একের পর এক সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে, স্বৈরশাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে আধুনিক যুগে জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের সাথে সাথে শাসনব্যবস্থা হিসেবে উত্থান ঘটেছে গণতন্ত্রের। নগররাষ্ট্রের যুগে যেখানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের চর্চা হতো, রাষ্ট্রের আকার বড় হওয়ার আধুনিক যুগের জাতিরাষ্ট্রে সে স্থানটি দখল করেছে পরোক্ষ গণতন্ত্র।
সাম্য, রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর আইনের শাসনের স্বপ্ন নিয়ে একের পর এক দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছে, চেষ্টা করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নিশ্চিত করার। নির্দিষ্ট সময় পরপর সুষ্ঠু নির্বাচন করে, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করে, মানবাধিকার নিশ্চিত করে অনেক রাষ্ট্রই গণতন্ত্রের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পেরেছে।
এরিস্টটলের শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে দেখানো হয়েছে অযোগ্যদের শাসন হিসেবে, চতুর দরিদ্রদের রাষ্ট্রকাঠামো কাজে লাগিয়ে সম্পদশালী হওয়ার সুযোগ হিসেবে। অনেক রাষ্ট্রই পূরণ করতে পারে না নাগরিক অধিকার, নিশ্চয়তা দিতে পারে না আইনের শাসনের, নিশ্চিত করতে পারে না বাকস্বাধীনতা আর অর্থনৈতিক সাম্যের অধিকার। বরং সে জায়গায় সুবিধা পায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা শ্রেণী, যারা অবৈধ সুবিধা নিয়ে সম্পদ পুঞ্জিভূত করে, বাড়িয়ে দেয় সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বৈষম্য। ফলে ধীরে ধীরে পতন ঘটতে থাকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের, জনগণ আস্থা হারায় গণতান্ত্রিক সরকারের উপর।
রাষ্ট্রের এই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো পূরণ করতে পারার ব্যর্থতার পেছনে কাজ করে অনেকগুলো প্রভাবক, অনেকগুলো স্বার্থগোষ্ঠী আর শাসকশ্রেণীর ক্ষমতায় থাকার লিপ্সা। এই লেখাটিতে গণতন্ত্রের পতনের প্রভাবকগুলোকে নিয়ে আলোচনা করা হবে।
এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা
জাতিরাষ্ট্রের যুগে বিশাল বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে রাষ্ট্র, তৈরি হয়েছে সীমান্ত। জাতীয়তাবাদ হতে পারে ভাষাভিত্তিক, হতে পারে ধর্মভিত্তিক, হতে পারে অর্থনীতিভিত্তিক কিংবা অঞ্চলভিত্তিক। এই জাতীয়তাবাদের উপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের আকার বড় বা ছোট হওয়া। আধুনিক যুগে যেহেতু পরোক্ষ গণতন্ত্র চালু আছে, সেহেতু গণতান্ত্রিক কাঠামো টিকে থাকা অনেকটা নির্ভর করে এই পরোক্ষ গণতন্ত্র আসলে কীভাবে কাজ করছে, তার উপর।
এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা দেখা গেছে, দেখা গেছে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থাও। যেসব দেশে এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা আছে, সেসব দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দ্রুত হয়, সকল ক্ষমতা কেন্দ্রে থাকায় সরকারপ্রধান কাঠামোর উপর নির্ভর না করে নিজের চিন্তাচেতনা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, চর্চা করেন অসীম ক্ষমতার। একটা সময় পতন হয় গণতন্ত্রের।
সাংবিধানিক দুর্বলতা
গণতান্ত্রিক কাঠামোতে নাগরিকদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে সংবিধান, নিশ্চয়তা দেয় মৌলিক অধিকার আর নাগরিক অধিকার প্রাপ্তির। সংবিধানে দুর্বলতা থাকলে সেটা নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা, ভোট দেওয়ার অধিকারের মতো নাগরিক অধিকারগুলো ধ্বংস করে, পতন ঘটায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের।
সদ্যস্বাধীন দেশগুলো যেমন এই সমস্যা ভোগে, একইসাথে যেসব দেশে যোগ্য নেতৃত্ব থাকে না , রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি থাকে না, সেসব দেশও এই সমস্যায় ভোগে। ভূমিকা আছে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক আমলাদের, সামরিক বাহিনী আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোরও।
সংবিধান অনুযায়ী, মায়ানমারের পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। ফলে, সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হচ্ছে না, গণতান্ত্রিক সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা
প্রেসিডেন্টশাসিত দেশগুলোতে প্রেসিডেন্ট সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন, দায়িত্ব পালন করেন সরকারপ্রধান হিসেবেও। ফলে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো তিনি তার পছন্দমতো কিচেন কেবিনেটের মাধ্যমে তৈরি করেন। তার দায়বদ্ধতা থাকে না আইনসভার প্রতি, জবাবদিহিতার জায়গাটিও তাই কম। ফলে, আইনসভা কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারলে প্রেসিডেন্ট ধীরে ধীরে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন, পতন ঘটে গণতন্ত্রের।
অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা
রাজনীতিবিদেরা রাজনীতিতে আসেন আদর্শের জন্য, আসেন স্বার্থের জন্যও। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে শাসনকার্যে সাধারণত দেখা যায় চতুর ব্যক্তিদের, যাদের মূল লক্ষ্যই থাকে অর্থ উপার্জন। তারা ক্ষমতায় এসেই যুক্ত হন সীমাহীন অনিয়ম আর দুর্নীতিতে, কেন্দ্রীভূত করে ফেলে সকল সম্পদ। এভাবে শ্রেণী বৈষম্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটের মধ্যে পড়ে; জনগণ ধীরে ধীরে আস্থা হারায় গণতন্ত্রের প্রতি।
অবতারবাদ
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সময় নেতাকে তার অনুসারীরা অবতারের মতো শ্রদ্ধা করে, তাকে ভুল-ভ্রান্তির উর্ধ্বে বলে বিবেচনা করে, তার নীতি, আদর্শ, বক্তব্যকে অভ্রান্ত মনে করে, অন্ধভাবে অনুসরণ করে তার নির্দেশকে। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এমন হলে সেটাকে রাজনৈতিক অবতারবাদ বলে। ফলে দেশের পুরো কাঠামোটি হয়ে পড়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, জনগণের সমষ্টির শাসনের চেয়ে দেশ হয়ে ওঠে ব্যক্তির শাসনের ক্ষেত্র, নেতা পান সীমাহীন ক্ষমতা চর্চার সুযোগ, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই হয় রাষ্ট্রের মূলনীতি। ফলে, পতন হয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা তাদের শাসনামলকে মসৃণ করতে অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি করেন।
নির্বাচনে হস্তক্ষেপ
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন, জনগণ ভোট প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানা কারণে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ঘটনা ঘটছে। কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ঘটনা ঘটছে, পরাশক্তিগুলো আবার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে করছে হস্তক্ষেপ। রাশিয়ার গণতন্ত্রকে অনেকে ‘ম্যানেজড ডেমোক্রেসি’ বলে, রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের নির্বাচনেও। এই ঘটনাগুলো জনগণের চিন্তাকে প্রভাবিত করে, অনেক সময় রায় বদলে দেয়।
ধনবানদের বিপক্ষে পদক্ষেপ নেওয়া
প্রতিটি রাজনৈতিক কাঠামোতে বিত্তশালীদের প্রভাব থাকে, থাকে তাদের স্বার্থ লালন করা শাসকগোষ্ঠী। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বড় বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ভূমিকা রাখছে রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তনে, ভূমিকা আছে শিল্পপতিগোষ্ঠীরও। মৌলিক বিষয়গুলোতে তাদের স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ নিলে অনেক সময়ই তারা হস্তক্ষেপ করে, তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো যার বড় শিকার। বলিভিয়ায় সর্বশেষ সরকার পতনের পেছনেও কাজ করেছে এই স্বার্থগোষ্ঠীগুলো, বলিভিয়াকে ঠেলে দিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে।
বিদেশী শক্তির প্রভাব
পরাশক্তিগুলো সবসময় নিজেদের উপস্থাপন করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক ও বাহক হিসেবে, মানবাধিকার আর বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার পক্ষ হিসেবে। কিন্তু বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়ও এই পরাশক্তিগুলোর প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা রয়েছে, রয়েছে স্বার্থ বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা। এর ফলেও অনেক সময় গণতন্ত্রের পতন হয়।
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ড. মোসাদ্দেকের সরকারকে, দীর্ঘদিন তাদের ছত্রছায়ায় টিকে থেকে জেনারেল সুহার্তোর মতো স্বৈরশাসকেরা। স্নায়ুযুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন দেশে বসিয়েছে অনির্বাচিত সরকার।
নাগরিকদের মধ্যে স্থায়ী বিভাজন
বর্তমান সময়ে জনতুষ্টিবাদী নেতাদের উত্থান ঘটছে; ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে তারা আসছে ক্ষমতায়। বিভাজনের রাজনীতি খেলা এই নেতাদের পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে ধর্ম, বর্ণ নিয়ে বিভাজন তৈরি করে রাজনীতি করা নেতাও। ফলে পুরো গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ভোটকে কেন্দ্র করে নাগরিক বিভাজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে উঠছে।
এই বিভাজন সংখ্যালঘুদের অধিকার বাধাগ্রস্ত করে, সংখ্যাগরিষ্ঠকে লেলিয়ে দেয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। এই উদাহরণ বিশ্বের সবচে’ বড় গণতন্ত্রের দেশে রয়েছে, রয়েছে ক্ষুদ্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতেও।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার ইতিহাস
রাষ্ট্রকাঠামোতে গণতন্ত্রের এই জয়জয়কারের যুগেও বিভিন্ন দেশে আছে রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, অভিজাততন্ত্রের মতো শাসনব্যবস্থা। একটা দেশ যখন দীর্ঘদিন এরকম কাঠামোগুলোতে থাকে, তখন হঠাৎ করেই সেখানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে গণতন্ত্র টেকসই হয় না।
রাজতন্ত্রের পতনের রাশিয়া একটা দীর্ঘসময় অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে ছিলো। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলেও গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা সেখানে বেশি দিন টেকেনি। একবিংশ শতাব্দীতে তারা হাইব্রিড রেজিমে পরিণত হয়েছে।
আবার মিশর একটা দীর্ঘসময় ধরে স্বৈরশাসকের অধীনে ছিলো। আরব বসন্তের পর সেখানে গণতান্ত্রিক সরকার আসলেও দ্রুতই বিরোধী দলগুলোর আস্থার সংকটের সুযোগ নিয়ে ফিরে আসে সামরিক সরকার, স্বৈরতন্ত্র।