আধুনিক যুগের শুরুতে ইউরোপ শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য অংশ থেকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে, ইউরোপের দেশগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু হয় শিল্পক্ষেত্রে সাফল্য আর অর্থনৈতিক সাফল্যের মাধ্যমে। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে সবার আগে পৌঁছায় পর্তুগাল, ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিকে। তাদের অনুগামী হয় আরেক ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, নেদারল্যান্ডস।
দেরিতে পৌঁছালেও আফ্রিকার নিয়ন্ত্রণ পর্তুগিজ আর ডাচদের কাছ থেকে ব্রিটিশ আর ফরাসিদের কাছে চলে যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়ে রাজ্যজয়ের নেশায়, জাতীয় অহংকারজনিত তাড়না থেকে বিস্তার ঘটায় সামরিক সামর্থ্যের, অভিযানের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ে ধর্মপ্রচারের কাজেও। ইউরোপীয় শক্তিগুলো সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল দাসব্যবসার কাজেও; আফ্রিকা মহাদেশ থেকে দাসেরা পাচার হয়েছে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপে।
আফ্রিকাতে প্রথম পর্যায়ে অবশ্য ইউরোপীয় বণিকেরা বাণিজ্যের মাধ্যমেই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন উপনিবেশ অংশগুলোর সাথে। রাষ্ট্রকাঠামো, শাসনতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, শিল্পে হস্তক্ষেপ না করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রাধান্য দিয়েছে পণ্য কিনে বাণিজ্য করাকে। পরবর্তী পর্যায়ে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো অনুসরণ করে উদারনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী নীতি, শাসনতান্ত্রিক ছাড় দিয়ে নিজের জন্য শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য বাধ্য করতে থাকে উপনিবেশ অংশগুলোকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও এক দশকের মধ্যেই স্বাধীনতা অর্জন করে আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় ৪০টি দেশ।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায় তার আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের উপর আলোচনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের আফ্রিকা মহাদেশের বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া চিহ্নিত করেন নবম ঢেউ হিসেবে, ‘ডেমোক্রেটিক ইভল্যুশন ইন হিস্ট্রিক্যাল পার্সপেক্টিভ’ নিবন্ধে।
আফ্রিকা মহাদেশের বিউপনিবেশায়ন (১৯৫৬-৬৮)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অনেক আফ্রিকান। যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো আফ্রিকানদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে। আফ্রিকাতে বিকশিত হওয়া শুরু হয় বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। আফ্রিকা মহাদেশে তখন সবচেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ছিল যুক্তরাজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে করা আটলান্টিক চার্টারের ঘোষণা অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশের উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা প্রদান করলেও আফ্রিকা মহাদেশের স্বাধীনতা প্রদানে আগ্রহী ছিল না ব্রিটিশ সরকার। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন ছিল আফ্রিকান উপনিবেশগুলোর, প্রয়োজন ছিল আফ্রিকাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবকে প্রতিহত করতেও।
আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাজনৈতিক বিক্ষোভ শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক সমাবেশগুলোতে নির্বিচারে হামলা করে শাসনের নৈতিক অধিকার হারায় ইউরোপীয় শাসকেরা। ফলে পরিবর্তনের জোয়ারে ভাসা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা অর্জন কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশদের কাছ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে স্বাধীনতা অর্জন করে সুদান। সুদীর্ঘকাল থেকে মিশরের সাথে সুদানের উত্তর অংশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় যোগাযোগ থাকায় মিশরীয়দের দাবি ছিল, সুদানকে মিসরের অংশ হিসেবে স্বাধীনতা দেওয়া।
রাজনৈতিক কারণে ১৯৫৬ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যে সুদান আত্মপ্রকাশ করে, তার উত্তর আর দক্ষিণ অংশের মধ্যে ছিল সাংস্কৃতিক অসামঞ্জস্য, ছিল জাতিগত ভিন্নতা। পরের বছর, ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে প্রথম সাব-সাহারান দেশ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করে ঘানা। গোল্ডকোস্ট হিসেবে পরিচিত আফ্রিকার এ দেশের স্বাধীনতার বীজ অবশ্য বপন হয়েছিল আরো আগে, প্যান-আফ্রিকান কংগ্রেসের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সাল থেকে শুরু হওয়া স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন পূর্ণতা পায় ১৯৫৭ সালে, ঘানার স্বাধীনতাকামী আর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ মতৈক্যের মাধ্যমে। ১৯৬০ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে নাইজেরিয়া আর সোমালিয়া; পরের বছর তানজানিয়া। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই কেনিয়া, গাম্বিয়া, জাম্বিয়ার মতো প্রায় সবগুলো ব্রিটিশ আফ্রিকান উপনিবেশ স্বাধীনতা অর্জন করে এবং আত্মপ্রকাশ করে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে।
আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রবেশ ঘটে তৃতীয় রিপাবলিকের সময়। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আফ্রিকা যান চল্লিশ হাজার খ্রিষ্টান মিশনারি। ধর্ম বিস্তারের পাশাপাশি একসময় খ্রিষ্টান মিশনারিরা জড়িয়ে পড়েন ব্যবসায়িক কাজের সাথে, ভূমিকা রাখেন ফ্রান্সের সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রেও। দক্ষ প্রশাসন আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত সৈনিকদের বীরত্বে একে একে ফ্রান্সের উপনিবেশ শাসনের অধীনে আসে মৌরিতানিয়া, গায়ানা, সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, নাইজার, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবপলিক, গ্যাবন, ক্যামেরুন, মালি, বেনিন, চাদ, কঙ্গোর মতো দেশগুলো।
ব্রিটেনের পর আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ছিল ফ্রান্স, তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল আফ্রিকার প্রায় ১৫ শতাংশ জনসংখ্যা। অন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো উপনিবেশ অঞ্চলগুলোতে অবকাঠামো, শিক্ষা আর রাষ্ট্রব্যবস্থার উন্নতি ঘটালেও ফ্রান্স এক্ষেত্রে বরাবরই পিছিয়ে থেকেছে রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরির ভয়ে। বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে কম শিক্ষার হার থাকা ১০টি দেশের আটটি ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ। পুরো চারশো বছরের উপনিবেশ শাসনে ফ্রান্স বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিল মাত্র একটি।
ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদের উত্থান আর রাজনৈতিক মুক্তির কামনায় একে একে ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে সবগুলো উপনিবেশ। ভেঙে পড়ে ফ্রান্সের পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোকে নিয়ে নির্মিত শাসনকাঠামো, মুক্ত হয় রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে। তবে, আফ্রিকা মহাদেশে এখনও অর্থনৈতিকভাবে ফ্রান্সের পরোক্ষ উপনিবেশবাদ জারি রয়েছে এবং সাবেক উপনিবেশগুলোতে সংঘটিত অধিকাংশ রাজনৈতিক অস্থিরতায় ফ্রান্সের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
আফ্রিকায় ফ্রান্সের গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ ছিল আলজেরিয়া। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য থাকা এ দেশ ব্যাপক শোষণের শিকার হয় ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনামলে। তবুও এ অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে দ্রুত, শিক্ষিত অংশের মধ্যে তৈরি হয় জাতীয়তাবাদী চেতনা। উপনিবেশ শাসনের নিষ্ঠুরতা, অর্থনৈতিক শোষণ আর অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে বাঁচতে আলজেরিয়ানরা গঠন করেন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, এতে নেতৃত্ব দেন আহমেদ বেন বেল্লা। গণতন্ত্র, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট প্রায় অর্ধযুগ যুদ্ধ করে ফ্রান্সের শাসকদের বিরুদ্ধে। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সাথে সাথে ফরাসিদের শাসন থেকে রাজনৈতিক মুক্তি মেলে আলজেরিয়দের।
ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে সবার আগে সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে আফ্রিকায় আসে পর্তুগিজরা, পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে। দাসব্যবসা আর খনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলনের কাজে জড়িয়ে থাকা পর্তুগিজদের উপনিবেশ শাসনের অধীনে ছিল দুটি দেশ, মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলা। ১৯৭৪ সালে পর্তুগালে বামপন্থীদের বিপ্লবে ক্ষমতা পরিবর্তন হলে স্বাধীনতা অর্জন করে এই দুটি দেশ।
তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পর আফ্রিকা আসে বেলজিয়াম। তাদের অধীনে ছিল রিপাবলিক অভ কঙ্গো, রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডি। ১৮৮৫ সাল থেকে রাজার ব্যক্তিগত সম্পত্তির অংশ হয়ে থাকা কঙ্গো, বেলজিয়াম সরকারের অধীনে যায় ১৯০৮ সালে। রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডি বেলজিয়াম দখল করে ১৯২২ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে কঙ্গোর উপরও। প্যাট্রিক লুমুম্বার নেতৃত্বে মার্কসবাদী ও জাতীয়তাবাদীরা ধাবিত হয় স্বাধীনতার দিকে। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে রিপাবলিক অভ কঙ্গো, এর দু’বছর পর স্বাধীন হয় রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডি।
১৮৮৫ সালের যে বার্লিন সম্মেলনের মাধ্যমে আফ্রিকার ভাগাভাগি হয়েছিল বিভিন্ন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে, তার অংশ ছিল জার্মানি ও ইতালির মতো শক্তিও। জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের দরুন হারায় তার সব আফ্রিকার উপনিবেশ, ইতালি হারায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে।
আধুনিক গণতন্ত্রের নবম ঢেউ
প্রকৃতির রাজ্যের অরাজকতা থেকে বাঁচতে মানুষ যে সামাজিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল, তার প্রাথমিক কারণ ছিল সামষ্টিক নিরাপত্তার ধারণা। রাষ্ট্রব্যবস্থার বিবর্তনের সাথে বহুবার নিরাপত্তার এ ধারণা বিঘ্নিত হয়েছে, রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ধারণ করেছে এ ধারণাই। আফ্রিকা মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করতে আসা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বারবার লঙ্ঘন করেছে মানুষ হিসেবে প্রাকৃতিকভাবে অর্জিত অধিকারগুলো, আফ্রিকানদের বন্দী করে দাস হিসেবে বিক্রি করেছে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ের বিভিন্ন দেশে। ফলে, আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের গুরুত্ব যেমন আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের আলোচনায় রয়েছে, গুরুত্ব রয়েছে মানব সভ্যতার অগ্রগতির আলোচনায়ও।
প্রথমত, রেনেসাঁকেন্দ্রিক ধারণাগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক বিবর্তনে যেভাবে ভূমিকা রেখেছিল, আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জনে একই ভূমিকা পালন করে প্যান-আফ্রিকান সম্মেলন। এ সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রতিনিধিরা দাবি জানান, অন্য সব অঞ্চলের মানুষের মতো আফ্রিকা মহাদেশের মানুষদের সমান অধিকারের স্বীকৃতি দিতে, মানুষ হিসেবে নিজের রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে। দাবি ছিল, আফ্রিকা মহাদেশে যেসব দেশ উপনিবেশ শাসনের অধীনে ছিল, তাদের স্বাধীনতা প্রদানের। প্যান-আফ্রিকান সম্মেলনের এ দাবিগুলো দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে, উন্মেষ ঘটে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের। জাতীয়তাবাদের এ ধারণা পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আফ্রিকার বিভিন্ন জাতি গঠনে।
দ্বিতীয়ত, ১৮৮৫ সালে জার্মান নেতা বিসমার্ক আর ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জুলেফেরির চেষ্টায় অনুষ্ঠিত হওয়া বার্লিন সম্মেলনের মাধ্যমে আফ্রিকা ভাগ হয়েছিল ইউরোপীয় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে। পরবর্তী সময়ে, বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে যখন আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জনের দাবিতে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে, তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় ভূখণ্ডের সীমানা নির্ধারণ। ইউরোপীয়রা একই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে এমন সব জাতিগোষ্ঠী নিয়ে আসে, যাদের মধ্যে হয়তো দীর্ঘদিনের গোষ্ঠীকেন্দ্রিক শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। ফলে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে এসব দেশে জাতিগঠন খুব একটা সুখকর প্রক্রিয়া হয়নি শাসকদের জন্য, অনেক দেশেই গৃহযুদ্ধে জড়িয়েছে সুদানের মতো।
ষাটের দশকে আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়াকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে জাতিরাষ্ট্র গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াতে, যা পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক কাঠামোর দিকে ধাবিত করেছে আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশকে।
তৃতীয়ত, স্বাধীনতা অর্জনের পর সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুযোগে আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের ইন্ধন জুগিয়েছে ফ্রান্সের মতো সাবেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও। লিবিয়াতে একটা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি, দীর্ঘ সামরিক শাসনের অধীনে ছিল তিউনিশিয়া, মরক্কো, সুদান, আলজেরিয়ার মতো দেশগুলোও।
ইউরোপের গণতান্ত্রিক বিবর্তনের পাঠ থেকে বলা যায়, এই সামরিক বাহিনীর শাসনগুলো সাময়িক সময়ের জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত করলেও দীর্ঘমেয়াদে সামরিক শাসনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা ভূমিকা রাখে জাতীয়তাবাদের বিকাশে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায়। এ প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্র এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকাতে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে হাঁটছে আফ্রিকা মহাদেশের আরেক দেশ তিউনিশিয়া। এসব প্রক্রিয়ার পেছনে ষাটের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর আলোচনা বিবেচনায় নিলে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে স্বাধীনতা অর্জনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়।
চতুর্থত, ষাটের দশকের রাজনৈতিক ঘটনাবলিতে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে উত্থান ঘটে বেশ কয়েকজন জাতীয়তাবাদী নেতার। জুমো কেনিয়াত্তা নেতৃত্ব দেন কেনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের, প্যাট্রিক লুমুম্বা অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অভ কঙ্গোর। ঘানা স্বাধীনতা আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকায় আবির্ভূত হন নক্রুমা, তানজানিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন জুলিয়াস নায়ারে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেন্দ্রিক পরিবর্তনের আলোচনায় গুরুত্বের সাথে উঠে আসবে নেলসন ম্যান্ডেলার নাম, আফ্রিকানদের অধিকার আদায়ে যিনি সংগ্রাম করেছেন দীর্ঘদিন, পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। এই জাতীয়তাবাদী নেতারা আফ্রিকানদের স্বাধীনতা অর্জনের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহগুলোকে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, মানুষের মধ্যে উন্মেষ ঘটিয়েছেন জাতীয়তাবাদী চেতনা। এ প্রভাব বজায় থেকেছে পরবর্তী কয়েক দশকে, বিরাজ করছে এখনও।
আটলান্টিক রেভল্যুশন থেকে ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে বিবর্তিত হয়েছে আধুনিক গণতন্ত্র, শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের পরিধি সম্প্রসারিত হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। ষাটের দশকে আফ্রিকার বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আফ্রিকানদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে, সুশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। আধুনিক গণতন্ত্র এ পর্বের পরেও আরো বেশ কয়েকটি বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে, কমিউনিজমকে সরিয়ে দিয়ে একক মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয়েছে গণতন্ত্র।