জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সাত বছরব্যাপী স্বেচ্ছানির্বাসনের অবসান হলো। ১১ এপ্রিল, ২০১৯, লণ্ডনে অবস্থিত ইকুয়েডর দূতাবাস থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করলো লণ্ডন পুলিশ। ইকুয়েডর থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ‘আশ্রয়’ (Assylum) বাতিল করার পরপরই এ ঘটনা ঘটলো। আরও স্পষ্টভাবে বলা যায়, ইকুয়েডরই লন্ডন পুলিশকে ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দিলো অ্যাসাঞ্জকে। জামিন লঙ্ঘনের অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করেছে লণ্ডন পুলিশ। গ্রেপ্তারের পরদিনই তাঁকে এক বছরের জেল দিয়েছে লণ্ডনের আদালত।
এই গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সাত বছর পর ইকুয়েডর দূতাবাসের বাইরের দুনিয়ায় পা রাখলেন অ্যাসাঞ্জ। শুধু দূতাবাসের বাইরেই নয়, এক বন্দীদশা থেকে আরেক বন্দীদশায়ও পা রাখলেন অ্যাসাঞ্জ। সাথে জন্ম দিলেন নানা প্রশ্নের। তাকে কি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া হবে? তুলে দেয়া হলে সম্ভাব্য কী কী ঘটতে পারে তার সাথে? কেন তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কোনোমতেই তুলে দেয়া উচিত নয়- তা নিয়েই চলছে তুমুল বিতর্ক।
মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক ইন্টেলিজেন্স অ্যানালিস্ট চেলসি ম্যানিংয়ের হাত ধরেই ইরাক-আফগানিস্তান যুদ্ধের চাঞ্চল্যকর নথিগুলো পান জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, যেগুলো পরবর্তীতে তিনি উইকিলিকসের মাধ্যমে সারা দুনিয়ার কাছে ফাস করে দেন। অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করার কিছুদিন আগেই উইকিলিকসের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় চেলসি ম্যানিংকে জেলে পাঠানো হয়। এরপর থেকেই বারবার অ্যাসাঞ্জের নিরাপত্তা এবং তার গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে যাচ্ছিলো উইকিলিকস।
উইকিলিকসের ভাষ্যমতে, যথেষ্ট প্রমাণ হাতে পেয়েই তারা এই দাবি করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তাদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না এবং তা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। উইকিলিকসের আশঙ্কা কেবল গ্রেপ্তারেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা এটাও বলেছিল যে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করা হলে যুক্তরাজ্য তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তাকে তুলে দেবে এবং সেখানে অ্যাসাঞ্জ শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারেন। উইকিলিকসের এই আশঙ্কাও আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না। কারণ রাজবন্দী বা বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলায় আটককৃত বন্দীদের সাথে অমানবিক আচরণের আরও অনেক নজির রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় দিয়েছিলেন ইকুয়েডরের সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া। নতুন প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনোর দুর্নীতির খবর ফাঁস করে দেয়ায় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উপর যারপরনাই রুষ্ট হয়েছেন তিনি। তাই গুঞ্জন আছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাজ্য পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট মোরেনো তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, ইকুয়েডর দূতাবাসে অ্যাসাঞ্জ অবৈধ কাজ করে চলেছেন বলে ইকুয়েডর এটি করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ইকুয়েডর দূতাবাসে বসে সাংবাদিকতা অর্থাৎ পেশাগত দায়িত্ব পালন করা যে অপরাধ নয় তা তাঁর অজানা থাকার কথা না। উপরন্তু লন্ডন পুলিশ অন্য দেশের দূতাবাসে ঢুকে অ্যাসাঞ্জের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিকে যেভাবে টেনে-হিঁচড়ে বের করার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে তা থেকে অন্তত এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অ্যাসাঞ্জের ক্ষেত্রে কোনO আইন-কানুনের তোয়াক্কা করছেন না কেউই।
যদিও জামিন লঙ্ঘনের অভিযোগ দেখিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু গ্রেপ্তারের পরপরই ব্রিটিশ সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রত্যর্পণ অনুরোধের (এক্সট্রাডিশন রিকোয়েস্ট) পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার দেখায় লন্ডন পুলিশ। এটিই সকলের কাছে উদ্বেগের বিষয়। অথচ ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট মোরেনো তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন,
আমি ব্রিটিশ সরকারকে নিশ্চিত করতে অনুরোধ করি যে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে এমন কোনো দেশের হাতে তুলে দেয়া হবে না যেখানে তিনি শারীরিক নির্যাতনের বা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতে পারেন। ব্রিটিশ সরকার লিখিতভাবে এটি নিশ্চিত করেছে।
ব্রিটিশ সরকার যদি লিখিতভাবে এটি নিশ্চিত করে থাকে, তাহলে ব্রিটিশ পুলিশ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রত্যর্পণ অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার দেখায় কেমন করে?
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন এমন কোনো ব্যক্তিকে তার দেশ বা অন্য কোনো দেশের কাছে হস্তান্তর করা ইকুয়েডরের আইনের লঙ্ঘন। অ্যাসাঞ্জকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করলে পরবর্তীতে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতে পারে- এসব জেনেও ইকুয়েডর তাঁর আশ্রয় বাতিল করেছে। একই আইন বলবৎ আছে যুক্তরাজ্যেও। তবুও ব্রিটিশ পুলিশ কি প্রাণসংশয়ে থাকা অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যর্পণ অনুরোধের দোহাই দিয়ে গ্রেপ্তার করতে পারে? যদিও খোদ যুক্তরাজ্যেই বিভিন্ন সংগঠন এর তীব্র বিরোধিতা করছে। ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন টুইটার বার্তায় বলেছেন,
যুক্তরাজ্য সরকারের ইরাক ও আফগানিস্তানে নৃশংসতার প্রমাণ উন্মোচন করার দায়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরোধিতা করা উচিত।
সুইডেনে তার বিরুদ্ধে এক নারীকে নিপীড়নের এবং অন্য এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। যদিও আদালতে এখনো কোনোটিই প্রমাণিত নয়। সুইডিশ সরকার ইকুয়েডর দূতাবাসে অ্যাসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি পেলেও তারা তা করেনি, বরং তারা অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছে। এই ব্যাপারেও অ্যাসাঞ্জ বলেছিলেন, সুইডেনও তাকে শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই তুলে দেবে। তবে উল্লেখ করবার মতো কথা হচ্ছে, নিপীড়নের অভিযোগ করা নারীরাও চান না অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করা হোক। বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন, যারা নারী নিপীড়নের ইস্যুতে অ্যাসাঞ্জকে বিচারের মুখোমুখি করার পক্ষে ছিলেন, তারাও অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরোধিতা করছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, “আমি উইকিলিকসকে ভালোবাসি“। তার অবশ্য সেসময় উইকিলিকসকে ভালোবাসারই কথা। কেননা নির্বাচনের মাত্র কিছুদিন বাকি থাকতে উইকিলিকসই ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনের ত্রিশ হাজার ইমেইল ফাঁস করে দেয়। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পেছনে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এই ইমেইল ফাঁস। অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তারের পর তিনি অবশ্য তার সুর বদলেছেন। তিনি বলেছেন, এসব তার দেখার বিষয় নয়, উইকিলিকস সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানেন না, এসব অ্যাটর্নি জেনারেলের কাজ।
অ্যাসাঞ্জের নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ারও খুব একটা মাথাব্যথা নেই এতে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তার নিয়ে বলেছেন, অ্যাসাঞ্জ আর দশজন অস্ট্রেলিয়ানের মতোই সুবিধা পাবেন, তাকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে না। কিন্তু বিশেষ সুবিধা ছাড়া অ্যাসাঞ্জের নিরাপত্তা কোনোভাবেই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সুতরাং, অস্ট্রেলিয়া যে অ্যাসাঞ্জ ইস্যুতে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ একজন সাংবাদিক। গার্ডিয়ান, আল-জাজিরা বা নিউ ইয়র্ক টাইমসের আর দশজন সাংবাদিকের মতো তিনিও একজন সাংবাদিক। তবে সাংবাদিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। কেবল সংবাদ সংগ্রহ করেই ক্ষান্ত থাকেননি, সংবাদের প্রমাণে হাজির করেছেন প্রমাণও। পৃথিবীর সমস্ত ‘বিগ ব্রাদার’দের তাই চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন অনেক আগেই। পরাশক্তিগুলোর ক্ষমতা ব্যবহারের কদর্য রূপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও তার সংগঠন উইকিলিকস। তাই তো বহু মানুষের চোখে তিনি ‘এ যুগের চে’। সেই যুগের চে’র মতো এ যুগের চে’ও ইয়াংকি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। চে’কে হাতের মুঠোয় পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেসময়ে ঠিক যতটা কাঠখড় পুড়িয়েছিল, অ্যাসাঞ্জকে হাতের মুঠোয় পেতে খরচ করছে তার থেকেও কয়েক গুণ বেশি। যেকোনো মূল্যে অ্যাসাঞ্জকে তাদের হাতের মুঠোয় চাই-ই চাই। তাতে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হলে হবে, তবু অ্যাসাঞ্জকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া চাই।
অ্যাসাঞ্জের সাথে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা সত্যিকার অর্থেই এখনো কারো জানা নেই। অ্যাসাঞ্জের বাবা তাকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রত্যর্পণ করার পক্ষে। কিন্তু ব্রিটেনের তা করার সম্ভাবনা কম। ব্রিটেন তাকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করবে নাকি সুইডেনের হাতে তুলে দেবে? সুইডেন কি তার প্রতি সুবিচার করবে? নাকি তুলে দেবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে? ব্রেক্সিট ইস্যুতে থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীত্ব হারালে নতুন প্রধানমন্ত্রী অ্যাসাঞ্জ ইস্যুতে কী পদক্ষেপ নেবেন? এসবের উত্তর জানা নেই কারো। আপাতত তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে বন্দী। তবে আর যা-ই হোক, অ্যাসাঞ্জকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়ার বিপক্ষে দুনিয়ার সমস্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা কি তাদের বিরুদ্ধে আরও অনেকদিন লড়াই করার সুযোগ দেবে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে?