১৯৭৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাজ্য এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজেটে অনুদান, ইউরোপীয় ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য শেয়ারসহ বিভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে ইউরোপকে নেতৃত্বদান করেছে যুক্তরাজ্য। ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, শুল্ক না থাকায় পণ্যের বাজার বড় হয়েছে, প্রতিযোগিতা বাড়ায় কম দামে নিত্যপণ্য পেয়েছে যুক্তরাজ্যের ভোক্তারা, ভিসা ছাড়া ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছে ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সত্যিকার অর্থে এই প্রথম কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, যা একক বাজার বা একক মুদ্রা চালুর সময়ও হতে হয়নি।
যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যতের ব্যাপারে ২০১৬ সালের গণভোটে সামান্য ব্যবধানে ব্রেক্সিটের পক্ষে জয় আসে। ব্রেক্সিট নিয়ে দুই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসন দায়িত্ব নিয়েছেন। ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে বাধার মুখে ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদী এই নেতা ব্রেক্সিট সম্পন্নের জন্য পুনরায় পার্লামেন্ট নির্বাচন দেন। নির্বাচনে বরিস জনসনের দল কনজারভেটিভ পার্টি যেকোনো অবস্থায় ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের স্ট্যান্ড নেয়, তাদের সাথে যুক্ত হয় ব্রেক্সিট পার্টির মতো দলগুলো।
লেবার এবং লিবারেল ৭টি দল ব্রেক্সিট বিপক্ষে বা সমঝোতামূলক ব্রেক্সিটের পক্ষে অবস্থান নেয়। নির্বাচনে তারা ৫২.২ শতাংশ ভোট পেয়েও একত্র হতে না পারার জন্য পায় ২৭৭টি আসন। কনজারভেটিভরা ৪৬.৪ শতাংশ ভোট পেয়েও আসন পায় ৩৭৩টি।
গণভোটে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকদের ব্যক্তিগত আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে, অভিযোগ রয়েছে বৃদ্ধ-তরুণদের বিভাজনের৷ তবুও, সর্বশেষ পার্লামেন্ট ইলেকশনে উদারবাদী দলগুলোর বিভাজন আর নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিত করেছে, দ্রুতই কার্যকর হচ্ছে ব্রেক্সিট।
সর্বশেষ, ৩১ জানুয়ারি কার্যকর হয়েছে ব্রেক্সিট। পরবর্তী ১১ মাস যুক্তরাজ্য থাকবে ট্রানজেকশন পিরিয়ডে, এই সময়ে যুক্তরাজ্য ইউনিয়নের সকল সুবিধা পেলেও ভোটাধিকার থাকবে না। স্বল্প এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চুক্তিতে আসতে হবে, ইউনিয়ন ছাড়ার ক্ষতিটা সর্বনিম্ন করার চেষ্টা করতে হবে।
ব্রেক্সিট পরবর্তী যুক্তরাজ্য
গণভোট এবং সর্বশেষ সাংসদীয় নির্বাচনে ব্রেক্সিটপন্থীদের ভূমিধ্বস জয় যুক্তরাজ্যের দ্রুত ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়া নিশ্চিত করেছে। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে (তৎকালীন ইউরোপীয় কমিউনিটি) যুক্ত হওয়ার পর থেকে আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে নতুন একটি কাঠামো দাঁড়িয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে যুক্তরাজ্যকে নতুন করে সকল আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্র
যেকোনো সিদ্ধান্ত, সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে অর্থনীতি। ফিনান্সিয়াল টাইমসের জরিপ বলছে, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে এর মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে ১.৭ শতাংশ, সার্বিক বিনিয়োগ হ্রাস পাবে ৬ শতাংশ, কমবে জাতীয় আয়। সবকিছুর ফলাফল হিসেবে কমবে কর্মসংস্থান, ১.৫ শতাংশ। এগুলো হলো স্বল্পমেয়াদী প্রভাব, এর পাশাপাশি ব্রেক্সিটের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও। রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে আরোপ হবে শুল্ক, বাণিজ্য চুক্তির নামে নানাভাবে বাধাগ্রস্থ যুক্তরাজ্যের পণ্য৷
জাতীয় বিনিয়োগ কমায় দীর্ঘমেয়াদে মাথাপিছু আয় কমবে, জাতীয় আয় কমবে, সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হবে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। ইতোমধ্যেই পরিসংখ্যান বলছে, ব্রেক্সিট পুরোপুরি কার্যকর হলে যুক্তরাজ্যের জিডিপির আকার ৬.৭ শতাংশ ছোট হবে, প্রকৃত মজুরি কমবে ৬.৪ শতাংশ। পণ্য উৎপাদন করতে এবং বিপণনে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ফল হিসেবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে জন্ম নেবে অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য।
তবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্যকে ইউনিয়নে বাজেটের ১৭ বিলিয়ন ইউরো দিতে হবে না, যা যুক্তরাজ্য ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারবে।
ব্যাংকিং ক্ষেত্র
যুক্তরাজ্যের ছোট এবং বড় ব্যাংকগুলো যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অবদান প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার, যা সার্বিক জিএনপির ৬.৯ শতাংশ। ব্যাংকগুলো যুক্তরাজ্যে ১১ লাখ কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি সরকারকে বছরে ২৯ বিলিয়ন ইউরো কর পরিশোধ করে সরকারকে। ব্রেক্সিট ঘোষণার পরপরই যুক্তরাজ্য থেকে ব্যাংকগুলোর ১ ট্রিলিয়ন ডলার পুঁজি ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের বাইরে চলে গেছে। ২৬৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে তাদের শাখা যুক্তরাজ্যের বাইরে নিয়ে গেছে, আরো ২৩৯টি কোম্পানি বাইরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবমিলিয়ে ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের ব্যাংক এবং আর্থিক ক্ষেত্র চাপের মধ্যেই পড়তে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্রনীতি
অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করে দেয়। এই নিয়ামকগুলোতে ব্রেক্সিটের পরপরই একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে এবং যুক্তরাজকে তার নতুন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে। এখানে অনেকগুলো সম্ভাবনা আছে।
প্রথমত, যুক্তরাজ্য খুব স্বাভাবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য বাড়াতে চাইবে। বরিস জনসন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প, দু’জনের রাজনৈতিক আদর্শ এবং বিশ্বাস তাদেরকে কাছে আনছে এবং এ সম্পর্ক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইতোমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় বাজার। ফলে ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতিতে অনেকটা অংশ জুড়েই থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক।
দ্বিতীয়ত, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সাথে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক বৃদ্ধি হবে। বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে এর মাধ্যমে।
তৃতীয়ত, যুক্তরাজ্য কৌশলগত মিত্র হিসেবে জাপান, ভারতের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে পারে। তবে যুক্তরাজ্যকে ভারত, জাপান, ইরানের মতো উদীয়মান শক্তিগুলোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন তেল কোম্পানিগুলোর স্থায়িত্ব রক্ষাও পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে আসবে।
স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা
দীর্ঘদিন ধরেই স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতাকামীরা সোচ্চার রয়েছে। ২০১৪ সালের গণভোটে শতকরা ৫৫ ভাগ মানুষ যুক্তরাজ্যের সাথে থাকার পক্ষে ভোট দিলেও ব্রেক্সিট স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীদের নতুন করে উজ্জীবিত করছে। ২০১৫ সালের গণভোটে স্কটল্যান্ডের ৬২ শতাংশ মানুষ ব্রেক্সিটের বিপক্ষে ভোট দেন। স্কটল্যান্ডের প্রধান দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি সর্বদা একক বাজার এবং ইইউ কাস্টমসের সুবিধা ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগেও চেয়েছে।
পাশাপাশি, ব্রেক্সিটের ঘোষণার পর স্কটল্যান্ডের অর্থনীতিও সংকুচিত হচ্ছে। সবমিলিয়ে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার ব্যাপারটি ব্রেক্সিটে পুরোপুরি কার্যকর হলে আবার নতুনভাবে আলোচিত হবে এবং স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অভিবাসন
যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অভিবাসী এবং তারা অর্থনীতি, শিক্ষা, গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রেক্সিট পুরোপুরি কার্যকর হলে স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে অভিবাসী কমবে, শিক্ষার্থী কমবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেওয়া গবেষণা ক্ষেত্রের বরাদ্দটাও বন্ধ হবে। সবমিলিয়ে গুণগত শিক্ষার মান কমবে এবং গবেষণা বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থনীতিতে অভিবাসীরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন, সেটাও বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা
ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার ফলে যুক্তরাজ্য অপরাধী শনাক্তকরণ, যাতায়াত এবং ডিএনএ প্রোফাইলের তথ্য পেতে পারত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডাটাবেজ ব্যবহার করে। ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় এই ডাটাবেজে যুক্তরাজ্যের প্রবেশাধিকার থাকছে না, ফলে অপরাধীদের শনাক্ত করা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জন্য কঠিন হবে।
পাশাপাশি গুগল, ফেসবুকের বর্তমান সময়ের জায়ান্ট প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য নিরাপত্তা নষ্ট করছে, ভঙ্গ করছে নাগরিক অধিকার।ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে গুগল, ফেসবুক এবং অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পেরেছে, একা যুক্তরাজ্যের পক্ষে সেটা সম্ভব না-ও হতে পারে। ফলে তথ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, গোপনীয়তা নষ্ট হবে এবং নাগরিক অধিকার হরণ হবে।
মৎস্য আহরণ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশ মিলে যে ৬ মিলিয়ন টন মাছ আহরণ করে বছরে, তার অর্ধেকই আসে যুক্তরাজ্যের সমুদ্রসীমা থেকে। ব্রেক্সিট হওয়ায় প্রতিযোগী কমে যুক্তরাজ্যের মাছ শিকারীরা সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি যুক্তরাজ্যের মাছের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে, তাহলে এই একক অধিকার খুব বেশি সুবিধা বয়ে আনবে না।
ব্রেক্সিটের ফলে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটগুলো পরিবর্তন হবে। স্বার্থের প্রয়োজনে অনেক দেশের সাথে বন্ধুত্ব হবে, অনেক দেশের সাথে প্রতিযোগিতা হবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন অবস্থান তৈরির প্রচেষ্টা বরিস জনসনের এবং তার উত্তরসূরীদের অবশ্যই থাকবে। সেই চেষ্টাগুলো মিলে হয়তো নতুন মেরুকরণ দেখা যাবে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারসাম্যের আবারও পরিবর্তন হবে।