মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা এবং সমালোচনা চলছে। চলতি মাসের ৯-১০ তারিখ অনলাইনে বিশ্বের ১০০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে তার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্রবাদী নেতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন বহু আগেই। তিনি বিশ্বাস করেন, “গণতন্ত্র দুর্ঘটনাক্রমে ঘটে না। আমাদের একে রক্ষা করতে হবে, এর জন্য লড়াই করতে হবে, একে শক্তিশালী করতে হবে।” আর এই প্রতিপাদ্য নিয়েই এই সম্মেলনের আয়োজন করেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ। ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জয়লাভের পরই তিনি বিশ্বের ভাঙাচোরা গণতন্ত্রের সংস্করণ এবং উজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। বিশ্ব রাজনীতিতে গণতন্ত্রের অবস্থান আরো শক্ত করার লক্ষ্যে জো বাইডেনের যাত্রায় এটি শুভ সূচনা বলা চলে।
যদিও আমন্ত্রিত দেশের নাম প্রকাশের পরেই শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। জেনে রাখা ভালো, দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশ আমন্ত্রণ পেলেও বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। এর ব্যাখা চাওয়া হলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে জানান। যা-ই হোক, ন্যাটোর মিত্র হওয়া সত্ত্বেও তুরস্ক এবং হাঙ্গেরি যেমন বাদ পড়েছে, তেমনি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকা পাকিস্তানকে ঠিকই সম্মেলনে ডাকেন জো বাইডেন। আর এ কারণেই তার এই ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ ঠিক কতটা গণতান্ত্রিক ছিল সেই বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। যে ১১২টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তার মধ্যে কোন দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, তার একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি ইনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস। তাদের হিসেবে, আমন্ত্রিত ৬৯ শতাংশ দেশ ‘মুক্ত’ (অর্থাৎ গণতান্ত্রিক), অবশিষ্ট ৩১ শতাংশ দেশ হয় আংশিক মুক্ত বা মোটেই মুক্ত নয়। এই হিসেব অনুযায়ী আমন্ত্রিত দেশসমূহের মধ্যে আটটি দেশকে গণতান্ত্রিক বলা কঠিন- অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, ইরাক, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সার্বিয়া ও জাম্বিয়া।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার উপায় যেমন একেবারেই নেই, তেমনি ১১২টি দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে মিত্রতা, ভূ-রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ এবং নিজেদের কৌশলগত সমর্থনকে যে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছে সেটিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আর তাই ভৌগলিকভাবে এই ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ মূলত কোন অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে কী রকম সেই বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। কারণ যে গণতন্ত্রের কথা প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলছেন, তা কিন্তু তাদের সমর্থিত, সহজভাবে বলতে গেলে পরিচালিত অনেক দেশেও চর্চা হয় না। আজ আমরা জো বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন কোন অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে কেমন ছিল সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আফ্রিকা
বর্তমানে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল যেরকম সফলতা কিংবা সাহায্য পাচ্ছে, তেমন কিছুই পায়নি আফ্রিকান দেশগুলো। আর ঠিক এমন সময়ে এসে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন এই মহাদেশের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ছিল অর্থবহ। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ের যে আর্থ-সামাজিক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী আফ্রিকা। কারণ জনসংখ্যা অনুযায়ী ভ্যাকসিন পৌঁছায়নি আফ্রিকান দেশগুলোতে। সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী- মাত্র ৮ শতাংশ আফ্রিকান সম্পূর্ণরূপে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন যা মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে পুনরুদ্ধারের পথকে অনেকটাই কঠিন করে দিয়েছে।
অন্যদিকে, আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিত্যনতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণ সাহারা থেকে শুরু হওয়া সাহেল অঞ্চলের বিস্তৃতি সুদান পর্যন্ত। অন্যদিকে, হর্ন অব আফ্রিকা খ্যাত অঞ্চলটি আবার তুলনামূলক ছোটই বলা চলে। কিন্তু দুই আফ্রিকান অঞ্চলের মধ্যকার চলমান অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিরোধ বরাবরই সেখানকার পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করছে। যদিও পশ্চিমারা আফ্রিকার এমন বিরূপ পরিস্থিতির কারণ হিসেবে সঠিক গণতন্ত্র চর্চার অভাবকে দায়ী করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবার কোনো কোনো দেশের রাষ্টপ্রধানদের স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর তাই ৫৪টি আফ্রিকান দেশের মধ্যে মাত্র ১৭টি দেশ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছিল যা মোট ভূখণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ! যদি আফ্রিকার দিক থেকে চিন্তা করা হয়, তাহলে সম্মেলনে আমন্ত্রিত ১৭টি দেশের সাফল্য ২টি ব্যারোমিটারে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
প্রথমত, এই সম্মেলনে উল্লিখিত বিস্তৃত উদ্দেশ্যগুলো অবশ্যই সমাধান করতে হতো। জো বাইডেনের মতে- কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান নিশ্চিত করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশের আর্থসামাজিক চাহিদা ও সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করাই হবে সম্মেলনের উদ্দেশ্য। আর এই বিষয়গুলোর সবি উপেক্ষিত হচ্ছে আফ্রিকায়। উদাহরণস্বরূপ, সাহেল অঞ্চলের বিষয়েই দেখা যাক। সেখানে বুর্কিনা ফাসো, নাইজার এবং মালির মতো দেশগুলোতে সন্ত্রাসবাদ চরমপন্থায় পৌঁছে গেছে। লিবিয়া থেকে রেকর্ড পরিমাণ অস্ত্র পাচার করা হলেও দেশগুলোর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নাগরিক সেবা একেবারে পৌঁছায় না। এবার দেখা যাক দক্ষিণ আফ্রিকার বিষয়ে। বলা হয়ে থাকে, আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে শিল্পোন্নত দেশ এটি। অথচ বর্তমানে দেশটি ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পতনের মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় পৌঁছে যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায়, এই গণতান্ত্রিক সম্মেলন কি আফ্রিকান দেশসমূহের দৈনন্দিন বাস্তবতার সাথে প্রাসঙ্গিক হয়েছে?
গণতন্ত্র সম্মেলন আফ্রিকার জন্য কতটুকু সাফল্যমণ্ডিত হতো সেটি বিবেচনার দ্বিতীয় ব্যারোমিটার হতে পারে ঐ অঞ্চলের গণতান্ত্রিক কাঠামোগত অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিষয়টি। আফ্রিকার সবচেয়ে বড় সমস্যা সেখানকার দুর্নীতি। প্রায় প্রতিটি দেশেই আমলারা দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানে গণতন্ত্র মূলত ক্রমবর্ধমান আয় এবং সামগ্রিক কল্যাণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের বস্তুগত সমৃদ্ধির মাধ্যমেই টিকে রয়েছে। এই কারণেই দিন দিন দুর্নীতি কমার পরিবর্তে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যেসব দেশে যোগাযোগব্যবস্থা ভাল এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা নিরাপদ, সেসব দেশের সম্ভাবনাময় যুবসমাজ সহিংস বিদ্রোহী সংগঠনের প্রতি মনোযোগ কম দেবে। উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুরের কথাই বলা যায়। সেখানকার আমলাদের বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা এতই ভালো যে তারা কখনোই জনগণের গচ্ছিত অর্থ লুটপাটের কথা ভাবেন না। কিন্তু আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশেরই অর্থনৈতিক কাঠামো সমৃদ্ধির বিপরীতে তলানিতে যাচ্ছে, যা যুবসমাজকে বিপথগামী করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য অবশ্যই একটি সচেতন এবং সমৃদ্ধ নাগরিক কাঠামো গঠনের প্রয়োজন, যা স্থানীয় এবং জাতীয় সরকারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করবে। অতএব, অনুষ্ঠিত এই গণতন্ত্র সম্মেলন আফ্রিকা অঞ্চলে বস্তুগত সমৃদ্ধি বৃদ্ধির মাধ্যমে গণতন্ত্রের কাঠামোগত অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে কতটা সাহায্য করবে, তা সম্মেলন-পরবর্তী সফলতাকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
২০২১ সালের শেষদিকে এসেও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনও ভ্যাকসিনের আওতায় আসেনি এটি খুবই দুঃখজনক। আর ঠিক এই জায়গায় এসে আফ্রিকার পাশে দাঁড়াতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভ্যাকসিন রাজনীতির দিকে তাকালে বোঝা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং বিপণনে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিতে। আর ঠিক এই জায়গাতেই সাহায্য খুঁজে বেড়াচ্ছে আফ্রিকা। জো বাইডেন ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশে আমেরিকার উৎপাদিত ভ্যাকসিন পৌঁছে দিতে কংগ্রেসে আলোচনা করেছেন। হয়তো তার প্রশাসন ভাবছে এই প্রক্রিয়ায় নতুন করে পৌঁছানো যাবে কিছু অঞ্চলে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন এবং রাশিয়া আগে থেকে কর্তৃত্ব করছে। আফ্রিকা সেসবের মধ্যে অন্যতম। আরো একধাপ অগ্রগতি হতে পারে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, কর ফাঁকি দেয়া বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লাগাম টেনে ধরতে পারে। কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর অবৈধভাবে শুধুমাত্র আফ্রিকা থেকে ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করে, যা দিয়ে গোটা মহাদেশে জনসাধারণের পরিষেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।
ইউরোপ
আফ্রিকার যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে দরকার, সেখানে ইউরোপ বরাবরই দূরে থাকতে চায়। নতুন করে বৈশ্বিক নেতৃত্বে জো বাইডেন তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তনে কিছুটা অনীহা রয়েছে ইউরোপিয়ান দেশসমূহের। বেইজিং এবং ওয়াশিংটন যে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন পরিচালনায় মগ্ন, তা থেকে নিজেদের বরাবরই নিরাপদে রাখতে পছন্দ করে ইউরোপ। এই শীর্ষ সম্মেলনের আগে থেকেই ইউরোপের অনেক দেশ বর্তমান জটিল বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সম্মেলনের মূলমন্ত্র ঠিক কতটুকু কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে, সেই বিষয়ে সন্দিহান ছিল। সম্মেলনের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল ‘বিশ্বকে এমনভাবে গণতন্ত্রে বিভক্ত করা যাতে করে অগণতান্ত্রিক কোনো বিষয়ে জড়িত হতে না পারে।’ আর এখানেই আপত্তি ছিল অনেক ইউরোপিয়ান রাজনীতিবিদের। তারা মনে করেন, এই ধরনের মূলমন্ত্রের উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত যেকোনো শীর্ষ সম্মেলন অংশগ্রহণকারীদের বড়জোর সান্ত্বনা দিতে পারে, কিন্তু ব্যাপকভাবে এটি মূলত কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
অনেক ইউরোপিয়ান নেতা মনে করেন, সম্মেলনের মূলমন্ত্র বিশ্বকে বিভক্ত করে দেবে। কারণ জলবায়ু সংকট এবং বৈশ্বিক মহামারির প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক উভয়ের মধ্যেই সমন্বয়ের প্রয়োজন। সব ইউরোপিয়ান নেতৃবৃন্দ যে বাইডেনের সম্মেলনের সমালোচনা করেছেন তা-ও কিন্তু না। অনেকেই আবার উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন জানিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্র এবং নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি জোসেপ বোরেলের বিষয়টি উল্লেখ করা যাক। তিনি জো বাইডেনের এই সম্মেলনের সমর্থন জানান এবং এতে যোগদানের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের আহ্বান করেন। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এই ধরনের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ বলতে বিশ্বকে বিভক্ত করার পরিবর্তে সাহায্য সহযোগিতা বৃদ্ধির সুযোগ হিসেবে দেখেন। কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল সম্মেলনে কথার পরিবর্তে কাজের দিকে বেশি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়ে। অন্যথায় আফ্রিকা কিংবা ইউরোপ যেকোনো অঞ্চলের প্রেক্ষাপটেই গণতন্ত্র কখনোই প্রমাণ করতে পারবে না যে এটি ইতিবাচক পরিবর্তনের যোগ্য ইঞ্জিন। আর এমন একটি সময়ে এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে, তখন ইউরোপিয়ানদের নিকট সম্মেলন কিছুটা কম গুরুত্ববহ হওয়া স্বাভাবিক।
একদিকে, ইউরোপের ভবিষ্যতের জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিচালিত সম্মেলন ইউরোপিয়ানদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরির কথা বলে। অন্যদিকে প্রশ্ন আসতে পারে- আফগানিস্তান, ইথিওপিয়া, মায়ানমার এবং সুদানের মতো গণতান্ত্রিক সংকটে থাকা দেশগুলোতে মূল সমস্যা সমাধানে কিংবা মোকাবেলায় ঠিক কতটুকু সাহায্য করতে পারে। জো বাইডেনের সম্মেলনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরিকে অগণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা ইউরোপের অনেক দেশই ভাল চোখে দেখেনি। তবে শেষপর্যন্ত আটলান্টিক অঞ্চলে জো বাইডেনের সম্মেলনের প্রতি আস্থা ফিরতে পারত, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব গণতান্ত্রিক ত্রুটিগুলো স্বীকার এবং উন্নত করার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অবশ্যই বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কাজ করে বা করতে চায়, কিন্তু এটি কখনোই এই কাজের নেতৃত্বে মার্কিনিদের বিশ্বাস করে না। আর তাই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, শুধুমাত্র উপদেশ দিয়ে নয়, বরঞ্চ ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করতে সমানভাবে কাজ করার লক্ষ্য থাকলে অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তরভাবে ইউরোপকে কাজে পেতে পারত। অদূর ভবিষ্যতে বোঝা যাবে জো বাইডেন তথা মার্কিনিরা সে সুযোগ হাতছাড়া করেছে কিনা।
দক্ষিণ এশিয়া
এশিয়ার এই অঞ্চলটি যেমন বরাবরই বিভক্ত তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। অন্ততপক্ষে বিগত কয়েক বছরের প্রেক্ষাপটে তা বলাই যায়। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমায় চীনের বলয় সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়াতে। তাই বলা যায়, কর্তৃত্ববাদের জোয়ার এবং পিছিয়ে পড়া গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর একটি বিস্তৃত সম্মেলন বা আলোচনা স্বত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় বিষয়টি কতটা কার্যকর হবে সেই বিষয়ে সন্দিহান অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। প্রথমত, সমালোচকরা যুক্তি দেন যে ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রচারের আগে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই তার নিজের ঘাটতিগুলো পূরণ করতে হবে। কারণ, এই অঞ্চলের মানুষ ভাবে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি গণতন্ত্রের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছে। দেশটিতে নাগরিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডম হাউজের ফলাফল এখন মঙ্গোলিয়ার মতো নতুন গণতান্ত্রিক দেশের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে। আর তাই দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বলা চলে- দেশসমূহ ওয়াশিংটনের নেতৃত্ব অনুসরণে আগ্রহ হারিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন দাবি করেছে- গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি একটি অঙ্গীকার হলো ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং দেশ পরিচালনার মূল ভিত্তি। এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে- বাইডেন ভারতকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অথচ বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে দেশটির গণতন্ত্রের স্থির অবক্ষয়ের বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার মতো। এই প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনের নীরবতা মূলত ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিনিদের নীরব থাকার মূল কারণ এই অঞ্চলে চীনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত, যারা পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করছে। সম্প্রতি মোদি সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে ভারতের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম ধর্মাবলম্বীর উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে হামলা, দমন-পীড়ন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার মতো অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এখন ফ্রিডম হাউজের তালিকায় ‘মুক্ত’ থেকে ‘আংশিক মুক্ত’ অবস্থানে নেমে গেছে। অতএব, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে- ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বন্ধু ব্যতীত কিছুই নয়। আর তাই জো বাইডেন গণতন্ত্র সম্মেলনের পূর্বে ভারতের গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের পরিপ্রেক্ষিতে নিন্দা জানিয়ে সততার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন বলে মনে করে না কেউ।
তৃতীয়ত, ফ্রিডম হাউজের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সকল দেশে ‘আংশিক মুক্ত’ গণতান্ত্রিক অবস্থা বিরাজমান। আর তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মেলনে আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিবর্তে কৌশলগত বিষয়কে প্রাধান্য দিয়েছে তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। ভারত ছাড়াও এই অঞ্চল থেকে ডাক পাওয়া আরেক দেশ মালদ্বীপ, যেখানে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধীরা জয়লাভ করে ক্ষমতায় এসেছে। অতঃপর রয়েছে নেপাল, দেশটিতে রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পর একাধিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আবার ২০১৫ সালের পর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির তুলনামূলক উন্নতি হওয়ার সত্ত্বেও আমন্ত্রণ পায়নি শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শ্রীলঙ্কায় চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ এবং সখ্যের কারণেই এমনটা ঘটতে পারে। একই যুক্তি দাঁড় করানো যায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। ২০০৯ সালের পর আরো দুটি নির্বাচনে জয় লাভ করা আওয়ামী লীগ সরকার শাসন করছে বাংলাদেশকে। এখানেও চীনের বড়সড় বিনিয়োগ রয়েছে, যা দিন দিন আরো বাড়ছে।
যদিও সকল কিছুকে পেছনে ফেলে অবাক করেছে গণতন্ত্র সম্মেলনে পাকিস্তানের ডাক পাওয়ার বিষয়টি। ফ্রিডম হাউজের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম স্কোর পাওয়া দেশটি আবার এই অঞ্চলে চীনের সবচেয়ে বড় মিত্র, যার শাসকগোষ্ঠীর মূলে রয়েছে সেনাবাহিনী। অনেকের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান এবং আফগান সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ রূখতে পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগত হলেও দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে থাকা দেশগুলোর জন্য ভাবার মতো বিষয় ছিল। কারণ, দেশটির রাজনীতি এবং অর্থনীতি প্রতিদিনই নিচের দিকে নামছে, সেই সাথে সখ্য বাড়ছে চীনের সঙ্গে, যারা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাইডেন প্রশাসন যদি সত্যিই দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রের বিষয়ে উদ্বিগ্নতা দেখায়, তাহলে তাদের প্রথমেই মানবাধিকার রক্ষায় ভারতের মোকাবেলা করতে হবে, যার শুরু কাশ্মীর বিষয় দিয়ে। কিন্তু তারা সেটি করবে বলে মনে হয় না। আবার ভবিষ্যতের সকল গণতান্ত্রিক অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কাকে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে সেখানকার নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সজাগ থাকেন। তবে চীনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি জোট গড়ার ক্ষেত্রে দুটি দেশকে বাদ দেয়াটা কৌশলগত কারণ হলেও এটি ঠিক কতটুক যুক্তিযুক্ত সেটাও ভাবতে হবে কারণ বেইজিংয়ের নিকটে এসে ওয়াশিংটনের বলয় কতোদিন বা একরকম থাকবে? আবার চীনের বন্ধু পাকিস্তানকে পাশে পাওয়ার যে স্বপ্ন সেটিও বা ভবিষ্যতে কতটুক বাস্তবায়ন হবে সেটিও ভাবার বিষয়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জো বাইডেনের পক্ষে এই অঞ্চলে নেতৃত্ব দেয়া দিবাস্বপ্নের মতো।
লাতিন আমেরিকা
এটা জানা কথা যে, লাতিন আমেরিকার অসংখ্য দেশ গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণে ভুগছে। সেখানকার গণতান্ত্রিক অবস্থা শক্তিশালী করতে হলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো দরকার। আর তাই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন হতে পারত সেখানকার জন্য নতুন একটি সমাধানের পথ, যাতে করে সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে জানানো যেতে পারে। অস্বাভাবিকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও যে গণতান্ত্রিক সংকট চলছে তার প্রকৃত উদাহরণ ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে হামলার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। সর্বোপরি, তাদের নিজেদের অবস্থা যখন শোচনীয়, তখন নিকটতম অঞ্চলের নেতৃত্ব দেয়া অবশ্যই সহজতম কাজ নয় জো বাইডেন প্রশাসনের জন্য। এখানে অবশ্য শুধুমাত্র ডেমোক্রেট সরকার প্রধানের ব্যর্থতা নয়, বরঞ্চ ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনও সেখানকার লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় লাতিন আমেরিকান দেশগুলো খুবই আত্মকেন্দ্রিক। মূলত চীনের সঙ্গে এই অঞ্চলের ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব আরো বেশি তৈরি হয়েছে বা প্রতিনিয়ত হচ্ছে। আর তাই অনেক লাতিন আমেরিকান দেশ গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পায়নি। এমনকি, ব্রাজিলের যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত প্রেসিডেন্টকেও প্রাথমিকভাবে ডাকেনি বাইডেন প্রশাসন। পরবর্তীতে অবশ্য ১১২ তম দেশ হিসেবে ডাক পেয়েছিল এই ব্রাজিল। আঞ্চলিক রাজনীতি, গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিবর্তে লাতিন নেতারা গণতান্ত্রিক অবক্ষয়ের অভ্যন্তরীণ পরিচালনায় বেশি মনোনিবেশ করেছেন বলে বোঝা যাচ্ছে। বর্তমানে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক শোচনীয় অবস্থার কারণে সাধারণ মানুষ নাগরিকসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক নির্বাচনে চিলিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি লক্ষণীয়! একই পথে হাঁটছে ব্রাজিল, বলিভিয়া এবং কলম্বিয়া।
তবে এখানে সবচেয়ে বেশি ভাবার বিষয় ছিল এই শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান চীনা এবং রাশিয়ান প্রভাব নিয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে কিনা সেই বিষয়টি। আর যদি উদ্দেশ্য এটা থাকে, তাহলে অবশ্যই লাতিন আমরিকায় নেতৃত্ব দেয়ার পরিবর্তে দূরত্ব বাড়বে। লাতিন আমেরিকান দেশসমূহের মধ্যে সবার প্রথমে আমন্ত্রণ পেয়েছিল উরুগুয়ে, কোস্টারিকা এবং চিলি। এল সালভাদর, গুয়াতেমালা এবং হন্ডুরাসকেও ডাকা হয়নি সম্মেলনে। মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী সংকটের প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত দেশসমূহকে কৌশলগতভাবেই বাদ দেয়া হয়েছিল বলে ধারণা অনেক বিশ্লেষকের। তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মেক্সিকোর গণতান্ত্রিক রেকর্ড দিন দিন তলানিতে গেলেও তাদের আমন্ত্রণ জানাতে ভোলেনি বাইডেন প্রশাসন। যদিও অভিবাসীদের প্রবেশপত্র খ্যাত দেশগুলোকে বাদ দিয়ে অভিবাসীদের প্রবেশদ্বার তথা মেক্সিকোর আমন্ত্রণ পাওয়াকে ভালো চোখে দেখেনি অনেক লাতিন নেতা।