আড়াইশো বছর ধরে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকে লালন করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের একইসাথে রাষ্ট্রপ্রধান আর সরকারপ্রধান হওয়ায় নির্বাচনের অভ্যন্তরীন অপরিসীম, যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়ায় বিশাল গুরুত্ব আছে বৈশ্বিক রাজনীতিতেও। এখন পর্যন্ত সবগুলো জনমত জরিপেই এগিয়ে আছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন, ডাক ভোটিংয়ে যে পূর্বাভাস বিভিন্ন রাজ্য দিয়েছে, সেখানেও এগিয়ে আছেন বাইডেন। এগিয়ে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সুইং স্টেট হিসেবে পরিচিত মিশিগান, পেনসালভেভিয়া, ওহিওতে, এগিয়ে আছেন ডিসাইডিং স্টেট হিসেবে পরিচিতি ফ্লোরিডাতেও। এর বাইরে নর্থ ক্যারোলিনা, নর্থ ডাকোটার মতো রাজ্যগুলোতেও এগিয়ে আছেন বাইডেন, এগিয়ে আছেন শ্রেণি ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রেও। ১৯৩৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর জনমত জরিপে ক্ষমতাসীনের বিপরীতে এগিয়ে থাকার রেকর্ড উপভোগ করছেন জো বাইডেন।
সবগুলো জনমত জরিপে এগিয়ে থেকেও ২০১৬ সালের নির্বাচনে পরাজয় হয়তো এখনো ডেমোক্রেটদের তাড়া করে বেড়ায়, তাড়া করে বেড়ায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের কাছে টেস্ট কেইস। এর আগে সামরিক বাহিনীর জেনারেলেরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, নির্বাচিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার সদস্যরাও। ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন এই প্রথাগত ব্যাকগ্রাউন্ডের বাইরের লোক, কখনো কাজ করেননি সামরিক বাহিনীতে, ছিলেন না আইনসভার সদস্যও। দুঃখজনকভাবে, গত চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের টেস্টকেইস ব্যর্থ হয়েছে, বহুবার বিভাজিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, ট্রাম্প ব্যর্থ হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে। ফলে, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে যে কাল্পনিক চিত্র ভোটারদের মনে ছিলো, সেটির অবসান হয়েছে।
নির্বাচনের বাকি থাকা কয়েকদিনে যেকোনো অক্টোবর সারপ্রাইজ হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিতে পারে, পাল্টে দিতে পারে ভোটের জনমিতি। কিন্তু, সেরকম অভাবনীয় কিছু না হলে সুখবর নেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য, উতরানোর সম্ভাবনা নেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। বাইডেনের জয়ের ব্যাপারে একই ব্যাখ্যা দিচ্ছে অ্যালান লিকম্যানের বিশ্লেষণও, যিনি গত নয়টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্ভুল পূর্বাভাস দিয়েছেন।
ছয়বারের সিনেটর জো বাইডেন একসময় দায়িত্ব পালন করেছেন সিনেটের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটিতে, দায়িত্ব পালন করেছেন জুডিশিয়ারি কমিটিতেও। ওবামা প্রশাসনে বাইডেন দায়িত্ব পালন করেছেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে, ছিলেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের প্রভাবশালী কারিগর। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসলে, কতটা বদলে যাবে ট্রাম্পের আমলের পররাষ্ট্রনীতি? যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে রক্ষা করবে নিজের আর মিত্রদের স্বার্থ?
আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেন্দ্রবিন্দুতে আসবে যুক্তরাষ্ট্র
প্রথাগত রাজনৈতিক পরিবেশের বাইরে থেকে আসা ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিকভাবে উপস্থাপন করতে, তার সময়ে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে একের পর এক আন্তর্জাতিক সংস্থার। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে, অদক্ষতার অভিযোগ তুলে বেরিয়ে যাওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও। বৈশ্বিক বিভিন্ন সংঘাতে হাত গুটিয়ে থেকেছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের স্বার্থের নিরাপত্তা প্রদানে। ফলে, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ পলিসির মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত ফিরে গেছেন রক্ষণশীল ধারায়, ছেড়ে দিয়েছেন নেতৃত্বের আসন।
একটা দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে কাজ করা জো বাইডেন নিশ্চিতভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সবার আগে চাইবেন যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্বের আসনে ফিরিয়ে নিতে। বৈশ্বিক নেতৃত্বের আসনে ফিরে যাওয়ার প্রথম ধাপ হবে আন্তর্জাতিক ভ্যাক্সিন ব্যবস্থাপনা, যেখানে নেতৃত্ব দিতে চাইবেন বাইডেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ্য প্রতিনিধি সংকটে ভুগছে যুক্তরাষ্ট্র, বাইডেন চাইবেন সেটিরও কার্যকর সমাধান করতে। বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক যে নেটওয়ার্ক যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে, বাইডেন চাইবেন সেটিকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আদায় করতে, মিত্রদের স্বার্থের নিরাপত্তা দিতে। অর্থাৎ, ট্রাম্পের রক্ষণশীল পররাষ্ট্রনীতি থেকে বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ফিরে যাবেন প্রথাগত বৈশ্বিক নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে।
মিত্রদের সাথে সম্পর্কের পুনরুদ্ধার
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মিত্রদের স্বার্থের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন সিদ্ধান্ত মিত্রদের বেকায়দায় ফেলেছে, তৈরি করেছে নিরাপত্তার সংকট। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ইউরোপীয় মিত্রদের সাথেও সম্পর্ক শীতল হয়েছে ট্রাম্পের সময়ে, কমেছে পারস্পরিক একই স্বার্থের কাজের হার। জার্মানি, ফ্রান্সের মতো যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্ররাও বিব্রত হয়েছেন ট্রাম্পের আচরণে।
বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হবে মিত্র দেশগুলোর সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা, কালেকটিভ নিরাপত্তার ধারণায় ফিরে যাওয়া। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের আগ্রাসনের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র ভারত, নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই সংকটকালে এসে পাশে দাঁড়ায়নি ভারতের, হাসির খোরাক হয়েছে এ ইস্যুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য। বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক মনোযোগ পাওয়া যাবে এ ধরনের আগ্রাসনের বিপরীতে।
মূল্যবোধের আদান-প্রদান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি মূল উপাদান হিসেবে কাজ করে। জনতুষ্টিবাদী ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র মূল্যবোধের মিল খুঁজেছে যুক্তরাজ্যের বরিস জনসনের সাথে, ফিলিপাইনের রুদ্রিগো দুতার্তের সাথে, ভারতে বিভাজনের রাজনীতি করা মোদির সাথে, এমনকি উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের সাথেও। বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, পররাষ্ট্রনীতি এসব জনতুষ্টিবাদী নেতা থেকে সরে চলে আসবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দেশগুলোর দিকে, বাক-স্বাধীনতা ধারণকারী দেশগুলোর দিকে।
মধ্যপ্রাচ্য
এ শতাব্দীর শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে মধ্যপ্রাচ্য, সেখানকার অন্তহীন সংঘাত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্সিতে নতুন কোনো সংঘাতে জড়াননি, তৈরিও করেননি কোনো সংঘাত। তবে, ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি পরিকল্পনা ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে মুসলিম বিশ্বে, নতুন করে সংকটের জন্ম দিয়েছে আরব দেশগুলোর মধ্যে। ট্রাম্পের সময়ে শক্তিশালী হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র, ইমিউনিটি পেয়েছে রাজতান্ত্রিক নেতৃত্ব।
জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তাকে তুরস্ক-ইরান-সৌদির আঞ্চলিক রাজনীতির মারপ্যাঁচকে শক্তি-সাম্যের জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে সৌদি-আমিরাত-ইসরায়েল বলয়ের দিকে ঝুঁকে গিয়েছিল, বেরিয়ে আসবেন সেখান থেকেও। বাইডেন ইতোমধ্যেই ইরানের সাথে ছয় জাতির চুক্তির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের। তবে, সৈন্য প্রত্যাহার করলেও, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাত গুটিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা কম, সম্ভাবনা আছে বাইডেনের আমলে সৈন্যের পরিবর্তে ড্রোন ব্যবহারের।
তবে, মোটা দাগে বলা যায়, ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে রাজতন্ত্রের সাথে যে সখ্যতা তৈরি করেছিলেন, বাইডেন সে ধারা থেকে বেরিয়ে এসে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করার দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনও বাড়বে, যেখান থেকে আসে যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক ইন্টেলেকচুয়ালদের বড় একটা অংশ।
তৃতীয় বিশ্বে জনতুষ্টিবাদ ও কর্তৃত্ববাদ
জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদেরা শ্রেণি, গোত্র, বর্ণের ব্যবহার করে জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেন, জনগণের একটা অংশকে উপস্থাপন করেন গণশত্রু হিসেবে, উস্কে দেন সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণকে। ফলে, জনতুষ্টিবাদী শাসকদের সময়ে বারবার বাধাগ্রস্ত হয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, উত্থান ঘটে কর্তৃত্ববাদের।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে বৈশ্বিকভাবে উত্থান দেখা গেছে জনতুষ্টিবাদীদের, উত্থান ঘটেছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীতে দাঁড়ানো কর্তৃত্ববাদেরও। কিছুটা বামপন্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বৈশ্বিকভাবে এইসব জনতুষ্টিবাদীরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা কর্তৃত্ববাদীরাও। বৈশ্বিকভাবে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আরেকটি উত্থান দেখা যেতে পারে বাইডেনের সময়ে, ট্রাম্পের সময় যেটির ক্রমাগত পতন হয়েছে।
চীন, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেন মোটামুটি একই ধরনের ধারণা পোষণ করেন চীনের ব্যাপারে, চীনকে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আসলে জো বাইডেনেরও চীনের ইস্যুতে খুব বেশি ব্যতিক্রমী পররাষ্ট্রনীতি নীতি নেওয়ার সম্ভাবনা নেই, সম্ভাবনা নেই বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ হওয়ার। বরং, চীনের সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রম নিয়ে সংঘাত আরো বাড়বে জো বাইডেনের সময়ে, বাড়বে দূরত্ব।
রাশিয়ার সাথে পারমাণবিক অস্ত্রচুক্তিতে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও, রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই বাইডেনের আমলে। বরং, হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনের সময়ে রাশিয়ান হ্যাকারদের কর্মকাণ্ড বাইডেনকে উৎসাহিত করবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে। উত্তর কোরিয়া বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি একটা বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হলেও, এ ইস্যুতে এখনো পরিষ্কার বক্তব্য দেননি জো বাইডেন।
তবে, বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আশার আলো দেখতে পারে ইরান। ইতোমধ্যেই বাইডেন ইরানের সাথে ছয় জাতির চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শর্ত মানলে সকল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের।
[“ডোনাল্ড ট্রাম্প” বইটি পড়ুন এবং তার সম্পর্কে আরো জানুন।]