পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী কয়েকটি সাম্রাজ্যের মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্য ছিল অন্যতম। ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভূমি কয়েকশ বছর পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছে অটোমানরা। কয়েকশ বছর শাসন করেছে প্রায় সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ। আনাতোলিয়ার ছোট্ট একটা অঞ্চল থেকে ইউরোপ ও বিশাল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রভুত্ব কায়েম করে তারা। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। কয়েক শতাব্দী দাপটের সাথে শাসন করার পর অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে অটোমানরা দ্রুত তাদের প্রভাব হারাতে থাকে। এ সময় অটোমান সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়া ও রাশিয়ার কাছে কয়েকটি যুদ্ধে হেরে গেলে ইউরোপে অটোমানদের পতনের সূচনা হয়। এক পর্যায়ে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তি এমন খারাপ অবস্থায় গিয়েছিল যে অটোমান সুলতানকে তথা তুরস্ককে ইউরোপের ‘সিক ম্যান’ (Sick man) বলে আখ্যা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯১২-১৯১৩ সালে সংগঠিত বলকান যুদ্ধের মাধ্যমে ইউরোপে অটোমানদের চূড়ান্ত পতন ঘটে।
বলকান যুদ্ধের কারণ ও পটভূমি অনেক দীর্ঘ ও গভীর। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের মানচিত্র পরিবর্তনকারী এই যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে কয়েকশ বছর আগে থেকে শুরু হওয়া এর পটভূমিটা বুঝতে হবে।
ফরাসী বিপ্লবের পর ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলেও ফরাসি বিপ্লবের আদর্শে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান ঘটে। এ সময় বলকান অঞ্চলের অনেক জাতি স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা দাবি করে বসে। অন্যদিকে, রাশিয়া তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির মাধ্যমে পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং একই সাথে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যও দক্ষিণ দিকে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে। উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে এমন আক্রমণের ফলে অটোমান সাম্রাজ্য ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে।
বলকান অঞ্চলের জাতিগুলোকে রাশিয়া জাতীয়তাবাদী ও অর্থোডক্স খ্রিষ্টীয় মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত করতে থাকে। রাশিয়ার এরূপ সম্প্রসারণ নীতিতে শঙ্কিত হয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া এর তীব্র বিরোধিতা করে। এর ফলে বলকান অঞ্চল একটি আন্তর্জাতিক বিদ্বেষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এবং একে ইউরোপের মারাত্মক অঞ্চল হিসেবে অভিহিত করা হয়। বলকান অঞ্চলের এমন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচ্যদেশীয় সমস্যার (Eastern Question) সৃষ্টি হয়।
প্রাচ্যদেশীয় সমস্যার ফলশ্রুতিতে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। এর ফলে বলকান অঞ্চলের জাতিসমূহ স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করে এবং তুর্কিবিরোধী আন্দোলন ও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে রাশিয়ার মদদে ১৮২১ সালে গ্রিস স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৮৩০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। বলকান উপদ্বীপে তুর্কি মুসলিম আধিপত্য শেষ করার যে প্রচেষ্টা খ্রিষ্টান ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহ চালায়, তার ফলেই গ্রিক স্বাধীনতা যুদ্ধ, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ ও রুশ-তুর্কি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধগুলো অটোমানদের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল।
ইউরোপীয়রা অটোমানদের ইউরোপ থেকে তল্পিতল্পাসহ বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করে। রাশিয়ার যোগসাজশে জাতি ও ধর্মভিত্তিক প্যান-স্লাভ আন্দোলন শুরু হয়। এই প্যান-স্লাভ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। এরপর বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বলকান রাষ্ট্রসমূহে তুর্কি বিরোধী আন্দোলন জোরালো হয়। গ্রিস, সার্বিয়া, রোমানিয়া, মন্টিনেগ্রো ও বুলগেরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রসমূহ বলকান অঞ্চলে তুর্কী আধিপত্যর বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলে।
বলকান সমস্যার আরো অন্যতম কারণ ছিল তানজিমাত উত্তর তুরস্কের উগ্র তুর্কী জাতীয়তাবাদ। বলকান যুদ্ধ ছিল ১৯০৮ সালের নব্য তুর্কি বিপ্লবের ফলশ্রুতি। নব্য তুর্কীগণ অটোমানদের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোতে তুর্কিকরণ ও কিছুক্ষেত্রে গণহত্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। বলকান উপদ্বীপের অধিবাসীদের তুরস্ককরণ নীতি বলকান অঞ্চলের জাতিগত, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য থাকা রাষ্ট্রসমূহকেও ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়তা করে। অস্ট্রিয়া বার্লিন চুক্তি (১৮৭৮) ভঙ্গ করে ১৯০৮ সালে তুরস্কের প্রদেশ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা দখল করে নেয়। জার্মানি আবার অস্ট্রিয়ার এমন সম্প্রসারণবাদকে সমর্থন করে। ১৯১১ সালে তুরস্ক লিবিয়াকে কেন্দ্র করে ইতালির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় । তুরস্কের এমন খারাপ পরিস্থিতির সুযোগে ১৯১২ সালের বসন্তে সার্বিয়া, বুলগেরিয়া এবং গ্রিসের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে একটি সামরিক জোট তৈরি করা হয়, যা বলকান লিগ নামে পরিচিত। মন্টিনেগ্রোও পরবর্তীতে এই জোটে যোগ দেয়।
বলকান অঞ্চলে জোট তৈরি হওয়ার সময় সার্বিয়া জার্মানি থেকে আর্টিলারি বন্দুক কিনে। তবে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার সাথে বিরোধ থাকায় এই আর্টিলারিগুলো তাদের অঞ্চল দিয়ে পরিবহনের অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। এমন সময় তুরস্ক সরকার আর্টিলারিগুলো সমুদ্রপথে সালোনিকা এবং সেখান থেকে ট্রেনে সার্বিয়ায় আনার বিষয়ে সম্মতি জানায়। কিন্তু তুরস্ক পরবর্তীতে বুঝতে পারেন যে ঐ অঞ্চলে অটোমান-বিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে। তুরস্ক পরবর্তীতে তাদের দেওয়া অনুমোদন বাতিল করে দেয়। তবে ততক্ষণে সার্বিয়ায় অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরিমাণ বন্দুক ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়ে গিয়েছিল। তদুপরি ১৯১২ সালের আগস্টে তুর্কী সরকার শান্তিপূর্ণ অভিপ্রায় দেখানোর জন্য বলকান অঞ্চলে অবস্থিত তাদের ১,২০,০০০ সুপ্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ সেনাদলকে ভেঙে ৩৫টি ব্যাটালিয়ন ইয়েমেনে বিদ্রোহ দমনের জন্য প্রেরণ করে।
১৯১২ সালের গ্রীষ্মে আলবেনিয়ায় বিদ্রোহ শুরু হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর অজুহাত তৈরি করার জন্য ম্যাসিডোনিয়ার কয়েকটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠী উল্টো আচরণ করতে থাকে। বলকান রাজ্যগুলো এবং ইউরোপীয়দের উস্কানি এড়াতে ১৯১২ সালের ১ অক্টোবর থেকে তুর্কী সরকার বলকান অঞ্চলে সীমিত আকারে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে।
বলকান লিগ প্রায় ৭,৫০,০০০ সৈন্যের বিশাল যুক্তবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়। ১৯১২ সালের ৮ অক্টোবর মন্টিনেগ্রো তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে বলকান যুদ্ধের সূচনা হয়। পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে বলকান লিগের অন্যান্য সদস্যরাও মন্টিনেগ্রোর দেখানো পথ অনুসরণ করে। বলকান মিত্রবাহিনী সহজেই অটোমানদের পরাস্ত করতে থাকে। থ্রেসে বুলগেরিয়ানরা মূল অটোমান বাহিনীকে পরাজিত করে এবং কনস্টান্টিনোপল উপকূলে অগ্রসর হয়ে অ্যাড্রিয়ানোপলকে অবরোধ করে নেয়। অন্যদিকে ম্যাসিডোনিয়ার কুমানোভোতে সার্বিয়ান বাহিনী বিশাল এক বিজয় অর্জন করে। এই জয়ের ফলে সার্বিয়ান বাহিনী স্কোপজেতে প্রবেশ করতে এবং পরবর্তীতে মন্টিনেগ্রো বাহিনীর সাথে যোগ দিতে সক্ষম হয়। এরই মধ্যে গ্রিকরা সালোনিকা (থেসালোনাকি) দখল করে আইওনিনিয়ার দিকে অগ্রসর হয় পরে ক্রীট দখল করে নেয়। গ্রিক নৌ-বাহিনীর প্রতিবন্ধকতায় তুর্কী নৌ-বাহিনী বলকানে অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি। এদিকে আলবেনিয়ায় মন্টিনেগ্রো বাহিনী শকোদারকে ঘিরে ফেলে এবং সার্ব বাহিনী দুরীসে প্রবেশ করে। বলকান বাহিনী অনেকগুলো ব্যাটলে সফলতা পায়, অপরদিকে তুর্কী বাহিনী বিপর্যস্ত হয়।
এভাবে প্রথম বলকান যুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হয়। প্রথম বলকান যুদ্ধে হারের ফলে বলকান উপদ্বীপ, এমনকি তুরস্কের অভ্যন্তরের অ্যাড্রিয়ানোপলও অটোমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
সমগ্র ইউরোপে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় ফ্রান্স ও ব্রিটেন এই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বলকান জটিলতা নিরসনের জন্য বিবাদমান জাতিগুলোর প্রতিনিধিগণ ১৯১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে এক বৈঠকে মিলিত হন। মোস্তফা রশীদ পাশার নেতৃত্বে অটোমান প্রতিনিধিদল বৈঠকে যোগ দেয়। কিন্তু কয়েকটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বলকান মিত্রদের সাথে অটোমানদের মতবিরোধ দেখা দেয়।
অটোমানদের প্রস্তাব ছিল, অ্যাড্রিন অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে থাকবে। ম্যাসিডোনিয়া অটোমান পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রিন্সিপ্যাট হিসেবে থাকবে। সালোনিকা হবে ম্যাসিডোনিয়ার রাজধানী। বলকান রাজ্যগুলোর প্রস্তাবিত প্রার্থীদের মধ্যে অটোমান সুলতান প্রিন্স নিয়োগ করবেন। আলবেনিয়ার একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত মর্যাদা থাকবে এবং অটোমান ক্রাউন প্রিন্স এর শাসক হবেন। সমস্ত এজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে থাকবে এবং ক্রীট ইস্যুতে অটোমান সাম্রাজ্য এবং গ্রেট পাওয়ারগুলোর মধ্যে পৃথকভাবে আলোচনা হবে।
অটোমানদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়, এবং লন্ডনের বৈঠকে অচলাবস্থা তৈরি হয়। এদিকে বুলগেরিয়া অ্যাড্রিন, থাসোস দ্বীপপুঞ্জ এবং সামোথ্রেস দাবি করে বসে। একইসাথে গ্রিস ইমব্রোস, টেনেডোস এবং লিম্নোসকে চায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অটোমান প্রতিনিধি দল যুক্তি দেয় যে ইস্তাম্বুল এবং প্রণালীর প্রতিরক্ষার জন্য অ্যাড্রিন এবং এর আশেপাশের দ্বীপগুলো গুরুত্বপূর্ণ, তাই তারা এই দাবি মানতে পারবে না।
১৯১৩ সালের ১৭ জানুয়ারী, গ্রেট পাওয়ারগুলো অটোমান প্রতিনিধিদের কাছে একটি নতুন প্রস্তাব দেয়। তদনুসারে, অ্যাড্রিনকে অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে রাখা হবে। এজিয়ান সাগরের তীরবর্তী মারিৎজা নদীর মুখ থেকে কৃষ্ণ সাগরের মিডিয়া পর্যন্ত প্রবাহিত রেখা অটোমানদের অধীনে থাকবে। কয়েকদিন পর প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্য অটোমান সাম্রাজ্য একটি কাউন্সিল আহ্বান করে। কাউন্সিলের সদস্যরা যুদ্ধ অব্যাহত রাখার পরিবর্তে গ্রেট পাওয়ারগুলো কর্তৃক প্রদত্ত শর্তাবলির ভিত্তিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়।
নব্য তুর্কীরা এই চুক্তির প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে। তারা ২৩ জানুয়ারি একটি ক্যুয়ের মাধ্যমে কনস্টানাটিনোপলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। নব্য তুর্কীরা হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করে। কিন্তু পরবর্তীতে তারাও বিভিন্ন যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯১৩ সালের ৩০শে মে লন্ডনে চুক্তি সম্পাদিত হয়। লন্ডন চুক্তির ফলে অ্যাড্রিয়ানোপল ছাড়া সমগ্র ইউরোপ থেকে অটোমানদের আধিপত্য শেষ হয়।
লন্ডন বৈঠকের মাধ্যমে প্রথম বলকান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও বলকান রাষ্ট্রসমূহ আবারও নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে লাভ করা অঞ্চলসমূহকে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধের সম্মুখীন হয় তারা। যুদ্ধের পর আলবেনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছিল। স্বাধীন আলবেনিয়ার ফলে ভূমিবেষ্টিত সার্বিয়ার অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে তীরে যাওয়ার কোনো পথ ছিল না। ফলে সার্বিয়ার সমুদ্র বাণিজ্য ব্যাহত হয়। ফলে সার্বিয়া আলবেনিয়ার একটা অংশ দখলের চেষ্টা করে। অপরদিকে সার্বদের মধ্যে প্যান-স্লাভ আন্দোলন ও মতাদর্শ বেগবান হতে থাকে। সার্বদের প্যান-স্লাভ মতাদর্শ বেগবান হওয়া এবং সার্বিয়ার সম্প্রসারণ নীতিতে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি বিচলিত হয়ে বাধা প্রদান করে। সার্বিয়া ও অস্ট্রিয়ার এই বিরোধের মধ্যেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ নিহিত রয়েছে।
প্রথম বলকান যুদ্ধের পর গ্রিস ও সার্বিয়া ম্যাসিডোনিয়ার অধিকাংশ অংশ অধিকার করে। বুলগেরিয়া আবার ম্যাসিডোনিয়ার কিছু অংশ দাবি করে। কিন্তু গ্রিস ও সার্বিয়া বুলগেরিয়ার দাবি অস্বীকার করে। ফলে ম্যাসিডোনিয়াকে কেন্দ্র করে গ্রিস ও সার্বিয়ার সাথে বুলগেরিয়ার বিরোধ তৈরি হয়। ১৯১৩ সালের ২৯ জুন বুলগেরিয়া তার প্রতিবেশী গ্রিস ও সার্বিয়া আক্রমণ করে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের সূচনা করে। গ্রিস ও সার্বিয়ার প্রতি-আক্রমণ বুলগেরিয়াকে আগের অবস্থানে ফিরে যেতে বাধ্য করে। এদিকে আবার রোমানিয়া বুলগেরিয়ার একটা অংশ দাবি করে কিন্তু বুলগেরিয়া সেই দাবি অস্বীকার করলে রোমানিয়া বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই পরিস্থিতিতে অটোমানরাও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। অটোমানরা প্রথম বলকান যুদ্ধে হারানো অঞ্চলগুলো উদ্ধারে তৎপর হয়ে উঠে। অটোমানরা বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশগুলোকে সহযোগিতা করতে শুরু করে।
চতুর্দিক থেকে এমন আক্রমণে বুলগেরিয়া দিশেহারা হয়ে যায়। ক্রমেই বুলগেরিয়া সংকুচিত হতে থাকে। আগ্রাসনের নীতি অবলম্বন করে বুলগেরিয়া শুধু যুদ্ধে পরাজিতই হলো না, উপরন্তু চতুর্দিক থেকে শত্রুদ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে অপমানজনক সন্ধির সম্মুখীন হতে হলো।
অবশেষে ১৯১৩ সালের ১০ আগস্ট বুলগেরিয়া বুখারেস্ট চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। বুখারেস্টের চুক্তি অনুযায়ী বুলগেরিয়া ম্যাসিডোনিয়ার ক্ষুদ্রাংশ, এজিয়ান সাগরের উপকূলে একটি বন্দরসহ কিছু ভূখণ্ড এবং ত্রেসের একাংশ লাভ করে। বুলগেরিয়া প্রথম বলকান যুদ্ধের পর যে অঞ্চল লাভ করে, বুখারেস্টের চুক্তি মোতাবেক তা হস্তচ্যুত হয়।
রোমানিয়া বুলগেরিয়া থেকে সিলিস্ট্রিয়া ও দব্রুজা অঞ্চল লাভ করে। সার্বিয়া নোভি বাজার সানজাকের একাংশ লাভ করে। সেইসঙ্গে উত্তর ও মধ্য ম্যাসিডোনিয়া লাভ করে। বুখারেস্টের চুক্তির ফলে সার্বিয়ার আয়তন ১৮,৬৫০ বর্গমাইল থেকে ৩৩,৮৯১ বর্গমাইলে পরিণত হয়। গ্রিস অত্যন্ত লাভবান হয়, তারা দক্ষিণ ম্যাসিডোনিয়া লাভ করে। গ্রিসের আয়তন ২৫,০১৪ থেকে ৪১,৯৩৩ বর্গমাইলে দাঁড়ায়, এবং তার জনসংখ্যা ২৬,৬০,০০০ থেকে ৪৩,৬৩,০০০-তে দাঁড়ায়। এছাড়াও গ্রিস সালোনিকা এবং কাভালা অঞ্চল লাভ করে। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বুলগেরিয়া ও অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে কনস্টান্টিনোপল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে অটোমান সাম্রাজ্য কিছু অঞ্চল ফিরে পায়।
বলকান যুদ্ধ ইউরোপের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই যুদ্ধের ফলে পুরো দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপের মানচিত্র পরিবর্তন হয়ে যায়। বলকান যুদ্ধের ফলে অ্যাড্রিয়ানোপল ছাড়া সমগ্র ইউরোপ থেকে অটোমানদের বিদায় ঘটে। বলকান যুদ্ধের সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার ছিল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা। এই উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৪ সালের ২৮ জুন বসনিয়ায় একজন স্লাভ জাতীয়তাবাদীর হাতে অস্ট্রিয়ান যুবরাজ আর্চ ডিউক ফ্রান্সিস ফার্ডিন্যান্ড ও তার স্ত্রী নিহত হয়। এর ফলশ্রুতিতেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এজন্য বলা হয়, বলকান জটিলতা থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে।