প্রকৃত শত্রু ছাড়া কখনো প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। আমরা যেসব বৈশিষ্ট্য ধারণ করি না, সেগুলোকে ঘৃণা না করা পর্যন্ত আমরা যেসব বৈশিষ্ট্য ধারণ করি, সেগুলোকে ভালবাসতে পারবো না। শতাব্দী পরে আমরা এই সত্যগুলো আবিষ্কার করতে পারছি, যন্ত্রণার সাথে যেগুলো সংবেদনশীলতা তৈরি করছে। যারা তাদের পরিবার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জন্মগত অধিকার অস্বীকার করে, তারা আসলে দাস। তাদের সহজে ক্ষমা করা উচিত না।
– মাইকেল দিবদিন (ডেড লাগোন)
পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অর্ধশতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা হয়, পরিবর্তন আসে মানুষের পরিচয়ের (আইডেন্টিটি) ধারণাতেও। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন যুগে মানুষের পরিচয়ের ধারণা রাজনৈতিক মতাদর্শ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কিংবা ভৌগলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে তৈরি হচ্ছে না। মানুষের পরিচয় তৈরি হচ্ছে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মাধ্যমে, যে সাংস্কৃতিক সীমারেখাগুলো সভ্যতার ধারণা তৈরি করে।
সভ্যতার সংঘাত ও বৈশ্বিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন
স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের সাড়াজাগানো বই ‘The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order’ ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশের পূর্বেই হান্টিংটন ফরেন অ্যাফেয়ার্সে ‘The Clash of Civilizations?’ শিরোনামে একটি একাডেমিক আর্টিকেল প্রকাশ করেন। সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে মূল কাঠামো ধরে এই বইয়ে হান্টিংটন আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন কাঠামো ব্যাখ্যা করেছেন, তুলে ধরেছেন সংঘাতের সম্ভাব্য লাইনগুলো।
স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে মানুষ নিজের আইডেন্টিটির সন্ধান করছে, একইসাথে নিজেদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়কে পুনরায় প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। পরিচয় সন্ধানের এই প্রক্রিয়ায় একটি প্রাসঙ্গিক উপাদান হলো ‘শত্রু’। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে শত্রু তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শ আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ভিন্নমত থেকে, স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধে শত্রু তৈরি হবে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে, সংঘাত ঘটবে বড় বড় সভ্যতাগুলোর মধ্যে।
স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন তার বই ‘The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order’-এ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন যুগের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন।
বহুমেরু ও বহু-সভ্যতার পৃথিবী
মানবসভ্যতা যাত্রা শুরুর পর থেকেই বহু বড় বড় সভ্যতার উত্থান দেখেছে, দেখেছে শক্তিশালী সভ্যতার পতন। আধুনিক যুগ শুরুর আগপর্যন্ত এই সভ্যতার সাথে আরেক সভ্যতার যোগাযোগ ঘটেছে কম, শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনে উদ্দেশ্য ছাড়া এক সভ্যতার সাথে আরেক সভ্যতার সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে কম। আধুনিক যুগ শুরুর আগে কোনো সভ্যতাই সেদিক থেকে হিজিমন হতে পারেনি।
ষোড়শ শতাব্দী থেকেই আধুনিক যুগের যাত্রা শুরুয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাঠামো হয় বহুমেরুর। পাশ্চাত্য (ওয়েস্টার্ন) সভ্যতার দেশগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে যুক্ত হয়, বিভিন্ন প্রান্তে ভূমি বিজয় করে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করে, অন্যান্য সভ্যতার উপর নিজেদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। ইউরোপের বাইরে এই প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন সংঘাতে জড়ায়, জড়ায় একের পর এক বহুবর্ষব্যাপী যুদ্ধে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই বহুমেরু কাঠামোর অবসান ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, শুরু হয় দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থার যুগ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে মানবসভ্যতায় তিনটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল- গণতন্ত্র, কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদ। ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিস্ট শাসকদের পতনের সাথে সাথে পতন ঘটে ফ্যাসিবাদের, মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মতবাদ হওয়ার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে গণতন্ত্র ও কমিউনিজমের মধ্যে।
দুটি মতাদর্শের ভিত্তিতে পুরো পৃথিবী তিনটি ব্লকে ভাগ হয়। তুলনামূলকভাবে ধনী ও গণতান্ত্রিক দেশগুলো আদর্শিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিযোগিতায় যুদ্ধ হয় তুলনামূলকভাবে অর্থনীতিতে কম শক্তিশালী কমিউনিস্ট দেশগুলোর সাথে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র, কমিউনিস্ট বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দু’পক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলেও তাদের অধিকাংশ সংঘাতের যুদ্ধক্ষেত্র হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে স্বাধীন হয়েছে, এসব দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কম।
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে মানুষের পরিচয়ের, রাষ্ট্রের কার্যকলাপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল দেশটি কোন ব্লকের, সেই নাগরিক কোন ব্লকের। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মানুষের পরিচয়ের মূল জায়গায় এসেছে ধর্মীয় পরিচয়, ভাষা, ইতিহাস, মূল্যবোধ, প্রথা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ। বৃহত্তর পরিসরে মানুষ নিজের পরিচয় দেয় সভ্যতার আলোকে।
স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন এরকম প্রধান কিছু সভ্যতার কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতা, সিনিক সভ্যতা, জাপানী সভ্যতা, হিন্দু সভ্যতা, ইসলামী সভ্যতা, অর্থোডক্স সভ্যতা, এবং লাতিন আমেরিকান সভ্যতা। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সভ্যতার পরিচয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ায় বৈশ্বিক রাজনৈতিক কাঠামোর বহুমেরুকরণ ঘটেছে। মানুষ রাজনীতিতে কেবল অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্যই জড়াচ্ছে না, রাজনীতিতে জড়াচ্ছে নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্যও।
নতুন বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর বিপদজ্জনক সংঘাতগুলো সামাজিক শ্রেণির মধ্যে হবে না, হবে না ধনী আর দরিদ্রের মধ্যেও। বরং, সংঘাত হবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা বিভিন্ন সভ্যতার মানুষের মধ্যে। সভ্যতার বর্তমান কাঠামোর মধ্যেও সংঘাত হবে। দেশে দেশে সংঘাত হবে, সংঘাত হবে দেশের অভ্যন্তরেও। মায়ানমারের জাতিগত সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শরণার্থীর ঢল তৈরি করছে, শরণার্থী যাচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে রুয়ান্ডার হুতু আর তুতসিদের সংঘাতের ক্ষেত্রেও, শরণার্থী সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আফ্রিকার উগান্ডা আর বুরুন্ডির মতো দেশগুলোকেও। কিন্তু এই ধরনের সংঘাত বৈশ্বিক পরিসরে ছড়িয়ে যাবে না, বৈশ্বিক সংঘাতের সম্ভাবনাও তৈরি করে না।
শক্তিসাম্যের পরিবর্তন
আধুনিক যুগের পুরো সময় জুড়েই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হিজিমোনিক ভূমিকা রেখেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলো, নিয়মতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের হাতেই গড়ে ওঠা। আন্তর্জাতিক কাঠামো বহুমেরু থাকাবস্থাতে ইউরোপীয় দেশগুলোই নেতৃত্ব দিয়েছে, দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থাতেও নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় থেকেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোই। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর প্রভাব কমছে, বাড়ছে এশিয়ার বিভিন্ন সভ্যতার প্রভাব।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সামরিক বাহিনী হিসেবে সাত দশকের বেশি সময় পার করেছে, আটশোর বেশি স্টেশনের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে। সাধারণত, সাত দশক থেকে এক শতাব্দীর মধ্যেই সামরিক বাহিনীগুলো তাদের শ্রেষ্ঠত্ব হারায়, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখান থেকে এটি যেকোনো সময় কাঠামোগতভাবে ভেঙে পড়তে পারে। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন তার উপনিবেশ দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই, আফ্রিকা থেকে গুটিয়ে আসতে হয়েছে ফ্রান্সের মতো অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোকেও।
অন্যদিকে, এশিয়ার সভ্যতাগুলোতে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে অর্থনৈতিক আর সামরিক শক্তি। চীন তিন দশকের মধ্যেই অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে, হিন্দু সভ্যতার ধারক ভারতেরও বাড়ছে অর্থনৈতিক সামর্থ্য। মুসলিম বিশ্বের জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে, বাড়ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই সভ্যতার মানুষের বিচরণ। অর্থাৎ, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব ক্রমাগত কমছে, বাড়ছে এশিয়ার সভ্যতাগুলোর প্রভাব।
পাশ্চাত্য মূল্যবোধের বিশ্বায়নে বাধা
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মূল ক্রীড়ানক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জাতিরাষ্ট্রগুলো। জাতিরাষ্ট্রগুলো বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা হলেও, স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলো সভ্যতার আলোকে তাদের স্বার্থ নির্ধারণ করছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে, সংঘাতও তৈরি হবে সভ্যতার পরিচয় কেন্দ্র করেই।
এর মধ্যে, পাশ্চাত্যের দেশগুলো যে মূল্যবোধগুলো বৈশ্বিক বলে দাবি করে, এবং স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রগুলোতে ছড়িয়ে দিতে চায়, সেই মূল্যবোধের বিস্তার বাধাগ্রস্ত হবে। এশিয়ার সভ্যতাগুলোর মধ্যে এই বাধাদানের প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় মুসলিম এবং চীনা সভ্যতাতে। মুসলিম এবং চীনা সভ্যতার নিজস্ব মূল্যবোধ রয়েছে, নিজস্ব শাসনব্যবস্থার সংস্কৃতি রয়েছে, রয়েছে স্বতন্ত্র বিশ্বাস। মূল্যবোধের পার্থক্য বিশ্বব্যবস্থাকে একটি অরাজক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে, যেটি সভ্যতাগুলোর মধ্যকার স্থিতিশীলতাকে গভীরভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।
আমরা এবং তারা
সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ বিভাজিত হয়েছে, নিজের বলয় তৈরি করে আলাদা সত্তা গঠন করেছে। গবেষকরা পৃথিবীকে উত্তর আর দক্ষিণে বিভাজিত করেছেন, অরিয়েন্ট এবং অক্সিডেন্টে বিভাজিত করেছেন, বিভাজিত হয়েছে ধনী আর দরিদ্র দেশ হিসেবেও। মুসলমানরাও পৃথিবীকে দুই ভাগে ভাগ করে: দারুল ইসলাম এবং দারুল হারাব।
অর্থের পার্থক্যই সাধারণত অপরাপর সকল পার্থক্য তৈরি করে। কিন্তু, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ধনী আর দরিদ্র দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ইতিহাসেও দেখা যায়, ধনী আর দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত হয় যখন ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে উপনিবেশ বানাতে চায়, দরিদ্র দেশগুলোর উপর নিপীড়নের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়। পাশাপাশি, দরিদ্র দেশগুলোর শাসকদের মধ্যে রাজনৈতিক বৈধতার সংকট থাকে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকে, কম থাকে সামরিক সক্ষমতাও। ফলে, অর্থনৈতিকভাবে ধনী পৃথিবীর উত্তর প্রান্তে আর দরিদ্র দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যে শ্রেণিযুদ্ধের সম্ভাবনা একক সুখী পৃথিবীর স্বপ্নের মতোই অবাস্তব।
বরং, মানবসভ্যতার মধ্যে সংঘাত হবে আমরা এবং তারা পরিচয়ের ভিত্তিতে। সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্যতার ভিত্তিতে একক সভ্যতার মানুষেরা হবে আমরা, সভ্যতার বাইরের এরা হবে তারা।