বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হচ্ছে গণতন্ত্র। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ দেশে রয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের পতনের পরে পৃথিবির অধিকাংশ দেশেই স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটে, বিকাশ লাভ করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। কিন্তু, পৃথিবীর প্রায় সবগুলো দেশই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে নিজেদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন বিকল্পসহ গ্রহণ করেছে। ফলে, পৃথিবীর যে দুই-তৃতীয়াংশ দেশে গণতন্ত্র রয়েছে, তার মধ্যে একদেশের গণতন্ত্রের সাথে আরেক দেশের গণতন্ত্রের হুবহু মিল পাওয়া কার্যত অসম্ভব। প্রত্যেক দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, রয়েছে কিছু মৌলিক কাঠামো।
গণতন্ত্রের প্রয়োগের যে বৈচিত্র্যময় ধারা, তার ধারাবাহিকতা রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতেও। আলোচনার জগতে বিভিন্ন সময়ে তাই প্রভাবশালী উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বিভিন্ন কাঠামোর গণতন্ত্র। উদার গণতন্ত্র গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকেই আলোচনাতে রয়েছে, গত শতাব্দীর একেবারে শেষদিকে উত্থান ঘটেছে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের। জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের হাত ধরেই, গণতন্ত্রের নতুন আরেকটি ধরনের উত্থান ঘটেছে। সেটি হচ্ছে অনুদার গণতন্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ে উত্থান ঘটেছে হাইব্রিড রেজিমের, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো আইনিভাবে ঠিক রেখে এই কাঠামোতে বাস্তবিক রাজনীতিতে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার হরন করেন শাসকেরা।
বাস্তবিক বিভিন্ন বিতর্ক আর চর্চার রাজনীতির মধ্যেও, গণতন্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ভ্যারিয়েন্টটি হচ্ছে উদার গণতন্ত্র। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গণতন্ত্র বলতে উদার গণতন্ত্রকেই বুঝানো হয়।
উদার গণতন্ত্র কী?
উদার গণতন্ত্রের উত্থান ঘটে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। উদার গণতন্ত্রের চর্চা সাধারণত প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতে কার্যকর থাকে, যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজগুলো নির্বাহে সহযোগিতা করে থাকেন, রাষ্ট্রের সম্পদের কর্তৃত্বমূলক বণ্টনে তার অঞ্চলের নাগরিকদের অংশটুকু নিশ্চিত করেন। সাধারণত, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে একজন জনপ্রতিনিধি চার থেকে পাঁচ বছর জন্য নির্বাচিত হন, নির্ধারিত মেয়াদ শেষে তাকে দায়িত্ব ছেড়ে অবসর নিতে হয় কিংবা দায়িত্ব বহাল থাকতে হলে অংশ নিতে হয় পুনঃনির্বাচনে।
সরকারের ধরনের উপর ভিত্তি করে আবার দুই ধরনের সরকারব্যবস্থা রয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্র ও ফেডারেল শাসনতন্ত্র। সংসদীয় গণতন্ত্রে সাধারণত একজন আলংকরিক রাষ্ট্রপ্রধান থাকে, যিনি রাজতন্ত্র থেকে আসতে পারেন আবার সংসদ সদস্যদের পরোক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিতও হয়ে থাকতে পারেন। তবে, এই কাঠামোতে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে সরকারপ্রধানে কাছে, সকল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও উপরও থাকে তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। ফেডারেল কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধান, উভয়ের দায়িত্বই পালন করেন। দুই ধরনের গণতান্ত্রিক কাঠামোতেই উদার গণতন্ত্র কার্যকর করা সম্ভব। কিছু বৈশিষ্ট্যের সমন্নিত শাসনতন্ত্রকে উদার গণতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়।
উদার গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কাঠামো হচ্ছে উদার গণতন্ত্র। স্বতঃস্ফূর্ত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে এই গণতান্ত্রিক কাঠামোর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলো তৈরি হয়েছে, চর্চার মাধ্যমে সেগুলো বিকশিত হয়েছে এবং শাসনতন্ত্রে সেগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলোর দায়বদ্ধতা প্রমাণিত হয়েছে।
প্রথমত, একটি উদার গণতান্ত্রিক কাঠামোতে যেকোনো রাজনৈতিক পরিচয় বা রাজনৈতিক স্বার্থের আলোকে একগুচ্ছ মানুষ রাজনৈতিক গ্রুপ তৈরি করতে পারে, তৈরি করতে পারে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিকভাবে সেই সমষ্টি ছোট হতে পারে, সমষ্টির রাজনৈতিক স্বার্থ কট্টর হতে পারে। কিন্তু, উদার রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রত্যেক আদর্শের সমষ্টিকেই রাজনৈতিক দল গঠন করার সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে স্থানীয় পরিচয়, জাত, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদিকে বিবেচনা না করে।
দ্বিতীয়ত, উদার গণতান্ত্রিক কাঠামো সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সাম্য তৈরি করতে চায়, তৈরি করে অর্থনৈতিক সাম্য। এর বাইরে, নাগরিক সুবিধাগুলো প্রত্যেকের কাছে রাজনৈতিক বা অন্যান্য পরিচয়কে উর্ধ্বে রেখে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়া হয়। কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক কোনো বৈষম্যের শিকার হন না।
তৃতীয়ত, উদার গণতান্ত্রিক কাঠামোতে শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি থাকে। সরকারি দল ক্ষমতা গ্রহণের পরেই রাষ্ট্রের সংঘাত উৎপাদনের ক্ষমতার উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তৈরি হয়, রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিও চলে সরকারি দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইশারায়। সরকারি দলের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার দায়িত্বটি পালন করে বিরোধী দলের সদস্যরা, সরকারি দলের ক্ষমতার অতিরিক্ত চর্চার রোধে প্রয়োজনীয় জনমতও তৈরি করে বিরোধী দলই। আবার, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি দল কখনো নাগরিকদের নাগরিক সুবিধাতে বৈষম্য তৈরি করলে, রাজনৈতিক অধিকারগুলো চর্চার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করলে, বিরোধী দল সেই প্রক্রিয়া আটকে দিয়ে রাষ্ট্রকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।
চতুর্থত, উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো ও নাগরিকদের সম্মিলিত সম্মতির মাধ্যমে। আইনের শাসন থাকার ফলে, যেকোনো ধরনের অপরাধে যে কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়, একই আইনি কাঠামো থেকে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক বিচার পান। এই কাঠামোতে আবার নিষ্ঠুর অপরাধীরাও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান, অনুদার দেশগুলোর মতো বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন না।
পঞ্চমত, উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলো সাধারণত সেক্যুলার হয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র সকল নাগরিককে তার ধর্ম চর্চার অধিকার নিশ্চিত করে, নিজের ধর্মীয় মতামত স্বচ্ছন্দে জনসম্মুখে তুলে ধরতে পারে। যে বিশ্বাস করে ধর্মীয় জীবনে আর যে অবিশ্বাস করে, রাষ্ট্র সকলের জন্য নিজের বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস চর্চার সুযোগ নিশ্চিত করে। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর কোনো নাগরিকেই রাষ্ট্রীয় কোনো বাধ্যবাধকতার মুখোমুখি হতে হয় না, মুখোমুখি হতে হয় না অন্য কোনো রাজনৈতিক গ্রুপ বা ধর্মীয় গ্রুপের বাধ্যবাধকতার।
উদার গণতন্ত্রের দেশ
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দেশটি হচ্ছে নরওয়ে। ফ্রিডম হাউজের রিপোর্টে নরওয়ে ২০২১ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ৪০ এর মধ্যে পূর্ণমান পেয়েছে, পূর্ণমান পেয়েছে নাগরিক স্বাধীনতার সূচকেও। নরওয়ের নির্বাচনী কাঠামো অত্যন্ত স্বচ্ছ, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে আইনসভার প্রত্যেক সদস্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। স্বচ্ছ আর জবাবদিহিতামূলক নির্বাচনী কাঠামোর মধ্যে থাকা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাই সাধারণত সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন। নাগরিকরা রাজনৈতিক দল তৈরিতে স্বাধীনতা উপভোগ করে, নির্বাচনের মাধ্যমে যেকোনো নাগরিকের সুযোগ রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব অর্জনের সুযোগ।
নরওয়ের মতো একই ধরনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা রয়েছে প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশ নিউজিল্যান্ডেও। নাগরিকেরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক দল পছন্দ করত্যে পারে, রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগ দেশটি শোনা যায়নি বহুদিন। জাতিগত পরিচয়, ধর্ম, বর্ণ, আঞ্চলিক পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে নিউজিল্যান্ডের সকল নাগরিক সমান রাষ্ট্রীয় সুবিধা উপভোগ করেন, রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে প্রভাবিত করতে পারেন সরকারের নীতিকে। দূর্নীতির বিরুদ্ধে নিউজিল্যান্ডে কার্যকর কাঠামো রয়েছে, সরকারও সকল রাষ্ট্রীয় কাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেই কাজ করে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকেও ভালো অবস্থানে আছে নিউজিল্যান্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও পূর্ণমাত্রায় রয়েছে এই দেশে। রয়েছে পরিপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতাও।
উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত দেশগুলোর একটি কানাডা। উত্তর আমেরিকার এই দেশটিতে একাডেমিক স্বাধীনতা রয়েছে, একাডেমিশিয়ানরা সরকারের বিভিন্ন নীতির উচ্চকণ্ঠ সমালোচনা করেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রয়েছে, রাষ্ট্রীয় সুবিধাগুলোতে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থান আর অঞ্চলভিত্তিক অবস্থানকে একপাশে রেখে, কানাডার সরকারি চাকরিগুলোতে প্রবেশের সমান অধিকার উপভোগ করেন সকল নাগরিক। শাসনতন্ত্রে কানাডা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কম, আমলাতন্ত্রকে গড়ে তুলতে পেরেছে জনমুখী করে।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোকে সকল শ্রেণির মানুষই অংশগ্রহণ করেন, কার্যকর সিভিল সোসাইটি রয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে কাঠামোটি কাজ করে অত্যন্ত কার্যকর একটি কাঠামো হিসেবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া স্বাধীনতার পর থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে হয়ে আসছে কানাডাতে, নির্বাচনও আয়োজিত হয় নিয়মিতভাবে। নির্বাচনে সাধারণত কোনো অনিয়ম হয় না, পরাজিত প্রার্থীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মেনে নেয় নির্বাচনের ফলাফল। এমনকি, বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেও যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয় কানাডার নির্বাচন, রয়েছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক কাঠামোগুলোতে সার্বজনীন অংশগ্রহণ রয়েছে, সরকার সবচেয়ে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছে নাগরিকদের কাছে।
উদার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
অনেকগুলো কারণেই গত কয়েক দশকে উদার গণতন্ত্রের চর্চার প্রক্রিয়া ছিল নিম্নমুখী, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উদার গণতন্ত্রকে হটিয়ে শাসনব্যবস্থা হিসেবে দখল করেছে অনুদার গণতন্ত্র, উত্থান ঘটেছে হাইব্রিড রেজিমের। কিন্তু, এর বিপরীতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা আরো তীব্র হয়েছে, উদার গণতন্ত্রের রাজনৈতিক আবেদন বেড়েছে। বর্তমান সময়ে যে শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, তাদের হাত ধরেই জয় সূচিত হতে উদার গণতন্ত্রের।