গত বছর চীনের উহানে ধরা পড়া করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তে, আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সব দেশেরই মানুষ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবস্থাপনা, বিনোদনসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সব খাতই, সংকুচিত হয়েছে চাকরির বাজার।
এর মধ্যে অধিকাংশ মানুষ ঘরবন্দী থাকায় রাষ্ট্রকে নিয়মিত ভূমিকার বাইরে নিতে হয়েছে বহুমুখী উদ্যোগ, দায়িত্ব নিতে হয়েছে জনগণের দৈনন্দিন চাহিদা নিশ্চিত করার। ব্র্যান্ডিট লাইনের উত্তরের শিল্পোন্নত দেশগুলো, যারা প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্ব নামে পরিচিত, অধিকাংশ রাষ্ট্রই এই সমস্যাকে দক্ষতার সাথে সামাল দিচ্ছে। এই করোনাকালে সবচেয়ে সংকটময় অবস্থায় আছে ব্র্যান্ডিট লাইনের দক্ষিণের দেশগুলো, যেগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশ নামে পরিচিত। সকল সংকটই যেহেতু অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, সেজন্য নিম্ন মাথাপিছু আয় আর কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এই দেশগুলোর অর্থনীতি প্রায় থমকে গেছে, সম্ভাবনা আছে সামনে আরো সংকটে পড়ার।
করোনাকালের সংকটে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে গিয়েছে, কমে গেছে অর্থের প্রবাহ, সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে অর্থনৈতিক ঝুঁকি আর সংকট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব দেশেই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, শুধু এই প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষমতা আছে টাকা ছাপানোর। অর্থনৈতিকভাবে মনোপলি থাকা এই প্রতিষ্ঠানের নীতির উপর নির্ভর করছে সংকট মোকাবেলার কার্যকারিতা, নির্ভর করছে এর নীতিমালা কার্যকর করার উপরও।
করোনাকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম
করোনাকালে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সব ধরনের পরিবহন খাত, জীবন আর জীবিকার অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা, বিশ্বজুড়ে চাহিদার ধস দেখছে নির্মাণশিল্প আর আবাসন খাত, চাকরির অনিশ্চয়তায় আছে বেসরকারি খাতের কর্মীরা। প্রভাব পড়েছে কৃষিতে, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রবিশস্য আর সবজির উৎপাদন।
অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে, অনেকগুলো পড়েছে দীর্ঘমেয়াদী লোকসানের মুখে। ফলে, বিশ্বের সব প্রান্তের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও কমেছে বার্ষিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে বাড়ছে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা, যার বড় একটা অংশই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, যাতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সাব-সাহারা অঞ্চল আর দক্ষিণ এশিয়া।
যেহেতু, সংকটে চ্যালেঞ্জিং সময় যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, জীবন আর জীবিকার নিরাপত্তা তৈরি করতে, ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও নিতে হচ্ছে সংকটকালীন ভূমিকা।
সুদের হার কমিয়ে দেওয়া
কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাভাবিক অবস্থাতেও অধীনস্থ সরকারি আর ব্যবসায়িক ব্যাংকগুলোকে ইন্টারেস্টের ভিত্তিতে ঋণ দিয়ে থাকে। করোনাকালে এই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব যে আয়, সেটিতে প্রায় ধস নেমেছে। মধ্যবিত্তের যে সঞ্চয়, তাতেও দেখা যাচ্ছে ভাঙনের ধারা। ফলে, ব্যাংকগুলো আর ইনভেস্টমেন্ট ফার্মগুলো পড়েছে একধরনের তারল্য সংকটের মধ্যে।
অধিকাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ঋণের সুদের হার কমিয়েছে, নিয়ে এসেছে ন্যূনতম পর্যায়ে। নীতিমালা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে শিল্প আর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংকটকালে সুদ আদায় বন্ধ রাখতে বা স্বল্প পরিসরে আদায় করতে, প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার স্বার্থে।
ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়া
করোনাকালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে, স্থবির হয়ে যাচ্ছে অর্থের প্রবাহও। এর মধ্যেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর আবশ্যিক খরচগুলো নিজেদের বহন করতে হচ্ছে, নিম্নবিত্ত শ্রেণীও রয়েছে জীবন সংগ্রামে। ফলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো লোন চাচ্ছে ব্যাংকের কাছে, নিম্নবিত্তরাও দ্বারস্থ হচ্ছে এনজিওর কাছে। ফলে, আর্থিক যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, ব্যাংক এবং ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করা প্রতিষ্ঠানগুলো, সেগুলো তাদের তারল্য সংকটের বিপরীতে বিপুল চাহিদার মুখোমুখি হচ্ছে। অধিকাংশ দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে সরাসরি ঋণ দিচ্ছে, যাতে অর্থের প্রবাহ ঠিক থাকে, টিকে যায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
স্বাস্থ্যখাতে লগ্নি
করোনাকালে স্বাভাবিকভাবেই বিরাট চাপ যাচ্ছে স্বাস্থ্যখাতের উপর, সামর্থ্যের বিপরীতে এই খাত মুখোমুখি হচ্ছে বিপুল চাহিদার। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা বরাবরই অনুন্নত, নাগরিকেরা নির্ভরশীল সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর। ফলে, এই খাতে বর্তমানে সরকারগুলোর নির্দিষ্ট বরাদ্দের বাইরেও দিতে হচ্ছে বিপুল চাহিদার যোগান, অধিকাংশ দেশেই সেটা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চেষ্টা করছে নাগরিকদের প্রত্যাশার সাথে সমন্বয় ঘটানোর, স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের।
কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারকে সহযোগিতা
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আয়ের প্রধান উৎস আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর আর রেমিট্যান্স, বিকশিত হয়নি আয়কর খাত। এই করোনাকালে রাষ্ট্রের আয়ের প্রায় সবগুলো পথই বন্ধ রয়েছে, কমে গেছে রাষ্ট্রের রাজস্ব আয়। এর মধ্যে কার্যকর রয়েছে লকডাউন, সরকারকে সীমিত পরিসরে হলেও নিতে হচ্ছে জীবন আর জীবিকার দায়িত্ব। ফলে, কেন্দ্রীয় আর স্থানীয় সরকার আসলে চাহিদা এবং যোগানের বিশাল ফারাকের মধ্যে পড়েছে। এই অবস্থায় এগিয়ে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বৈশ্বিক সাহায্য আনার মাধ্যমে বা নিজেদের রিজার্ভ ব্যবহার করে। অন্তহীন চাহিদার যোগানে অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশ্য যাচ্ছে টাকা ছাপানোর সিদ্ধান্তেও।
ভবিষ্যতে কী করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো?
করোনা আমাদের রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত জীবনে যে সংকট নিয়ে এসেছে, আমরা এখনও তার প্রারম্ভিক পর্যায়েই আছি। তবুও, স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার এই সংকট একসময় কেটে যাবে, পুরোদমে শুরু হবে স্বাভাবিক জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। অভ্যন্তরীণ বাজারে যে পণ্যগুলোর চাহিদার পতন হয়েছে, সেগুলোর চাহিদা ফিরিয়ে আনতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে বাইরের বাজারে রপ্তানি হওয়া পণ্যগুলোর চাহিদাও। প্রায় সব দেশেই বাড়ছে বেকারত্ব, অনেক জায়গায় হচ্ছে মজুরি ছাট, সংকটোত্তর সময়ে এই চাকরির বাজারকে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রবৃদ্ধির যে ধারাবাহিক পতন দেখা যাচ্ছে, সেটিকেও আনতে হবে আগের জায়গায়।
এই চাহিদাগুলোকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ, চেষ্টা করতে হবে দ্রুত সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক অর্থনীতিতে ফেরার।
বাণিজ্যের নতুন মূল্যবোধে বিনিয়োগ করা
প্রত্যেকটা সংকট থেকেই মানবজাতি উত্তরণ করে নতুন মূল্যবোধ নিয়ে, নতুন সাংস্কৃতিক আর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এই করোনায় ইতোমধ্যেই এর একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে। প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলো চেষ্টা করছে সাপ্লাই চেইন পরিবর্তন করার, পরিবর্তন করতে চাচ্ছে তাদের কারখানাগুলোর অবস্থান। ইতোমধ্যেই জাপান ফান্ড গঠন করেছে কারখানা সরিয়ে নিতে, যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া আর ইউরোপীয় দেশগুলোও। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সংকট পরবর্তীকালে সাপ্লাই চেইনে নিশ্চিতভাবেই একটা পরিবর্তন আসবে।
বিপুল জনসংখ্যা নিয়ে লেবার ইন্টেন্সিভ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সামনে এটা একটা বিশাল সুযোগ অর্থনীতি আর জীবনমান বিকাশের। এই বিকাশের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে, ফলে ভূমিকা নিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।
দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খোঁজা
সবগুলো রাষ্ট্রই এই করোনাকালে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুর্বল অর্থনীতি আর রিজার্ভ কম থাকায় তৃতীয় বিশ্বের সংকটটা বেশি। এর মধ্যে রাষ্ট্রগুলো মুখোমুখি হচ্ছে খাদ্য আর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার চাপের। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে মুদ্রা ছাপিয়ে সংকটের স্বল্পস্থায়ী সমাধান খোঁজার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু, এই মুদ্রা ছাপানোর ফলাফল হিসেবে দ্রুতই মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে, ডলারের বিপরীতে কমবে মুদ্রার মান। ফলে, মুদ্রাস্ফীতির হার ছাপিয়ে যাবে ব্যাংকগুলোর সুদের হারকে।
এই নীতি একদিকে ব্যাকফায়ার করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে, কারণ সংকটকালে এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে, সেই সাথে ব্যাকফায়ার করবে বিভিন্ন জায়গায় ঋণ দেওয়া ব্যাংকগুলোকে, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির প্রতিষ্ঠানগুলোকেও; ফলে তৈরি হবে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
স্বাধীনতা বজায় রাখা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে সীমাহীন ক্ষমতা, নিজ বা দলীয় স্বার্থে অনেক সময়ই সেটা ব্যবহার করতে দেখা যায় সরকারকে, যেটা প্রায়শই দেশের অর্থনীতিকে ব্যাকফায়ার করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার বিষয়টি এই ধারণা থেকেই উঠে এসেছে।
করোনাকালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার ধারণার উপর হস্তক্ষেপ ব্যতিক্রম কিছু না। কিন্তু, যেহেতু এই হস্তক্ষেপ সংকটকে আরো ঘনীভূত করার সম্ভাবনা আছে, সেহেতু এই পরিস্থিতিকে নিষ্ক্রিয় করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই নিতে হবে।
সংকট ব্যবস্থাপনায় জোটবদ্ধতা
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, কৃষিনির্ভর অর্থনীতির সাথে কমন ফিচার হিসেবে আছে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস। ফলে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে এই দেশগুলো কাছাকাছি, কাছাকাছি অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার দিক থেকেও। ফলে এই দেশগুলো সংকট মোকাবেলায় তৈরি করতে পারে অর্থনৈতিক জোট, যাতে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকতে পারে দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আবার, এই করোনাকালে সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে সাব-সাহারা আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, খাদ্যনিরাপত্তা আর স্বাস্থ্যনিরাপত্তার নিরিখে। এই দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেতে পারে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোটেও, যেটা ইতোমধ্যে দেখা গেছে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ইউরোপীয় ইউনিয়নে।
অতীতে কোনো সংকটই রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কাটেনি, ঘটেনি সংকট থেকে উত্তরণ। ফলে, অর্থনৈতিক জোটগুলো নিতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
অর্থের প্রবাহ বাড়ানো
করোনাকালে বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ধনীদের সম্পদ এই সংকটের মধ্যেও বাড়ছে, কমছে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের জীবনমান, ক্রয়ক্ষমতা। সংকট পরবর্তী সময়ে এই বৈষম্য কমাতে হলে রাষ্ট্রকে ভর্তুকি দিতে হবে কৃষি আর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। বন্ড ব্যবস্থাকে আকর্ষণীয় ও সহজলভ্য করে এই পলিসিতে ভূমিকা নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।