ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যান্য অংশের মতো মিয়ানমারও একটা দীর্ঘ সময় থেকে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল, যারা স্বাধীনতা পায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বেই মিয়ানমারে শুরু হয় রাজনৈতিক সংঘাত, গুপ্তহত্যার শিকার হন স্বাধীনতাকামী বেশ কয়েকজন নেতা। এদেরই একজন ছিলেন জেনারেল অং সান, যিনি পরিচিত মিয়ানমারের স্বাধীনতার জনক হিসেবে। এই গুপ্তহত্যার ছয় মাস পরেই, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত পায় মিয়ানমার। ফেডারেল কাঠামো নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই, বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। এই সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যেও বেসামরিক সরকার প্রায় এক দশক শাসন করে মিয়ানমারকে।
ষাটের দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাড়তে থাকে সামরিক অভ্যুথানের সংখ্যা, যার অনেকগুলোতে সফল হয়ে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ পায় ক্ষমতারও। এই সামরিকায়নের ধাক্কা লাগে মিয়ানমারে। ১৯৬২ সালে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। সোসালিস্ট মতাদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে শাসনক্ষমতা দখল করা সামরিক বাহিনী মিয়ানমারে প্রবর্তন করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা, নিষিদ্ধ করে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, ধ্বংস করা শুরু করে সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে, স্বায়ত্তশাসন ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে বিভিন্ন সশস্ত্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সাথে সামরিক বাহিনীর চলমান সংঘাত উস্কে দেয় সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সংঘাত, কমিয়ে দেয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির মান। সামরিক শাসনের সুযোগে উত্থান ঘটে কতিপয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর, যারা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সুবিধাসমূহ।
এই কতিপয়তান্ত্রিক কাঠামো বাড়াতে থাকে জনরোষ, যার প্রকাশ ঘটে আশির দশকের শেষ দিকের বিক্ষোভগুলোতে। এমনি এক বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নিহত হয় শতাধিক আন্দোলনকারী। স্বাধীন দেশে নাগরিকদের উপর এমন নিপীড়নমূলক আচরণে আরো ফুঁসে উঠে জনগণ, বিক্ষোভে এক যুক্তরাজ্যফেরত নারী মনোযোগ কাড়েন আলাদা করে। নিজের বক্তব্যে বলেন, ‘জেনারেল অং সান, মিয়ানমারর স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতির সন্তান হিসেবে বর্তমান সামরিক সরকারের কাজ আমি মেনে নিতে পারি না।’ সামরিক শাসন পতনের দাবিতে আন্দোলনকে তিনি ব্যাখ্যা করেন স্বাধীনতার দ্বিতীয় সংগ্রাম হিসেবে।
গণতান্ত্রিক কাঠামোর পক্ষে এই বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরটি ছিলেন অং সান সু চি, জেনারেল অং সানের মৃত্যুর সময় যার বয়স ছিল মাত্র দুই বছর। সু চির শিক্ষাজীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে ভারতে, পড়াশুনা করেছেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও। পড়াশুনা শেষে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন জাতিসংঘে, ১৯৮৮ সালে মিয়ানমারে এসেছিলেন অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা করতে। তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনাচক্র তাকে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে সক্রিয় রাজনীতির সাথে, দাঁড় করিয়ে দেয় সামরিক বাহিনীর শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূখ্য চরিত্র হিসেবে।
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের দাবিতে অং সান সু চির এরপরের সংগ্রামটা সবারই জানা। প্রবল জনআন্দোলনের মুখে সামরিক বাহিনীর অধীনে ১৯৯০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মিয়ানমারে, সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিফ ফর ডেমোক্রেসি পায় বিশাল জয়। সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকার স্বীকৃতি দেয়নি সেই নির্বাচনের ফলাফলকে, গৃহবন্দী করে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির প্রধান অং সান সু চিকে। পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে সুচির ১৫ বছরই কাটে গৃহবন্দী হিসেবে, তিনি হয়ে উঠেন সামরিক বাহিনীর শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রধান চরিত্র।
সু চির এই আন্দোলন সাড়া ফেলে বিশ্বের সব প্রান্তেই। মহাত্মা গান্ধী যেমন ভারতের স্বাধীনতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব, নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার নিপীড়িতদের অধিকার আদায়ে সংগ্রামের প্রতীক, মার্টিন লুথার কিং যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের প্রাণপুরুষ, অং সান সু চিকেও তেমনিভাবে আখ্যায়িত করা শুরু হয় মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর পদকের পাশাপাশি ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান অং সান সু চি।
নব্বইয়ের দশক থেকে কমতে থাকে সামরিক শাসনের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বব্যাপী কমে যায় সামরিক শাসনের অধীনে থাকা দেশের সংখ্যাও। মিয়ানমারে এই পরিবর্তনের ছোয়া লাগে বেশ দেরিতে, ২০১০ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে পথচলা শুরু হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির। সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ২০১০ সালের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলেও অংশ নেয় ২০১২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন জিতে দখল করে পার্লামেন্টের বিরোধী দলের আসন।
২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় নিরপেক্ষ নির্বাচন, নির্বাচনে বিশাল জয় পায় অং সান সু চির দল, সরকার গঠন করলে অং সান সু চি দায়িত্ব নেন স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের জন্য বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ছিল অং সান সু চির। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যাত্রা শুরু করে তার দল। সরকারের উপর প্রত্যাশা ছিল স্বাধীনতার পর থেকে গৃহযুদ্ধ চলা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সমাপ্তি ঘটানো, বিভিন্ন প্রান্তে নিজেদের স্বায়ত্তশাসন আর স্বাধীকারের দাবিতে সশস্ত্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সাথে শান্তিচুক্তি করা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা।
এসব কাজে সু চির সরকারের অগ্রগতি সামান্যই। এরমধ্যে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের ধর্মীয় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, প্রমাণ পাওয়া যায় রোহিঙ্গাদেরকে গণহত্যার চেষ্টার। সু চির সরকার সামরিক বাহিনীর এই অভিযান বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়, গণমাধ্যমে সু চি আবির্ভূত হন সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোক হিসেবে।
সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে জীবন বাঁচাতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে। সর্বশেষ, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার মামলা করে গাম্বিয়া, সেখানেও সামরিক বাহিনীর পক্ষেই সাফাই গাইতে যান তিনি।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চর্চায় একসময় বিশ্বের অন্যতম রোল মডেলে পরিণত হয়েছিলেন অং সান সুচি। ক্ষমতায় এসে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম ভিত্তি, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় তার ব্যর্থতা বৈশ্বিকভাবে তার অর্জনকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। গণতন্ত্রের নায়ক থেকে তিনি পরিণত হয়েছেন সংখ্যালঘুদের নিপীড়নকারী খলনায়ক হিসেবে।
সামরিক অভ্যুত্থান
রোহিঙ্গা সংকটের কারণে সু চির বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা কমলেও, অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা বাড়ছিল তার। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারকে আত্মপক্ষ সমর্থন করা দলের নেতৃত্ব দেওয়ায় আবির্ভূত হন জাতীয় বীর হিসেবে। ফলে, ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিত করেছিল দ্বিতীয় মেয়াদে এনএলডি সরকারের ক্ষমতায় আসা। ক্ষমতার ভাগাভাগি আর সেনাপ্রধানের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে সামরিক বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় সু চির এনএলডির, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের প্রাক্কালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় সামরিক বাহিনী তাতমাদৌ।
শুরুর দিকে সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলন সীমিত পরিসরে হলেও, সময়ের সাথে বাড়ে আন্দোলনের ব্যাপ্তি, বাড়ে সাধারণ নাগরিকদের অংশগ্রহণ। এক দশক ধরে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাওয়া মিয়ানমারের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে জনসংখ্যার তরুণ অংশটি। সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার প্রথম দুই মাসে প্রায় অর্ধ-সহস্র মানুষ নিহত হয়েছে সামরিক বাহিনীর হাতে, আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর সহিংসতার শিকার হচ্ছেন অগণিত মানুষ।
স্বাধীনতার পর থেকেই মিয়ানমারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয় সামরিক বাহিনী, স্বাধীনতার দ্বিতীয় দশকেই ক্ষমতা দখল করে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এরপর পরবর্তী পাঁচ দশকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিষ্ঠুরভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলো দমন করেছে, নিজেদের জাতির স্বঘোষিত অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বেশ কয়েকবারই নিতে হয়েছে বর্বর ভূমিকা। নিজেদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চর্চা টিকিয়ে রাখতে এবারেও জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করেছে সামরিক বাহিনী।
অং সান সু চির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
একটা দীর্ঘ সময় সু চি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কাজ করেছেন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে। আশির দশকের শেষদিকে রাজনীতিতে প্রবেশ করা অং সান সু চি হয়ে উঠেছিলেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু, সেনাশাসিত মিয়ানমারে অং সান সু চির আর উজ্জ্বল কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। তার পেছনে কারণ নানাবিধ।
প্রথমত, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলন থামাতে মধ্যরাতে নাগরিকদের ঘরবাড়িতে হানা দিচ্ছে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে আন্দোলনকারীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করছে, সামরিক বাহিনীর যানগুলো রাতে টহল দিচ্ছে আবাসিক এলাকাগুলোতে। এরমধ্যে কারেনদের উপর বিমান হামলা চালিয়েছে, প্রায় নয় হাজার কারেন বাধ্য হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আশ্রয় নিতে।ন্যাশনাল কেইস ফায়ার এগ্রিমেন্টের কাঠামো ভেঙে পড়েছে, যুদ্ধ বিরতির চুক্তিতে আসা গোষ্ঠীগুলো অস্বীকৃতি জানাচ্ছে সামরিক বাহিনীর সাথে আলোচনায় বসতে।
স্বাধীনতার পর থেকেই গৃহযুদ্ধ চলছে মিয়ানমারে, এরমধ্যে মূলধারার রাজনৈতিক আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালানোর পাশাপাশি সহিংসতাগুলো সম্ভাবনা তৈরি করছে আরেকটি বড় পরিসরে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার। সেরকম কিছু হলে মিয়ানমারে খুব দ্রুত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই, সম্ভাবনা নেই মূলধারার রাজনীতিতে অং সান সু চির প্রত্যাবর্তনেরও।
দ্বিতীয়ত, প্রায় অর্ধযুগের স্টেট কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সু চি যেসব মূল্যবোধের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তার উল্টো কাজ করেছেন। সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যতটুকু ক্ষমতা ছিল, তিনি সেটি কেন্দ্রীভূত করেছিলেন নিজের হাতে, প্রশাসনকে নিয়ে আসতে চাইছিলেন নিজের নিয়ন্ত্রণে। নির্বাচন কমিশনেও নিয়োগ দিয়েছিলেন নিজের অনুগত লোকদের। ক্ষমতায়ন করেননি সিভিল সোভাইটিকে, বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেননি গণমাধ্যমকেও। সবমিলিয়ে, নিজের ক্ষমতাকে সংহত করতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর মতো তিনিও ঝুঁকে যাচ্ছিলেন একনায়কতন্ত্রের দিকে।
তার এই ভূমিকার কারণে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়নি, যেটি সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারবে কিংবা এই অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বের করে নিয়ে আসার মতো দক্ষতা দেখাবে। সু চির এই ব্যর্থতা নিশ্চিত করেছে, খুব দ্রুতই সমাধান হচ্ছে না এই রাজনৈতিক সংকটের। ফলে, পচাত্তর পেরিয়ে যাওয়া সু চির জন্য রাজনীতিতে ফিরে আসাটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। হয়তোবা, এই অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে নিজেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কাঠামো থেকে সরিয়ে নেবেন তিনি।
তৃতীয়ত, রাখাইন এবং অন্যান্য অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বেশকিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে, বিনিয়োগ এসেছে জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ থেকে। বিনিয়োগ এসেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো কাঠামো থেকেও। এই বিনিয়োগগুলো সামরিক বাহনীর জন্য রক্ষাকবচের মতো কাজ করছে অনেকটা। অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে এই দেশগুলো, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ নিয়েও। এই সিদ্ধান্তহীনতার পাশপাশি সামরিক বাহিনীর প্রতি চীনের সমর্থন সেনাশাসন দীর্ঘায়িত করবে মিয়ানমারে। সেনাশাসন দীর্ঘায়িত হলে, আগামী দিনগুলোতে হয়তো আবারো গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে অং সান সু চিকে।
চতুর্থত, মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম একটি ইতিবাচক দিক হলো, সু চির নির্দেশনা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন সাধারণ নাগরিকেরা। অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলনে তারা যুক্ত হচ্ছেন নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন থেকে, আন্দোলনের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আগামী দিনগুলোতে এই তৈরি হওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিস্থাপন করবে সু চির প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের। গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য বটবৃক্ষ কখনোই ভালো কিছু না। বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব উঠে আসলে একসময় হয়তো সু চির যুগের ‘বটবৃক্ষ’ প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে মিয়ানমার, যেটা দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক হবে গণতন্ত্রের জন্য।