আরব উপদ্বীপে সৌদি আরব আধুনিক যুগের রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রক্রিয়া শুরু করে ১৯০২ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক রাজনীতিতে পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে মধ্যপ্রাচ্যেও, ১৯৩২ সালে আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া’। মুসলমানদের তীর্থভূমি মক্কা আর মদিনা পড়ে ইবনে সৌদের প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের মধ্যেই। ফলে, তুরস্কে উসমানীয় খেলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে ভাবতে শুরু করেন মুসলমানরা, বৈশ্বিক রাজনীতিতেও সৌদি আরবের আবির্ভাব ঘটে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে।
একই সময়ে সৌদি আরবের বিস্তৃর্ণ মরুর প্রান্তরের নিচে তেলের উপস্থিতি আবিষ্কৃত হতে থাকে। ১৯২৩ সাল থেকে সৌদি আরবে তেলের অনুসন্ধান শুরু করে ব্রিটিশ কয়েকটি তেল কোম্পানি, ১৯৩৩ সালে এই ব্রিটিশদের পরিবর্তে এই দায়িত্ব পায় ক্যালিফোর্নিয়া স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানি। তেলকূপ আবিষ্কারের পর ১৯৩৫ সালে শুরু হয় কূপ খননের কাজ, ১৯৩৮ সালে শুরু হয় বাণিজ্যিক তেল উৎপাদন। সময়ের সাথে সৌদি আরবের তেল উত্তোলনের পরিমাণ বেড়েছে, বেড়েছে তেল রাজস্ব। বর্তমান সময়ে শীর্ষ তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর একটি সৌদি আরব, তেল রাজস্ব আয়েও শীর্ষেই আছে তারা।
তেল রাজস্ব থেকে অর্জিত এই বিপুল পরিমাণ পেট্রোডলার অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে সৌদি আরবকে, বৃদ্ধি করেছে অর্থনীতির আকার, সুযোগ করে দিয়েছে বিপুল প্রতিরক্ষা ব্যয়ের। ফলে পেট্রোডলারের শক্তিতে বলিয়ান অর্থনীতি আর সামরিক শক্তি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর একটি হয়েছে সৌদি আরব, মক্কা আর মদিনার খেদমতকারীর পরিচয় তাদেরকে তুলে এনেছে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এই দেশটির রাষ্ট্রকাঠামো রাজতান্ত্রিক, বাদশাহ সামলান রাষ্ট্রপ্রধান আর সরকারপ্রধানের দ্বৈত দায়িত্ব। আবদুল আজিজ ইবনে সউদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাহ সালমান ইবনে আবদুল আজিজ, যিনি আবদুল আজিজ ইবনে সউদের ৪৫ সন্তানের মধ্যে ২৫ তম। একটা দীর্ঘ সময় রিয়াদের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করে বাদশাহ সালমানের বয়স পঁচাশি পেরিয়েছে, সময়ের সাথে কমছে কর্মদক্ষতাও। ফলে সৌদি আরবের রাষ্ট্রকাঠামোর মূল নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের হাতে। সদ্য ত্রিশ পেরোনো এই যুবরাজ যেমন সৌদির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিও।
২০১৫ সালে মুহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে তার বাবা সালমান ইবনে আবদুল আজিজ সৌদি আরবের বাদশাহ হওয়ার সাথে সাথে। জানুয়ারি মাসেই অনভিজ্ঞ মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন বাদশাহ সালমান, এপ্রিলে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্স করার সাথে সাথে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্সের দায়িত্ব দেন যুবরাজ বিন সালমানকে। দুই বছর পরেই ক্রাউন প্রিন্স বিন নায়েফকে সরিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন বিন সালমান, দায়িত্ব নেন ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে। সৌদি আরবের ডি-ফেক্টো লিডার হিসেবে আবির্ভূত হন যুবরাজ বিন সালমান, তার তত্ত্বাবধানে নির্ধারিত হতে থাকে সৌদির পররাষ্ট্রনীতি।
গত অর্ধযুগে কতটুকু বদলে গেছে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি? অনভিজ্ঞ মোহাম্মদ বিন সালমানের আকস্মিক রাজনৈতিক উত্থানের পর কতটুকু বদলেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সৌদির অবস্থান? ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরির পর মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে সৌদি আরবের গ্রহণযোগ্যতা কি প্রশ্নের মুখে পড়ছে? অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মতো পররাষ্ট্রনীতিতেও কি তৈরি হচ্ছে অস্থিতিশীলতা? এই লেখায় খোঁজা হবে সেই উত্তর, আলোচনা করা হবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মোহাম্মদ বিন সালমানের আলোচিত-সমালোচিত পদক্ষেপগুলো নিয়ে।
ইয়েমেন যুদ্ধ
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোহাম্মদ বিন সালমানের আবির্ভাব ঘটে ইয়েমেন যুদ্ধের মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো আরব বসন্তের প্রভাব পড়ে সৌদি আরবের প্রতিবেশি দেশ ইয়েমেনেও। প্রবল আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে হয় তিন দশক ধরে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আলি আব্দুল্লাহ সালেহকে, রাজনৈতিক সংকটের সাথে শুরু হয় শিয়া আর সুন্নিদের আদর্শিক সংঘাত। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়েও মতভিন্নতা দেখা দেয় শিয়া আর সুন্নিদের মধ্যে, শিয়া ধর্মাবলম্বী হুতিদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সৌদির নেতৃত্বাধীন আটটি সুন্নি প্রধান দেশ সামরিক আক্রমণ শুরু করে ইয়েমেনে।
২০১৫ সালের মার্চে যখন সৌদি আরব সরাসরি ইয়েমেনে সামরিক আক্রমণ চালায়, আধুনিক সৌদির ইতিহাসে সেটিই ছিল প্রথম সরাসরি সামরিক হামলা। সৌদি আরবের এস্টাবলিশমেন্ট আর তখনকার ক্রাউন প্রিন্সকে পাশ কাটিয়ে একাই এই সিদ্ধান্ত নেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ইয়েমেনে সামরিক আক্রমণ শুরুর সময় মনে হচ্ছিল, হুতিদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু, গত অর্ধযুগ ধরে সৌদি নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেও টিকে আছে হুতিরা, আরামকো তেলকূপে হামলা করে জানান দিয়েছে নিজেদের সামরিক সক্ষমতার।
ফলে সৌদি আরবের রাজনীতিতে কান পাতলেই এখন শোনা যায়, ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে কী অর্জন করেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান? হুতিদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য শুরু হওয়া সামরিক আক্রমণ কি কেবল দুর্দশাই বাড়িয়েছে ইয়েমেনি নাগরিকদের, ঠেলে দিয়েছে গৃহযুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের দিকে?
কাতার অবরোধ
২০১৫ সালের মার্চে ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে সামরিক আক্রমণ শুরুর পর কেটে গেছে তিনটি মাস। ক্ষমতার পট-পরিবর্তনে মোহাম্মদ বিন সালমান অধিষ্ঠিত হয়েছেন ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে, সাথে আছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও। বাবা বাদশাহ সালমানের আর্শীবাদে সৌদি আরবের ডি-ফেক্টো লিডার হিসেবে আবির্ভাব ঘটতে শুরু করেছে যুবরাজ বিন সালমানের। জুন মাসেই আরব উপদ্বীপের সুন্নিপ্রধান আরেক দেশ কাতারের উপর কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে সৌদি আরব, তাদের সঙ্গী হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন আর মিশর। সন্ত্রাসীদের অর্থায়নের অভিযোগে শুরু হওয়া এই অবরোধে পরবর্তীতে যুক্ত হয় আরো দুই দেশ, কুয়েত আর ওমান। সৌদি আরবের এই পদক্ষেপেও নেতৃত্ব দেন মোহাম্মদ বিন সালমান, তার সাথে যুক্ত হন সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ।
দ্য ইন্টারসেপ্টের রিপোর্টে উঠে এসেছে, সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরিকল্পনা ছিল কাতারে সামরিক আক্রমণ চালানো, দখল করে নেওয়া কাতারের রাজধানী দোহাও। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই গোয়েন্দার দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে আসে এই সামরিক আক্রমণের বিস্তারিত পরিকল্পনাও। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনের হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রণে আসে পরিস্থিতি, তখনকার মতো নিবৃত হন দুই যুবরাজ, মোহাম্মদ বিন সালমান ও মোহাম্মদ বিন জায়েদ।
ইয়েমেন যুদ্ধের মতো কাতার অবরোধ থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে, ব্যর্থ হয়েছেন অবরোধ আরোপ করে কাতারকে নিয়ন্ত্রণে আনার স্বপ্ন পূরণ করতে। কোনো ফলাফল ছাড়াই কিছুদিন আগে কাতারের উপর থেকে সব ধরনের অবরোধ তুলে নিয়েছে সৌদি আরব, অবরোধ তুলে নিয়েছে সৌদি আরবের সাথে অবরোধ আরোপ করা বাকি দেশগুলোও।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে পদত্যাগে বাধ্য করা
নভেম্বর, ২০১৭। ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স থেকে ক্রাউন প্রিন্সের দায়িত্ব নিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। আবদুল আজিজ ইবনে সউদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সৌদি আরবের প্রথা ভেঙে, বয়স ত্রিশের কোঠায় থাকতেই ক্রাউন প্রিন্স হয়ে গেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। নভেম্বরের ৪ তারিখে সৌদি আরব সফরে আসেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। বিমানবন্দরে অবতরণের পরে রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনার পরিবর্তে বন্দী করা হয় তাকে। বাদশাহ সালমান আর ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সাক্ষাতের পরদিন সৌদি আরবের মালিকানাধীন এক টেলিভিশনে এসে লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন সাদ হারিরি। সৌদি আরব থেকেই লেবাননের প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগপত্র পাঠান সাদ হারিরি।
লেবাননের রাষ্ট্রকাঠামো থেকে শুরু করে নাগরিকদের কেউই স্বাভাবিকভাবে নেননি এই ঘটনাকে, এর প্রভাব পড়ে সৌদি আরবের সাথে লেবাননের কূটনৈতিক সম্পর্কে। প্রেসিডেন্ট মাইকেল আউন পদত্যাগ গ্রহণে অস্বীকার করেন, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে অপহরণের। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোর হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রণে আসে পরিস্থিতি, লেবাননে ফিরে যান হারিরি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মোহাম্মদ বিন সালমানের সমালোচনা শুরু হয়, তার কাজকে ‘শিশুসুলভ’ আখ্যা দেন জার্মানির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মন্তব্যের জেরে বার্লিন থেকে সৌদি রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে রিয়াদ, এমবিএসের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতায় এই সংকট চলে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
মোহাম্মদ বিন সালমানের কারণেই কূটনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হয় কানাডার সাথে। মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কানাডার সাথে একদফা সম্পর্ক খারাপ হয় সৌদি আরবের, দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়ে যুবরাজ বিন সালমানের নির্দেশে কানাডায় সাবেক সৌদি গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে হত্যাচেষ্টাও।
জামাল খাসোগজির হত্যাকান্ড
সৌদি আরবের রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল জামাল খাসোগজির, কাজ করেছেন রাজপরিবারের পরামর্শক হিসেবেও। ২০১৫ সালে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে একমত হননি জামাল খাসোগজি, মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে মতভিন্নতার জেরে ছাড়তে হয় দেশ। সৌদি আরব থেকে পালিয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন জামাল খাসোগজি, নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করেন সৌদি রাজপরিবারের বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করে।
ততদিনে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ঘরে-বাইরে নির্বিচারে সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করা শুরু করেছেন। জামাল খাসোগজিকে কৌশলে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে নিয়ে আসেন, যুবরাজ বিন সালমানের নির্দেশে কনস্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয় খাসোগজিকে, লাশ নষ্ট করে দেওয়া হয় এসিড দিয়ে। কিছুদিন অস্বীকারের পর সৌদি আরব স্বীকার করে নেয় খাসোগজিকে হত্যার দায়।
দেশের বাইরে, কনস্যুলেটের মতো জায়গায় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের এই নির্মম অ্যাডভেঞ্চার বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করে, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা দাবি জানায় তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্য। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অস্থিতিশীল পররাষ্ট্রনীতিতে সেই সময়ে পার পেয়ে যান বিন সালমান। তবে বাইডেন প্রশাসন তার ব্যাপারে অবস্থান বদলেছে। সরাসরি হত্যাকারী না বললেও খাসোগজি হত্যার উপর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের তৈরি করা রিপোর্ট অস্বস্তিতে ফেলেছে মোহাম্মদ বিন সালমানকে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তিকে।
ইসরায়েলের সাথে রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক উন্নয়ন
ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই মোহাম্মদ বিন সালমান স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের দিক থেকে। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মোহাম্মদ বিন সালমানের নিয়োগেও ছিল আমিরাতের যুবরাজের ভূমিকা, যুক্তরাষ্ট্রকে এই পরিবর্তনের ব্যাপারে রাজি করাতে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনিই। এই দুই যুবরাজ মিলে কয়েক বছরের মধ্যেই বদলে দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, চিরবৈরী ইসরায়েলের সাথে গড়ে তুলেছেন কূটনৈতিক আর অর্থনৈতিক সম্পর্ক। তাদের প্রচেষ্টাতেই গত এক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিকে উহ্য রেখেই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুদান, বাহরাইন আর মরক্কো। সৌদি আরব এখনও ইসরায়েলকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়নি। তবে এতে আটকে নেই দুই দেশের বাণিজ্যিক আর কূটনৈতিক সম্পর্ক, দুই দেশ পরিচিতি পেয়েছে ‘মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বেস্টফ্রেন্ড’ হিসেবে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের এই পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার জন্য ইতিবাচক হয়নি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও আরেক দফা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে সৌদি আরবের গ্রহণযোগ্যতাকে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সৌদি আরবের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা। ফিলিস্তিনিদের উপর দমন-পীড়নের ব্যাপারে নিশ্চুপ থেকে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরি শেষ করে দিয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমানের মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার স্বপ্নকে, সৌদি আরবও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে ইরানের হাতে, সুন্নিদের নেতা হিসেবে উত্থান ঘটছে তুরস্কের।
আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের গোলকধাঁধা
হঠাৎ করে সৌদি আরবের রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটা মোহাম্মদ বিন সালমান তার পিতার কল্যাণে অল্প সময়েই পেয়েছেন অসীম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদ, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ইচ্ছামতো পরিবর্তন করছেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু তার অযাচিত এবং অপরিপক্ক হস্তক্ষেপগুলো যেমন অস্থিতিশীল করেছে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে, আত্মঘাতী হয়েছে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য, একইভাবে তিনি আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের গোলকধাঁধায় ফেঁসেছেন পররাষ্ট্রনীতিতেও। এই গোলকধাঁধা কোনো শাসকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্যই ইতিবাচক না।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে তুলনামূলকভাবে মসৃণ করতে মোহাম্মদ বিন সালমান তার এই সীমাহীন ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিবেন? এর উত্তর সময় দেবে, কঠোর রক্ষণশীল সৌদি আরবের রাজনীতির বাকবদল ঠিক করবে মোহাম্মদ বিন সালমানের ভবিষ্যৎ।