পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহতম যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রায় ছয় বছরব্যাপী পুরো পৃথিবীকে নরক বানিয়ে রেখেছিল এই যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্রের মতো ভয়াবহ অস্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে এর।
এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণকে চিহ্নিত করা হলেও এর পেছনে অনেকগুলো পরোক্ষ কারণ বিদ্যমান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির মাধ্যমেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দুই দশক বিভিন্ন ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট হাজির করে।
১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তি থেকে ১৯৩৯ সালের জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যবর্তী কয়েকটি ঘটনাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পেছনের অনেকগুলো পরোক্ষ কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে, ১৯৩৮ সালে ইউরোপের চার পরাশক্তির (ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি) মধ্যে হওয়া মিউনিখ এগ্রিমেন্ট।
কী ছিল এই মিউনিখ চুক্তি, এর পটভূমিই বা কী ছিল এবং কীভাবেই বা এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পেছনে ভূমিকা রেখেছিল?
১৯৩০ এর দশক ছিল ইউরোপীয় রাজনীতির যুগান্তকারী সময়। এ সময় ইউরোপের রাজনীতিতে দ্রুত পটপরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে ক্ষমতায় আসে উগ্র নাৎসিরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর হয় তারা। নাৎসিদের নেতৃত্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক দুঃসময় কাটিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক সাফল্যও লাভ করে দেশটি।
১৯৩৮ সাল, মহাযুদ্ধের পূর্ববর্তী বছর। একটি বড় ধরনের যুদ্ধের অধিকাংশ লক্ষণ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। বছর দুয়েক পূর্বেই ১৯৩৬ সালে জার্মানি ও জাপান ‘এন্টি-কমিন্টার্ন’ তথা সোভিয়েত বিরোধী জোট গঠন করেছে। সেই জোটে আবার ইতালিও যোগ দিয়েছে। কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানে পুঁজিবাদী দেশগুলো আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্তার ঠেকাতে পশ্চিমারা একত্রিত হতে থাকে। এদিকে জার্মানিও নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য উতলা হয়ে ওঠে।
বিশ্ব বিজয়ের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নাৎসিরা অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্তিকরণের পরিকল্পনা করে। জার্মানির আশেপাশে অবস্থিত জার্মান ভাষাভাষী অঞ্চলগুলো নিয়ে বৃহত্তর জার্মানি গঠনে উদগ্রীব হয়ে ওঠে নাৎসিরা। অস্ট্রিয়া ছিল জার্মানি ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের মধ্যে সেতুর মতো। অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ বিজয়ের সম্ভাবনা দেখে নাৎসিরা। এছাড়া অস্ট্রিয়াকে সংযুক্তির মাধ্যমে পশ্চিমাদের বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন হিটলার।
১৯১৯ সালের ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার একত্রিকরণ নিষিদ্ধ ছিল। জার্মানি চেয়েছিল অস্ট্রিয়াকে সংযুক্তিকরণের পর পরাশক্তিদের প্রতিক্রিয়া দেখে পরবর্তী কৌশল অবলম্বন করতে। যেই কথা সেই কাজ! ১৯৩৮ সালের ১২ মার্চ জার্মানি ভার্সাই চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে অস্ট্রিয়াকে সংযুক্ত করে নেয়।
অস্ট্রিয়াকে সংযুক্তিকরণের পর পরাশক্তিগুলো একটু নিন্দা ছাড়া বড় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। পরাশক্তিগুলোর নীরবতা নাৎসিদের বেপরোয়া হতে সহযোগিতা করে। অস্ট্রিয়ার সংযুক্তিকরণের ফলে জার্মানির সামরিক শক্তি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি বাস্তবক্ষেত্রে তাদের অবস্থানও শক্ত হয়েছে।
নাৎসিরা এবার চেকোস্লোভাকিয়ায় অবস্থিত জার্মান ভূখন্ডের দিকে নজর দেয়। চেকোস্লোভাকিয়ার সীমান্তবর্তী বড় একটা অঞ্চল ছিল জার্মান ভাষাভাষী। চেকোস্লোভাকিয়ার উত্তরাঞ্চল সুডেনল্যান্ড নামে পরিচিত, যার অধিকাংশ বাসিন্দা জাতিগত জার্মান। নাৎসিরা এই অঞ্চলকে জার্মানির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে। নাৎসিরা এই ভূখন্ডকে জার্মানির সঙ্গে একত্রিকরণের জন্য উঠেপড়ে লাগে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য ভেঙে চেকোস্লোভাকিয়ার সৃষ্টি হয়। তখন নৃতাত্ত্বিকভাবে জার্মান সুডেনল্যান্ড অঞ্চলকে চেকোস্লোভাকিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেখানে ৩০ লক্ষাধিক জার্মান বসবাস করতো।
১৯৩৩ সালে জার্মানিতে নাৎসিদের ক্ষমতা গ্রহণের পর, তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সুডেনল্যান্ডের জার্মানদের মধ্যে বৃহত্তর জার্মান জাতীয়তাবাদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেই সঙ্গে নাৎসিরা সুডেনল্যান্ডে মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলে। নাৎসিরা সুডেনল্যান্ডের মিলিশিয়া বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহযোগিতা করে। সুডেনল্যান্ডকে বৃহত্তর জার্মানির সঙ্গে একত্রিকরণের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৩৩ সালে সুডেনল্যান্ড জার্মান পার্টি (SDP) গঠিত হয়। এসডিপি ছিল মূলত নাৎসি পার্টির একটি শাখা। সুডেনল্যান্ডের জার্মানদের কাছে এসডিপি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
গঠনের পর থেকেই দলটি সুডেনল্যান্ডকে জার্মানির নিয়ন্ত্রণে আনতে চেষ্টা চালাতে থাকে। জার্মানি ও চেকোস্লোভাকিয়া উভয় দেশের কাছে সুডেনল্যান্ড ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ পরিপূর্ণ ও শিল্পোন্নত সুডেনল্যান্ডের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। নাৎসিরা জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলে মনোনিবেশ করে এবং হিটলার তার সেনাপতিদেরকে সুডেনল্যান্ডে আগ্রাসনের পরিকল্পনা শুরু করার নির্দেশ দেন।
হিটলার সুডেনল্যান্ড জার্মান পার্টির নেতা কোনারাদ হেনলিনকে সেখানে কৌশলে অস্থিরতা তৈরি করার নির্দেশ দেন। হিটলার চেয়েছিলেন হেনলিনের সমর্থকরা যেন সুডেনল্যান্ডে অস্থিরতা তৈরি করে, যাতে এই অজুহাতে জার্মান সেনাবাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে সুডেনল্যান্ড দখল করে নিতে পারে যে, চেকোস্লোভাকিয়ান সরকার এই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম।
হেনলিনের অনুসারীরা সুডেনল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায়। হিটলারের নির্দেশে সুডেনল্যান্ডে অবস্থিত নাৎসিদের অনুসারী মিলিশিয়া বাহিনী সেখানে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি করে। জবাবে চেকোস্লাভ সরকার সুডেনল্যান্ডে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে এবং সেখানে সামরিক আইন জারি করে। একপর্যায়ে সুডেনল্যান্ডে দাঙ্গা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে হিটলারের নির্দেশে জার্মান বাহিনী চেকোস্লোভাকিয়া সীমান্তে জড়ো হয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
১৯৩৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জার্মানির ন্যুরেমবার্গ শহরে নাৎসি পার্টির এক সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে হিটলার সুডেন সংকট নিয়ে চেকোস্লোভাক সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। হিটলার চেকোস্লোভাক সরকারকে সুডেনল্যান্ডের জার্মানদের ধীরে ধীরে নির্মূল করতে চাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, জার্মানি সুডেনল্যান্ডের জার্মানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করবে, সেই সঙ্গে হিটলার সুডেনল্যান্ডকে জার্মানির কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান।
সংকট বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধের ভয় ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আগ্রহী হয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স উভয় দেশ ইউরোপে নতুন কোনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না এবং যেকোনো মূল্যে ইউরোপে একটি যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত তখনও শুকায়নি, এমন সময় নতুন কোনো যুদ্ধ ব্রিটেন ও ফ্রান্স চায়নি।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় তিনি একটি বৈঠকের অনুরোধ জানিয়ে হিটলারকে টেলিগ্রাম পাঠান। ১৯৩৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে জার্মানি গমন করেন। উক্ত বৈঠকে হিটলার দাবি করেন, চেকোস্লোভাকিয়া সরকার সুডেনল্যান্ডের জার্মানদের উপর অত্যাচার করছে, সেই সঙ্গে হিটলার সুডেনল্যান্ডকে জার্মানির কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান।
স্বাভাবিকভাবেই হিটলারের এমন দাবি চেম্বারলিন তৎক্ষণাৎ মেনে নিতে পারেন না, এর জন্য তাকে লন্ডনে মন্ত্রিসভার সঙ্গে বৈঠক করতে হবে। চেম্বারলিন হিটলারের কাছ থেকে কয়েকদিনের সময় নেন এবং এই সময়ের মধ্যে হিটলারকে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন। হিটলার এই সময়ের মধ্যে কোনো সামরিক অভিযান না করতে রাজি হলেও তিনি তার জেনারেলদের নিয়ে সামরিক পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন।
চেম্বারলিন লন্ডনে ফিরে এসে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক ডাকেন। মন্ত্রিসভা সুডেনল্যান্ডের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ফরাসি সরকারের সাথে যোগাযোগ করলে ফরাসি সরকারও চেম্বারলিনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায়।
১৯৩৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ও ফরাসি রাষ্ট্রদূতরা চেকোস্লোভাক সরকারের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সুডেনল্যান্ডের যে অঞ্চলগুলোতে ৫০ শতাংশের বেশি জার্মান জনসংখ্যা বাস করে সেই অঞ্চলগুলো ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। মিত্রদের কাছ থেকে সমর্থন না পেয়ে চেকোস্লোভাক সরকারকে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের এমন সিদ্ধান্ত না চাওয়া সত্ত্বেও চেকোস্লোভাক সরকার মানতে বাধ্য হয়।
চেকোস্লোভাক সরকারের কাছ থেকে সমর্থন পেয়ে ২২ সেপ্টেম্বর চেম্বারলিন জার্মানিতে গিয়ে পুনরায় হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একটি সমাধানে পৌঁছাতে পেরেছেন বলে আশাবাদী ছিলেন চেম্বারলিন, কিন্তু সেখানে হিটলারের নতুন দাবি শুনে হতবাক হয়ে যান। হিটলার দাবি করেন, সুডেনল্যান্ডকে পুরোপুরিভাবে অধিকারের জন্য জার্মান সেনাবাহিনীকে অনুমতি দিতে হবে। সেই সঙ্গে সুডেনল্যান্ডে বসবাসরত অ-জার্মানদের সেখান থেকে বহিষ্কার করতে হবে। তিনি আরো দাবি করেন, চেকোস্লোভাকিয়ার অন্তর্ভুক্ত পোলিশ ও হাঙ্গেরিয়ান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে যথাক্রমে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এরপর চেম্বারলিন লন্ডনে ফিরে আসেন।
হিটলার ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টার মধ্যে জার্মানির কাছে সুডেনল্যান্ডকে হস্তান্তরের সময়সীমা বেধে দেন, অন্যথায় যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়ার হুমকি দেন। পরবর্তীতে ইতালির মুসোলিনির অনুরোধে হিটলার সময়সীমা ১ অক্টোবর নির্ধারণ করেন।
পরবর্তী সময়ে হিটলার চেম্বারলিনকে চিঠি লেখেন এই আশ্বাস দিয়ে যে, যদি সুডেনল্যান্ডকে জার্মানির হাতে তুলে দেওয়া হয় তবে তিনি চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করবেন না। সেই সঙ্গে তিনি আশ্বস্ত করেন যে এটাই জার্মানির সর্বশেষ অঞ্চল দাবি। চেম্বারলিন আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এবার তিনি একা নন, বরং ফরাসি ও ইতালিয়ান নেতাদের নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী হন। সমস্যা সমাধানে চেম্বারলিন ইতালিয়ান নেতা বেনিতো মুসোলিনির সহায়তা চান।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইতালির মধ্যে একটি শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তাব করেন। তবে এই আলোচনা যাকে নিয়ে, সেই চেকোস্লোভাকিয়াকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এই আলোচনায় আরেক ইউরোপীয় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ২৯ সেপ্টেম্বর সম্মেলনের দিন ধার্য করা হয়। সেদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন, জার্মান নেতা হিটলার, ইতালিয়ান নেতা মুসোলিনি ও ফরাসি প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ের জার্মানির মিউনিখ শহরে মিলিত হন।
আলোচনায় মুসোলিনি একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন, যাতে জার্মানির সম্প্রসারণ নীতির অবসানের বিনিময়ে সুডেনল্যান্ডকে জার্মানির কাছে সমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়। এই প্রস্তাব মুসোলিনির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলেও এটি মূলত জার্মান সরকার তৈরি করেছিল। যেকোনো মূল্যে একটি বড় ধরনের যুদ্ধ এড়াতে আগ্রহী চেম্বারলিন ও দালাদিয়ের মুসোলিনির এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। সেদিন রাত প্রায় ২টার সময় (৩০ সেপ্টেম্বর) মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ব্রিটিশ সরকারের অনেকে এই চুক্তিতে সন্তুষ্ট হলেও একটি অংশ এই চুক্তির ফলাফল নিয়ে সন্দিহান ছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই ভেবে সন্তুষ্ট হন যে, তারা একটি যুদ্ধ এড়াতে পেরেছেন। অনেক ব্রিটিশ নেতা এই চুক্তির তীব্র সমালোচনা করেন। হিটলার এটা দেখে আশ্চর্য হন যে, তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য চেকোস্লোভাকিয়ার মিত্ররা সহজেই সুডেনল্যান্ডকে জার্মানির হাতে তুলে দিয়েছে, অথচ তিনি ভেবেছিলেন সুডেনল্যান্ড অধিকারের জন্য জার্মানিকে যুদ্ধ করতে হবে। হিটলার যা চান তার সবই মিউনিখ চুক্তি তাকে দিয়েছিল।
সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন এই চুক্তিতে হতাশ হন। এই চুক্তির ফলে ইঙ্গ-ফরাসি জোটের উপর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্বাস উঠে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবার নতুন পরিকল্পনা সাজাতে থাকে। একপর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইঙ্গ-ফরাসি জোটকে প্রতিহত করতে জার্মানির সঙ্গে চুক্তি করে। এই চুক্তির ফলস্বরূপ, জার্মান বাহিনী ১ অক্টোবর সীমান্ত অতিক্রম করে এবং সুডেনল্যান্ডের জার্মানরা তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। বিপরীতে অনেক চেকোস্লোভাকিয়ান এই অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে যায়।
যদিও সাময়িকভাবে একটি যুদ্ধ এড়াতে পেরেছে, তথাপি এই চুক্তি ছিল ইঙ্গ-ফরাসি জোটের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল। ইঙ্গ-ফরাসি জোট জার্মানির চেয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ে বেশি ভীত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরোধ করতে তারা জার্মানিকে লেলিয়ে দিতে চেয়েছিল। পূর্ব ইউরোপে জার্মান সম্প্রসারণ নিয়ে ইঙ্গ-ফরাসি জোট খুব বেশি উদ্বিগ্ন ছিল না। ইঙ্গ-ফরাসি জোট চেয়েছিল জার্মানি যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করতে গিয়ে ইঙ্গ-ফরাসি জোট জার্মানিকে অপ্রতিরোধ্য ও বেপরোয়া করে তোলে।
ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যুদ্ধভীতিকে পুঁজি করে জার্মানি ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে হিটলার নাকে দড়ি দিয়ে কয়েক বছর ঘোরান। মিউনিখ চুক্তিতে জার্মানি যদিও চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়, তথাপি চুক্তির ছয় মাস যেতে না যেতেই ১৯৩৯ সালের মার্চে জার্মানি বাদবাকি চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে দখল করে নেয়। এই আক্রমণেও ইঙ্গ-ফরাসি জোট উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
জার্মানির সম্প্রসারণ নীতির পরবর্তী সম্ভাব্য লক্ষ্য ছিল পোল্যান্ড। ইঙ্গ-ফরাসি জোট এবার পোল্যান্ডের স্বাধীনতা অক্ষত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জোট গঠন করে। তবে জার্মানি কি থামার পাত্র! ইঙ্গ-ফরাসি জোট ইতোমধ্যে জার্মানিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। ইঙ্গ-ফরাসি জোট কর্তৃক এতদিন ধরে জার্মানিকে দেওয়া প্রশ্রয়ের ফলস্বরূপ ১৯৩৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এর মাধ্যমেই শুরু হয় রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। এই ঘটনা ঘটে মিউনিখ চুক্তির এক বছর পূর্তি হওয়ার আগেই!
ইঙ্গ-ফরাসি জোট যদি মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে এতটা সুযোগ না দিত, তবে জার্মানি এতটা বেপরোয়া হতে সাহস করত না। শুরুতেই যদি জার্মানির লাগাম ধরে টান দেওয়া হতো, তবে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। ইঙ্গ-ফরাসি জোটের ব্যর্থতার ফলেই জার্মানি বেপরোয়া ও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। এজন্য ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।