকরণের বদলে যায় একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই। নাইন-ইলেভেনের ঘটনার আক্ষরিক অর্থে প্রতিশোধ নিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ’ শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু হয় ইরাকে আক্রমণের মধ্যে দিয়ে, ক্রমাগত যেটি ছড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে। আফগানিস্তান আর পাকিস্তানও শুরু হয় সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় মধ্যপ্রাচ্যে, লাখো মানুষ হারায় তাদের জীবিকার উৎস, ভেঙে পড়ে অর্থনীতি।
এরমধ্যে শুরু হয় আরব বসন্ত, রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো সহিংস রূপ নেয় আঞ্চলিক আর বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক খেলায়। সিরিয়াতে সরকারবিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে, ইয়েমেনের সরকারবিরোধী আন্দোলন গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে সৌদি আরব আর ইরানের প্রভাব বিস্তারের ছায়াযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। মিসরের নতুন স্বৈরশাসক জেনারেল সিসির আমলে ক্রমাগত বাড়ছে রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা, বাড়ছে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষের সংখ্যাও।
সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধ আর আরব বসন্ত পুরোপুরিভাবে ভেঙে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সামাজিক কাঠামো, জীবন আর জীবিকার ব্যাপারে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। ফলে, এই ঘটনাগুলোর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, সভ্যতার সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। জীবিকার সন্ধান আর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাড়না পরবর্তীতে মানুষকে ধাবিত করেছে সংঘাতের পথ বেঁছে নিতে, সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িয়ে যেতে। এই রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক সমীকরণ কাজে লাগিয়েছে সন্ত্রাসবাদী কিছু সংগঠন, সন্ত্রাসবাদ বিস্তারে ভূমিকা ছিল পরাশক্তিগুলোর যুদ্ধ অর্থনীতিও।
মধ্যপ্রাচ্যে গত কয়েক দশকে প্রভাবশালী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট, নিজস্ব যোদ্ধা নিয়োগ করেছিল মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশে। ওসামা-বিন-লাদেনের মৃত্যুর পর গত দশকে আল-কায়েদার প্রভাব কমে আসে, তৈরি হওয়া ভ্যাক্যুয়াম পূরণ করে আইএস। নিজেদের দখলে নিয়ে আসে ইরাক আর সিরিয়ার বিশাল ভূখণ্ড, প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের রাষ্ট্র। ইরাকে প্রভাব বিস্তার করেছে আনসার আল-ইসলাম, জামায়াতে আনসার আল-সুন্না, তওহীদ ও জিহাদ নামের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। সন্ত্রাসী সংগঠনের আবাসভূমি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃণ মরুভূমি, তাদের সাংগঠনিক শক্তি জুগিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের নিজেদের বঞ্চিত মনে করার ভাবনা। তালেবান, হিজবুল্লাহ, হামাসের মতো সংগঠনগুলোর ব্যাপারে রাষ্ট্রগুলো যেমন বিভক্ত, বিভক্ত মতামত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এরা যে মধ্যপ্রাচ্যকে সংঘাতের বৃত্তে আটকে রাখছে।
এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বাইরেও বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দায় আছে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত বিস্তারে। জায়োনিজমকে রাষ্ট্রীয় রূপ দিতে গত শতাব্দীতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, বিভিন্ন দেশে সংঘাত বিস্তারে ভূমিকা আছে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা আর রেভ্যুলুশনারি গার্ডেরও।
পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা
ধর্মীয় কারণের বাইরেও সুদূর অতীতকাল থেকেই ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে ভূমিকা রেখেছে মধ্যপ্রাচ্য, সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করেছে ইউরোপ আর এশিয়ার বণিকদের মধ্যে। ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উত্থানের সময়কালে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব কমে গেলেও সুয়েজ খাল নির্মাণের পর আবারো বৃদ্ধি পায় মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব। বিংশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তেলের খনি আবিষ্কৃত হওয়া শুরু হয়, ভূমিকা রাখে কয়লার ইঞ্জিন থেকে পেট্রোলচালিত ইঞ্জনে যন্ত্রের জগতের বিবর্তনে। বর্তমান সময়েও মধ্যপ্রাচ্যে যেসব কারণে পরাশক্তিগুলো এসে সংঘাতে জড়ায়, তার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে থাকে তেল অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে নিজেদের স্বার্থ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মধ্যপ্রাচ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের লড়াই চালিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। বর্তমান সময়ে এই প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যে, প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় আবির্ভূত হয়েছে চীন, ইরান, তুরস্কের মতো দেশগুলোও। এই আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে উস্কে দেয় সংঘাত, সংঘাত জিইয়ে রেখে আদায় করে নেয় নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ।
সাম্প্রতিক সময়ের সিরিয়া এবং ইয়েমেন সংকটকে সামনে রেখে সংঘাত তৈরিতে পরাশক্তিগুলোর ভূমিকার একটি ক্লাসিক উদাহরণ। সিরিয়াতে সরকার পরিবর্তনের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন রূপ নিইয়েছে দশকের অন্যতম ভয়াবহতম গৃহযুদ্ধে। শিয়া আর সুন্নিদের বিভাজন হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এই সংঘাতে আসাদ সরকারকে বাঁচাতে সামরিক আর অর্থনৈতিক সহযোগিতা আসে রাশিয়া, ইরান, ইরাকের মতো দেশগুলো থেকে। বিপরীতে বিদ্রোহীদের সহায়তা দেয় তুর্কি, কাতার, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো থেকে। পরাশক্তিগুলোর সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ এই সংঘাতে জড়িয়ে যাওয়া নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘায়িত করেছে সংঘাতকে, বাড়িয়েছে মানুষের দূর্ভোগ, দূর্দশা আর মৃত্যুর সংখ্যা। একই রকমভাবে স্বজন হারানো মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ইয়েমেনে, তৈরি হয়েছে দূর্ভিক্ষের সম্ভাবনা।
সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসা
দীর্ঘ সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যের লাখো মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা হারিয়েছেন, লাখো শিশু বঞ্চিত হয়েছে বেড়ে উঠার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ থেকে। ভবিষ্যতের প্রজন্মকে এই সীমাহীন দূর্ভোগের চক্রে আবদ্ধ করতে না চাইলে সংঘাতের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষকে। পরিপক্ক রাজনৈতিক সংঘাতের মানুষ হলে আপনি যেমন আপনার বন্ধুর সাথে পিৎজা নিয়ে দ্বন্দ্বে সমাধান করবেন সংলাপের মাধ্যমে, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষকেও শিখতে হবে দ্বন্দ্ব সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের প্রক্রিয়া। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সেরকম কিছু রাজনৈতিক সংগঠন আছে, যারা ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যকে সংঘাত থেকে মুক্তি পথ দেখাতে পারে।