ইরান ক্যাবল (৮): আমেরিকান আগ্রাসন যেভাবে ইরাককে ইরানের হাতে তুলে দিয়েছে

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার গোপন ইরানি ডকুমেন্টে উপর সংবাদ মাধ্যম ইন্টারসেপ্ট পাঁচ পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে ইরাকে ইরানের রহস্যময় ভূমিকার অনেক গোপন তথ্য। ইন্টারসেপ্টের এই ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করেই আমাদের এই ইরান ক্যাবলসিরিজ

আজ পড়ুন সিরিজের অষ্টম এবং সর্বশেষ পর্ব। পূর্ববর্তী পর্বগুলো পড়ুন এখান থেকে: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব৩য় পর্ব৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব

ইন্টারসেপ্টের ওয়েবসাইটে ফাঁস হওয়া নথিগুলো নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন; Image Source: https://theintercept.com/

২০০৩ সালের মার্চ মাসে আমেরিকার ইরাক আক্রমণের প্রায় একমাস আগে সাদ্দাম হুসেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের একজন, তারেক আজিজ, তার বাগদাদের অফিসে বসেছিলেন। তার পরনে ছিল জলপাই রঙের ইউনিফর্ম, পায়ে ছিল চপ্পল আর হাতে ছিল একটা সিগার। কয়েক দশক ধরে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ইরাকি কূটনীতির সম্মুখভাগে দায়িত্ব পালন করা তারেক আজিজ সেদিন ইরাকের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ জানিয়েছিলেন। এই বিশ্লেষণই হয়তো পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

“আমেরিকা সাদ্দাম হুসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে”, বলেছিলেন তারেক আজিজ, এক ইরাকি খ্রিস্টান এবং সাদ্দাম হুসেনের সরকারের সবচেয়ে সিনিয়র ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। “আপনারা বাথ পার্টিকে এবং সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করে দিতে পারেন।” কিন্তু সেইসাথে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্য দিয়ে “আমেরিকা একটা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেবে, যা তারা আর কখনোই বন্ধ করতে পারবে না।” তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, আরব জাতীয়তাবাদের আড়ালে সাদ্দামের বজ্রমুষ্টির শাসনব্যবস্থাই কেবল পারে আল-কায়েদার মতো শক্তিগুলোকে কিংবা ইরানের প্রভাবকে মোকাবেলা করতে।

একমাস পর আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করে, তখন তারেক আজিজ ছিলেন আমেরিকার মোস্ট ওয়ান্টেড টার্গেটদের ছবি প্রচার করার জন্য পেন্টাগনের তৈরী তাসের ডেকের ইশকাপনের আট। শেষপর্যন্ত তিনি যখন ধরা পড়েন, তখন তাকে রাখা হয় বাগদাদ বিমানবন্দরে অবস্থিত অস্থায়ী একটা কারাগারে। তাকে বাধ্য করা হয় শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নিজের হাতে মাটিতে একটি গর্ত খুঁড়তে। বন্দী অবস্থাতেই ২০১৫ সালের জুন মাসে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর আগেই তিনি দেখে যেতে পেরেছিলেন, কীভাবে তার প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে “ইরাককে নেকড়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার” অভিযোগ করেছিলেন।

তারেক আজিজ, ১৯৯৮ সালে; Image Source: Peter Dejong/AP

২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসন ছিল এমন একটা মুহূর্ত, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের রক্তাক্ত দাবার ঘুঁটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আমেরিকান আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলতা ইরানকে ইরাকের উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেয়, সাদ্দামের শাসনামলে যা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। ইরানের মিনিস্ট্রি অভ ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির ফাঁস হওয়া গোপন ডকুমেন্টগুলো বর্তমান ইরাকের উপর ইরানের গভীর প্রভাবের চিত্রই তুলে ধরে। যে সার্বভৌমত্বকে একসময় আরব জাতীয়তাবাদ গর্বের সাথে রক্ষা করে আসছিল, মার্কিন আগ্রাসনের পর তা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। 

যে দেশটির নিয়ন্ত্রণ ইরান গ্রহণ করে, কয়েক দশকের যুদ্ধ, সামরিক দখলদারিত্ব, সন্ত্রাসবাদ এবং অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে সেই দেশ এমনিতেই ভেঙে পড়েছিল। আজও ইরাক সাম্প্রদায়িক রক্তপাত, সহিংস জিহাদি দলের উত্থান এবং মার্কিন আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের ফলে সৃষ্ট সীমাহীন দুর্নীতির ফল ভোগ করছে। এই জাতীয় দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে অনেক ইরাকিই এখন সাদ্দামের কর্তৃত্ববাদী শাসনামলের স্থিতিশীলতার প্রতি স্মৃতিকাতরতা অনুভব করছেন।

২০০৩ সালের ইরাক আগ্রাসনের পরবর্তী বছরগুলোতে অনেক মার্কিন রাজনীতিবিদ ইরাকে তাদের দীর্ঘকালীন দখলদারিত্বের পক্ষে যুক্তি দেখানোর জন্য ‘Pottery Barn’ উপমা ব্যবহার করেন। এ উপমা অনুযায়ী, যেহেতু মার্কিন আগ্রাসনের ফলেই ইরাকের সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, তাই এখন একে কিনে নেওয়ার তথা একে ঠিক করার দায়িত্বও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই। কিন্তু বাস্তবে আমেরিকা ইরাককে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যায়। শেষপর্যন্ত ইরাকের এই বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোর দায়িত্ব এসে পড়ে ইরানের কাঁধে।

ডিবাথিফিকেশনের বিপর্যয়

জর্জ ডব্লিউ বুশের ইরাক আক্রমণের এক দশকেরও কিছু আগে তার বাবা জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন ইরাকের ব্যাপারে কিছুটা ভিন্ন পথ গ্রহণ করেছিল। ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে বিমান হামলার মাধ্যমে ইরাকের সামরিক এবং বেসামরিক অবকাঠামো নির্মমভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার পর সিনিয়র বুশ এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, বাগদাদে সেনাবাহিনী পাঠানো খুবই বিপজ্জনক হবে। না, সম্ভাব্য প্রাণহানির কিংবা মার্কিন সৈন্যদের মৃত্যুর কথা ভেবে তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন না। তিনি চিন্তিত ছিলেন ইরানকে নিয়ে।

সাদ্দাম হুসেন ছিলেন আমেরিকার পরিচিত, যিনি আশির দশকে ইরানের উপর আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে আমেরিকানদের কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। আট বছর ধরে চলা সেই ইরাক-ইরান যুদ্ধে আমেরিকা উভয় পক্ষকেই অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল, কিন্তু বাগদাদের প্রতি তাদের সাহায্য ছিল অনেক বেশি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় খোঁড়া ট্রেঞ্চগুলোর মধ্যে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলিতে সেই যুদ্ধে ১ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। ঐ যুদ্ধে মার্কিন নীতি কী ছিল, তা প্রকাশ পায় হেনরি কিসিঞ্জারের একটি বাক্যের মধ্য দিয়ে। তিনি বলেছিলেন,

“এটি খুবই হতাশার কথা যে, যুদ্ধে কেবলমাত্র একটা পক্ষ পরাজিত হয়।”

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও আমেরিকানদের ইরানভীতি তাদের ইরাকের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ইচ্ছাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। ফলে সে সময় সাদ্দামকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়নি।

২০০৩ সালের মার্চের ২৯ তারিখে বসরা শহরে মার্কিন ট্যাঙ্ক; Image Source: Spencer Platt/Getty Images

কিন্তু বুশের পুত্র ব্যাপারটাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের পর তার প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকে সাদ্দামের সাথে আল-কায়েদার সম্পর্কের ব্যাপারে মিথ্যা অভিযোগ তুলতে শুরু করে। বাস্তবে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা ছিল বাথিস্টদের চরম শত্রু। কিন্তু নিও-কনজার্ভেটিভদের দ্বারা ততদিনে সাদ্দামকে অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল, যারা ৯/১১-এরও আগে থেকে যুদ্ধের পক্ষে অনড় অবস্থান প্রকাশ করে আসছিল।

২০০৩ সালের আগ্রাসনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সাদ্দাম ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েন এবং আত্মগোপনে চলে যান। তার স্থলে ইরাকের দায়িত্ব দেওয়া হয় এক ডানপন্থী ভাবাদর্শীকে, যিনি এর আগে হেনরি কিসিঞ্জারের অধীনে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। লেফটেন্যান্ট পল ব্রেমার নামের ইরাকের এই নতুন ‘ভাইসরয়’ নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, তিনি হচ্ছেন “সাদ্দামের বাইরে ইরাকের একমাত্র সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীন ব্যক্তি, যাকে অধিকাংশ ইরাকি চেনে।”

যদিও পল ব্রেমার কূটনীতিবিদ হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছিলেন, কিন্তু তিনি এর আগে কখনও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যাননি। ইরাকি রাজনীতির উপরেও তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু তাকে এই ধারণা পেয়ে বসে যে, বাথ পার্টি হচ্ছে জার্মানির নাৎসি পার্টির মতো এবং একে পুরোপুরি নির্মূল করা প্রয়োজন। তার নেতৃত্বেই আমেরিকা আধুনিক বিশ্বের যুদ্ধপরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইতিহাসের সবচেয়ে বিপর্যয়মূলক নীতিটা কার্যকর করে। তারা ‘ডিবাথিফিকেশন’ প্রক্রিয়ার নামে ইরাকি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।

২০০৩ সালের অক্টোবরে ইরাকের কিরকুশে পল ব্রেমার; Image Source: Marwan Naamani/AFP via Getty Images

পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী পরলোকগত সাংবাদিক অ্যান্থনি শাদিদ ইরাক যুদ্ধের উপর রচিত তার বই ‘Night Draws Near’-এ লিখেছিলেন,

“ব্রেমারের এই সিদ্ধান্তের ফলাফল ছিল, তা সাড়ে তিন লাখ ইরাকি অফিসার এবং সৈন্যকে রাস্তায় বসিয়ে দেয়। এই লোকগুলোর প্রত্যেকের কিছু না কিছু সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল। ফলে, মুহূর্তের মধ্যে গেরিলা যুদ্ধের জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীর এক বিশাল ভাণ্ডার তৈরি হয়ে যায়। (তাদের দখলে এবং নাগালের মধ্যে ছিল প্রায় এক মিলিয়ন টন অস্ত্র এবং সবধরনের গোলাবারুদ।)”

সে সময় নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন,

“সে সপ্তাহেই আমরা ইরাকের মাটিতে সাড়ে চার লাখ নতুন শত্রু সৃষ্টি করেছিলাম।”

ব্রেমারের সিদ্ধান্তের প্রভাব উপলব্ধি করা যায় এক দশকেরও পরে লেখা এবং পরবর্তী সময়ে ফাঁস হওয়া ইরানি নথিগুলো থেকে। ২০১৩ সালে ইরাকের নুরি আল-মালিকি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়া অধিকাংশ সুন্নি বিদ্রোহীকেই নথিগুলোতে ‘বাথিস্ট’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাথিস্ট বলতে সেখানে সে দলগুলোকে বোঝানো হয়েছে, যাদের নেতৃত্ব ছিল সাবেক ইরাকি সেনা কর্মকর্তাদের হাতে, যারা ২০০৩ সালের পূর্ববর্তী ইরাকি ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী ছিল।

নথিগুলো থেকে দেখা যায়, মার্কিন আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে ইরাকে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয়েছিল, তা কখনোই শেষ হয়নি। বাথ পার্টির আদর্শে বিশ্বাসী অনেকেই শেষপর্যন্ত আইসিসে যোগ দিয়েছিল, যে সংগঠনটির সামরিক নেতৃত্বে সাদ্দামের সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

২০০৩ সালের এপ্রিলে তিক্রিতে এক ইরাকি বাথ পার্টির কমান্ডারকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে মার্কিন বাহিনী; Image Source: Saurabh Das/AP; Jerome Delay/AP

আমেরিকার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি

ডিবাথিফিকেশনের সাথে সাথে ইরাকে আরেকটি কদর্য ঘটনার বিস্তার ঘটছিল। তা হলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। এবং এর পেছনেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আগ্রাসনের পরপরই মার্কিন দখলদার বাহিনী ইরাকের এক শিয়া ধর্মীয় নেতা মুক্তাদা আল-সাদরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করে।

মুক্তাদা আল-সাদর ছিলেন একজন ইরাকি জাতীয়তাবাদী, যার বাবা এবং ভাইকে সাদ্দাম হুসেনের গুণ্ডারা হত্যা করেছিল। সাদর জনগণের মনের ভাষা পড়তে পারতেন, কিন্তু প্রায় সময়ই তার সাথে অন্যান্য শিয়া ধর্মীয় নেতাদের মতবিরোধ সৃষ্টি হতো। ২০১৪ সালে তৈরি কিছু ফাঁস হওয়া নথিপত্র থেকে দেখা যায়, ইরাকে অবস্থিত ইরানপন্থী কর্মকর্তারা সাদরের প্রতি তাদের হতাশা ব্যক্ত করছেন এ কারণে যে, তিনি ইরানের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে রাজি হচ্ছেন না। যদিও সাদর ইরানে পড়াশোনা করেছিলেন এবং বহু বছর ইরানে বসবাস করেছিলেন, তবুও আজও তিনি ইরাক সরকারের এবং ইরানের স্বার্থের জন্য পথের কাঁটা হয়ে আছেন।

মার্কিন আগ্রাসনের পর ইরাকি জনগণের দুর্দশা দূর করার জন্য মুক্তাদা আল-সাদর সামাজিক সেবা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম শুরু করেন। বিশেষ করে তিনি কাজ শুরু করেন শিয়া বস্তিগুলোতে, যেগুলো সাদ্দামের আমলে ভয়ঙ্করভাবে অবহেলিত ছিল। ফলে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে ৪ জন ব্ল্যাকওয়াটার মার্সেনারির হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকা যখন প্রথম ইরাকের সুন্নিপ্রধান শহর ফাল্লুজা আক্রমণ করে, তখন মুক্তাদা আল-সাদর রক্তদান কর্মসূচী শুরু করেন, গাড়িভর্তি সাহায্য পাঠান এবং আমেরিকান আগ্রাসনের নিন্দা জানান। সে সময় খুব স্বল্প সময়ের জন্য আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরাকের শিয়া এবং সুন্নি সম্প্রদায় তাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে একত্র হয়ে উঠেছিল।

২০০৩ সালের জুলাইয়ে কুফায় জুমার খুৎবা দিচ্ছেন মুক্তাদা আল-সাদর; Image Source: Scott Peterson/Getty Images

কিন্তু আমেরিকার কাছে এই পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য ছিল না। ফলে ২০০৫ সালের দিকে আমেরিকা ইরাকে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়ার লক্ষ্যে পুরোদমে কাজ শুরু করে। তারা শিয়া ডেথ স্কোয়াডগুলোকে অস্ত্র, অর্থ এবং প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে এবং তাদের মাধ্যমে সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, তা বাগদাদের জনসংখ্যার সাম্প্রদায়িক অনুপাতই পাল্টে দেয়। সুন্নিদের অবস্থা যখন ক্রমে শোচনীয় হয়ে উঠতে শুরু করে, তখন তাদের মধ্য থেকে এমন কিছু গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে, যারা ধীরে ধীরে উগ্রপন্থী হয়ে উঠতে থাকে। এই গ্রুপগুলোর মধ্যেই একটা ছিল আল-কায়েদা ইন ইরাক, যারা পরবর্তী সময়ে ইসলামিক স্টেট তথা আইসিসে বিবর্তিত হয়।

ফাঁস হওয়া নথিগুলো থেকে দেখা যায়, মার্কিন আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয় শুরু হয়েছিল, তা আর কখনোই থামেনি। ২০১৪ সালেও ইরানের মিনিস্ট্রি অভ ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির রিপোর্টে উঠে এসেছিল ইরানের ইসলামিক রেভোল্যুশনারি গার্ডস কোরের সাথে সম্পৃক্ত ইরাকি শিয়া মিলিশিয়াদের দ্বারা, বাগদাদের আশেপাশের এলাকাগুলো থেকে সুন্নি জনসাধারণকে সহিংস পদ্ধতিতে নির্মূল করার কথা।

ইরানের হিসেব-নিকেশ, ইরাকের ক্ষোভ

২০১১ সালে ওবামা প্রশাসন যখন টেলিভিশনের প্রচারণার জন্য ইরাক থেকে সৈন্য ‘প্রত্যাহার’ করেন, তখনও ইরাকের বিশাল অংশ ছিল রাজনৈতিক এবং মানবিকভাবে বিধ্বস্ত। যুদ্ধের আগে যে ইরাকি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল, তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভালো হোক বা খারাপ হোক, ওয়াশিংটনের নীতির ফলে ইরাকে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল, তা পূরণ করার জন্য সে সময় এগিয়ে এসেছিল ইরান। ইরাকের ধ্বংসস্তূপের ভেতর ইরানি নেতারা নতুন এক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল, যা ভবিষ্যতে কখনও সাদ্দামের মতো তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না।

গত কয়েকমাস ধরে ইরাক জুড়ে যে গণআন্দোলন চলছে, তা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয় ইরাকে ইরানের নীতি কতটা অজনপ্রিয় হয়ে ছিল। গত কয়েকমাসে নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে ইরাকে কয়েকশত মানুষ প্রাণ দিয়েছে, তবুও আন্দোলন স্তিমিত হয়নি। ২০০৩ সালে মার্কিন আগ্রাসনের সাথে সাথেই ইরাকের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইরাকি যুবকরা এখনও ইরাকি জাতির ধারণা লালন করছে, যার স্বাধীনতার জন্য তারা তাজা বুলেটের সামনে বুক পেতে দিতেও দ্বিধা করছে না।

২০১৯ সালের নভেম্বরের ১১ তারিখে ইরাকের তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভরত ইরাকি জনগণ; Image Source: Laurent Van der Stockt/Getty Images

তবে ইরাকে ইরানের আগ্রাসনমূলক ভূমিকাকে বিবেচনা হবে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে। সমতুল্য পরিস্থিতিতে বিশ্বের যেকোনো বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জাতিরাষ্ট্রই ইরানের মতো একই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করত। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন ইরানের মনে এই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে, তেহরানই হবে মার্কিন সামরিকবাহিনীর পরবর্তী লক্ষ্য। তাদের এই ভয় আরো পরিপক্ব হয়ে উঠেছিল, যখন সমঝোতার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে ইরানের পক্ষ থেকে দেওয়া ‘গ্র্যান্ড বার্গেন’-এর প্রস্তাব বুশ প্রশাসন ফিরিয়ে দিয়েছিল।

ইরান যে ইরাকে নিজের প্রভাব বিস্তার করার যেকোনো সুযোগ লুফে নেবে, এটি মোটেও আশ্চর্যের কিছু নয়। ইরানের ভূমিকা যদিও মোটেও ভালো কিছু ছিল না, কিন্তু আমেরিকা অনেক আগেই ইরাক কিংবা ইরানের ভবিষ্যৎ নিয়ে মধ্যস্থতা করার অধিকার হারিয়েছে। আমেরিকার হাতে ইরাকের দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬৩ সালে, যখন তারা ইরাকের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট আব্দুল করিম কাসেমের সরকারকে উৎখাতে সাহায্য করেছিল। কাসেমের অপরাধ ছিল, তিনি ইরাকের তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করেছিলেন এবং সামাজিক কল্যাণমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন।

এরপর আমেরিকা সাদ্দাম হুসেনের উত্থানে সহায়তা করে এবং বছরের পর বছর ধরে তার সরকারকে সমর্থন করে যায়, প্রধানত ইরানের বিরুদ্ধে তার রক্ষাকর্তা হিসেবে। এমনকি সাদ্দাম যখন হালাবজা শহরে ইরাকি কুর্দি বেসামরিক জনগণের উপর রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করেন এবং উপসাগরীয় যুদ্ধে যখন শিয়াদের উপর গণহত্যা চালান, তখনও আমেরিকা সাদ্দামের পক্ষ ত্যাগ করেনি।

ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকা ইরাককে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। তাদের এই ভূমিকা ইরাক এবং ইরানের কয়েক প্রজন্মের মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। আজকের দিনে ইরানের কোনো সমালোচনাই আমেরিকার এই কদর্য রেকর্ডকে মুছে ফেলতে পারবে না। ইরাকে ইরানের খবরদারির বিষয়ে ফাঁস হওয়া তথ্য ইরাকি জনগণ কীভাবে গ্রহণ করবে, সেটি তাদের ব্যাপার। হয়তো তারা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার কিংবা কোনো দেশের পরামর্শ এবং উপদেশ চাইতে পারে। কিন্তু ইরাকে আমেরিকার যে নৃশংস ভূমিকার রেকর্ড, তাতে আমেরিকার নাম সেই তালিকায় থাকা উচিত হবে না।

মূল প্রতিবেদক: জেরেমি স্ক্যাহিল, মুর্তাজা হুসাইন

প্রকাশের তারিখ: ‌১৮ নভেম্বর, ২০১৯

সবগুলো পর্ব: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব৩য় পর্ব৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব | ৮ম পর্ব

বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This article is in Bangla language. It's based on the series called 'The Iran Cables', published by The Intercept and The New York Times.

Featured Image: Pool/Press Office of Iranian Supreme Leader/Anadolu Agency/Getty Images

Related Articles

Exit mobile version