বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাঠামোতে যেসব জাতিরাষ্ট্রের উপস্থিতি দেখা যায়, তার বড় একটা অংশই কোনো না কোনো সময়ে ইউরোপীয় উপনিবেশ শাসনের অধীনে ছিল। ইউরোপীয় উপনিবেশ শাসন থেকে এরা স্বাধীনতা অর্জন করেছে আটলান্টিক রেভ্যুলুশনের পরে। লাতিন আমেরিকাতে বিউপনিবেশায়নের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গত শতাব্দীতে শেষ হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। এসব দেশের বড় একটা অংশ গণতন্ত্রায়ন হয়েছে গত শতাব্দীর শেষদিকে। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের মতে, এই সমাজগুলো হচ্ছে পরিবর্তনশীল সমাজ।
পরিবর্তনশীল সমাজগুলোতে প্রথাগত মূল্যবোধ আর বৈশ্বিক মূল্যবোধের একটি সংঘাত প্রতিনিয়ত দেখা যায়। আমলাতন্ত্রে যুক্ত হওয়া সমাজের শিক্ষিত অংশটি দুই ধরনের মূল্যবোধকেই ধারণ করতে গিয়ে, আদতে আমলাতন্ত্রের মানুষেরা হয়ে উঠে মূল্যবোধহীন। ফলে, এসব পরিবর্তনশীল সমাজে উচ্চহারে দুর্নীতির ঘটনা ঘটে, আমলাতন্ত্র হয়ে উঠে দুর্নীতিপরায়ণ। এসব দেশে দুর্নীতিবিরোধী নতুন নতুন আইন দুর্নীতিতে আরো বাড়িয়ে দেয়, দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর কর্মচারীদের দুর্নীতির সুযোগ বাড়িয়ে দেয়।
একই ধরনের ঘটনা ঘটে কিশোর অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রেও। কিশোর অপরাধীদের যত কঠোর শাস্তির বিধান তৈরি হয়, কিশোর অপরাধীদের আইনি কাঠামোর মুখোমুখি হওয়া থেকে বাঁচাতে পৃষ্টপোষকদের তুলনামূলকভাবে বেশি ঘুষ দিতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। এই অতিরিক্ত অর্থ কিশোর অপরাধীদের জেল থেকে বেরিয়ে উপার্জন করে পৃষ্ঠপোষকদের ধরে রাখতে হয়। ফলে, তারা আগের চেয়ে বেশি অপরাধের সাথে জড়ায়, জড়ায় সহিংসতায়।
কিশোর অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান করা বা না করার এই ট্রেড-অফ পরিবর্তনশীল সমাজের। একই ধরনের ট্রেড-অফ দেখা যায় স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের বেড়ে উঠা সমাজেও, যেখানে শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের বয়স তিনশো বছরের কাছাকাছি পৌঁছেছে। কিশোর অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া বা না দেওয়ার এই ট্রেড অফ নিয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দ্য নিউ ইয়র্কারে একটি নিবন্ধ লিখেছেন এরিক মার্কউইজ। রোরের পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে।
কিশোর অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দানের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি
আমির হুইটেকার ১৯৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করে। বেড়ে উঠার সময়টাতে সে অনেকগুলো জায়গায় থেকেছে, তারমধ্যে একটা সময় থেকেছে নিউজার্সির প্লেইনফিল্ডে, তার চৌদ্দজন আত্মীয়ের সাথে একটি যৌথ বাড়িতে। সিগারেটের পোড়া পকমার্কযুক্ত একটা পালংকে নিয়মিত ঘুমাতো সে। তার বাবা-মা, চাচা-চাচী সবাই ছিল মাদকাসক্ত। ফলে, তার বাবার মতো পরিবারের প্রায় সবাইকেই জেলে আসা যাওয়া করতে হতো। পরিবার চলতো তার দাদা-দাদীর সামাজিক সুরক্ষা বলয় থেকে পাওয়া অর্থের উপর ভিত্তি করে।
ফলে, মাদক হুইটেকারের শৈশবের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। নিজের আত্মজীবনীতে সাতত্রিশ বছর বয়স্ক হুইটেকার বলছে, “আমি পনেরো বছর বয়স থেকে মাদক বিক্রি শুরু করি। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বিশ্বাস করতাম, কেবল দারিদ্র্যতাই আমাকে এই অপরাধ করতে বাধ্য করছে। এটা এমন একটা অনুভূতি ছিল, যা বাস্তবিক কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম ছিল না। যখন আপনি হাই স্কুলে পড়েন এবং আপনার উপর পরিবারের খাবার জোগানোর দায়িত্ব বর্তেছে, তখন আপনার আসলে অন্যকিছু করার নেই। এটা বাধ্যতামূলক শ্রমের মতো।”
হুইটেকার সম্ভবত অন্যান্য মাদক বিক্রেতাদের মতো ছিল না। মাদকের বিক্রির মধ্যে, হুইটেকার কবিতা পড়তো, পড়তো কথাসাহিত্য। তার আত্মজীবনী বলছে, সে গ্রাহকদের শুএভচ্ছা জানিয়ে লিখেছে, “মাদক অশুভ, এটি ভয়াবহ, ভয়াবহ, ভয়াবহ।” ২০০০ সালের গ্রীষ্মে প্লেইনফিল্ড পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তাদের বাড়িতে অভিযান চালায়, হুইটেকারকে তার মা বেং আরো দুইজনের সাথে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ পদার্থ বিক্রয় এবং বিতরণের অভিপ্রায়ের অভিযোগ আনা হয়। দুইদিন পরে তার মুক্তি হয় কিশোরদের বন্দিশালা থেকে, তার চাচীর হেফাজতে দেওয়া হয় তাকে।
ছয় মাস যাবত তার বিচার কার্যক্রম চলে। হুইটেকারের জেল হয়নি, কিন্তু বিচারক তার ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত করে দেয় এবং তাকে দুই হাজার ডলার জরিমানা করে। এই পরিমাণ অর্থ হুইটেকারের সাধ্যের বাইরে ছিল। আত্মজীবনীতে হুইটেকার বলছে, “আমার হাতে কখনোই এতো বিপুল পরিমাণের অর্থ ছিলো না, মাদক বিক্রয় করেও আমি এতো অর্থ আয় করিনি। আমার কাছে তখন বিশ ডলারের মূল্যই ছিল স্বর্গ হাতে পাওয়ার মতো।”
ষোলো বছর বয়সে, হুইটেকার একটা চাকরি পেতে সমর্থ হয়, বার্গার কিংয়ে প্রতি ঘণ্টায় তার পারিশ্রমিক ছিল ৫.১৫ ডলার। কিন্তু, নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর সরকারি অফিসিয়ালদের কাছে তাকে আদালতের জরিমানার একটি অংশ পরিশোধ করতে হতো, যাতে তাকে জরিমানা না দেওয়ার অভিযোগে আবার আদালতের মুখোমুখি না হতে হয়। জরিমানা বাড়ার সাথে সাথে, হুইটেকার কোনো বিকল্পের সন্ধান না পেয়ে আবার মাদক বিক্রির পেশায় ফিরে যায়। আত্মজীবনীতে সে বলছে, “আমার কাছে কোন বিকল্প ছিলো না মাদক ব্যবসায় ফিরে যাওয়া ছাড়া। কোনো সামাজিক সংগঠন আমাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেনি, এটা ছিল কেবল একটা শাস্তি এবং শাস্তির ছায়ার সাথে যুদ্ধের মতো ঘটনা।”
হুইটেকারের গল্পের একটি অনিয়মিত সমাপ্তি আছে। নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর মেধার জোরে হুইটেকার হাইস্কুল পার হতে সমর্থ হয়। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এডুকেশনাল সাইকোলজির উপর একটি ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করে। দুই বছর পরে আইনের উপর ডিগ্রি অর্জন করে ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামি থেকে। বর্তমানে আমির হুইটেকার ফ্লোরিয়ার সাউদার্ন পভার্টি ল সেন্টারে কাজ করে স্টাফ এটর্নি হিসেবে। পাশাপাশি, প্রজেক্ট নুকুলহেডের প্রতিষ্ঠাতা, যেই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে কিশোরদের সুবিচার নিশ্চিত করতে।
হুইটেকার স্বীকার করে, সে কখনো জরিমানার পূর্ণ দুই হাজার ডলার পরিশোধ করেনি। কিন্তু, এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কঠোর শাস্তি তরুণদের আসলে কী পরিমাণ মানসিক চাপ এবং অর্থনৈতিক সামঞ্জস্যহীনতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়।
গত কয়েক বছরে তরুণদের জরিমানা করার প্রক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের বিচার ব্যবস্থাতেই জরিমানার বিধান জেলে থাকা ব্যক্তিদের ঋণের ফাঁদে ফেলে দিচ্ছে, অপরাধের চক্রে আবদ্ধ করে ফেলছে। ২০১৬ সালের মার্চে ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের সিভিল রাইটস বিভাগে কাজ করা ব্যক্তিরা তাদের সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে, যেখানে অধিক আর্থিক জরিমানার বিরোধিতা করে এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়। গত বসন্তে, ভেরা ইন্সটিউট অফ জাস্টিস আর্থিক জরিমানা এবং অন্যান্য ফিসের সম্ভাব্য প্রভাবগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য নতুন একটি উদ্যোগ নিয়েছে।
এই বিষয়টি নিয়ে আরো কিছু গবেষণা হচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের অপরাধবিজ্ঞানের অধ্যাপক এলেক্স পিকুয়েরোর গবেষণা বলছে, কিশোররা অনেক সময়ই তুলনামূলকভাবে লঘু অপরাধে কঠোর শাস্তি পায় এবং জরিমানার বিধানগুলো তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে আরো দূরে ঠেলে দিতে পারে। জেসিকা ফেয়ারম্যানের টিম গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন, বিদ্যমান বিচারব্যবস্থায় তেরো বছরের কিশোরদেরও আদালতের নিয়োজিত এটর্নির বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে, পরিশোধ করতে হচ্ছে ড্রাগ টেস্ট, সাক্ষীর ফিস, প্রোভেশনের ফিস, পূনর্বাসন ফিস, স্বাস্থ্যসেবা ফিসের মতো হাজারো ফিস। এসব ফিস পরিশোধে ব্যর্থতা কিশোরদের কারাবাসের দিকে ঠেলে দেয়। আরাকানসের এ রকম একটি উদাহরণের উল্লেখ আছে তার গবেষণা নিবন্ধে।
সাধারণভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সকল অঙ্গরাষ্ট্রে কিশোর অপরাধীদের জরিমানা করার বিধান আছে, জরিমানার বিধানের চর্চা হয় নিয়মিত। বিশটির মতো অঙ্গরাষ্ট্রে আদালত নির্দেশনার ফিস আদায় করে শিশু বা তার পরিবারের কাছ থেকে, একত্রিশটি অঙ্গরাষ্ট্রে সকল ধরনের টেস্টিং ফিস আদায় করা হয় কিশোর বা তার পরিবারের কাছ থেকে। সাতচল্লিশটি অঙ্গরাষ্ট্র কিশোরের মাদকদ্রব্যের সাথে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা থাকলে পিতা-মাতাকে জরিমানা করে।
সাউথ ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞানের অধ্যাপক ওয়েসলি জেনিংসের নিবন্ধে ফ্লোরিডার একটি কাউন্টির প্রায় সহস্রাধিক কিশোর অপরাধীর মামলা নিয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। নিবন্ধে অধ্যাপক ওয়েসলি জেনিংস দাবি করেছেন, কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধে অধিক হারে জরিমানা নির্ধারণ করলে সেটি একটি চক্র তৈরি করে, কিশোর অপরাধীরা সেই চক্রে ঢুঁকে গেলে স্থায়ীভাবে অপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কারণ, আদালতগুলো যে উচ্চহারে ফিস আদায় করে এবং জরিমানা নির্ধারণ করে, ওয়েসলির গবেষণা বলছে, শতকরা নব্বই ভাগ কিশোরেরই সেই জরিমানা পরিশোধ করার সক্ষমতা থাকে না। ফলে, তাদেরকে বাধ্য হয়েই, জরিমানা পরিশোধ করতে নতুন অপরাধের সাথে জড়াতে হয়।
কিশোর অপরাধীদের কাছ থেকে ফিস আদায় করে, জরিমানা আদায় করে রাষ্ট্রের হয়তো স্বল্পমেয়াদে লাভ হচ্ছে। স্বল্পমেয়াদে রাষ্ট্রের রাজস্ব বাড়ছে কোনো না কোনোভাবে, বড় হচ্ছে অর্থনীতির আকার। কিন্তু, কোর্টের নির্ধারিত ফিস আদায় যে স্থায়ী অপরাধী তৈরি করছে, তার দায়ভারও দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রকে বহন করতে হয় এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিও হয় রাষ্ট্রের। একজন কিশোর অপরাধী হয়ে উঠার চেয়ে একজন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একজন শ্রমিক হিসেবে গড়ে উঠলেও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক লাভ আছে তুলনামূলকভাবে।
প্রয়োজন পরিবর্তনের
প্রতিটি বিচারব্যবস্থাই কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে, গড়ে উঠে কিছু প্রথা আর আইনি ভিত্তির উপর। ফলে, বিচারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হয় ধীরে ধীরে, সেভাবে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসে ধীরে ধীরে। যুক্তরাষ্ট্রের সেই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গত কয়েক বছরে আলমেন্ডা কাউন্টি, ক্যালিফর্নিয়াতে কিশোর অপরাধীদের জরিমানার বিধানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। আগে কিশোরদের প্রতি রাত কিশোর অভিযুক্তদের কেন্দ্রে থাকার জন্য ২৫ ডলার করে, প্রতি বৈদ্যুতিক মনিটরিংয়ের জন্য ১৫ ডলার, প্রতিমাসে নির্দেশনা ফিস হিসেবে ৯০ ডলার এবং পাবলিক ডিফেন্ডারের ফি হিসেবে ৩০০ ডলার পরিশোধ করতে হতো। বর্তমানে কিশোর অপরাধে অভিযুক্তদের এই ফিসের কোনোটিই পরিশোধ করতে হয় না।
আমির হুইটেকারের দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এসব পরিবর্তন ইতিবাচক। কিন্তু, হুইটেকারের দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থায় এখনো সমস্যা রয়ে গেছে। কিশোরদের মধ্যে অপরাধে অভিযুক্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে এখনো যুক্তরাষ্ট্রে শাস্তি দেওয়া হয় বা জরিমানা দেওয়া হয়। হুটটেকারের মতে, জরিমানার বিধান যতদিন থাকবে, ততদিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা অপরাধ তৈরির এই চক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। কারণ, প্রায় সবকিছুর সাথেই অর্থের একটি ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে। অপরাধী তৈরি হওয়ার চক্র ভাংতে হলে রাষ্ট্রকে এই সংযোগ থেকে বের হয়ে আসতে হবে।