সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ আত্মরক্ষার প্রয়োজনে অস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করে, অস্ত্রের ব্যবহার ছিল পশু শিকারের কাজেও। সময়ের সাথে অস্ত্রের আকৃতি বদলেছে, অস্ত্রের প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে সভ্যতাকে। আধুনিক অস্ত্র প্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয় গান পাউডার তৈরির মধ্যে দিয়ে। ৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে চীনারা সর্বপ্রথম তৈরি করে গান পাউডার, বৈশ্বিক অস্ত্রের বাণিজ্যও সেই সময়ে শুরু হয় তাদের হাত ধরেই। অস্ত্র প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয় ১৮৮৫ সালে অটোমেটিক রাইফেল তৈরির মধ্যে দিয়ে। আর বিশ্বব্যাপী তৈরি হয় এই ঘরানার অস্ত্রের বিপুল বাজার।
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ অর্থনীতি
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক। যুক্তরাষ্ট্রে চলছে মহামন্দা। ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া এই মহামন্দায় যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদন কমে যায় ৪৭ শতাংশ, জিডিপির সংকোচন হয় ৩০ শতাংশ, বেকারত্ব পৌঁছায় ২৫ শতাংশে। এর প্রভাব পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি আয়ে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমে যায় ৬৭ শতাংশ। ত্রিশের দশকের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই মহামন্দা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে, ফিরতে থাকে মন্দা পূর্ববর্তী অবস্থায়। তবে, এই প্রক্রিয়া ছিল তুলনামূলকভাবে বেশ ধীর। চল্লিশের দশকের শুরুতেও যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার ছিল ১৪ শতাংশের মতো, দূর্বল ছিল সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোও। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, পাল্টে যায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সূচকগুলো।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান আক্রমণ করে পার্ল হারবারে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধ সামগ্রী তৈরির জন্য নতুন নতুন ক্রয়াদেশ আসতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শিল্পগুলোতে, অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধির সাথে কমে আসতে শুরু করে বেকারত্ব। যুদ্ধকালীন পাঁচ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ৮৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৫ বিলিয়ন ডলারে, বেকারত্বের হার ১৪ শতাংশ থেকে কমে নেমে যায় ২ শতাংশের নিচে। যুদ্ধকালীন এই অভিজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র অস্ত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের কাছেও এই অভিজ্ঞতা আসে অর্থনীতিকে চাঙা করার নতুন এক পলিসি হিসেবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতায় যুক্তরাষ্ট্র বিংশ শতাব্দী জুড়ে আরো কয়েকটি নতুন নতুন যুদ্ধে জড়িয়েছে। পঞ্চাশের দশকে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে কোরিয়ান যুদ্ধে, পরের দশকে জড়ায় ভিয়েতনাম যুদ্ধে। সত্তরের দশকে তুঙ্গে উঠে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ছায়াযুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। এই অর্ধশতাব্দীতে টানা যুদ্ধাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির একটা বড় ক্ষেত্র উঠে অস্ত্র শিল্প, অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে অংশ নিতে হয় আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাণিজ্যে।
সময়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রশিল্প বিকশিত হয়েছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে। অস্ত্র বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত এই কোম্পানিগুলোর সুবাদে বর্তমান বিশ্বে সেরা অস্ত্র প্রযুক্তি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কাছে, বিভিন্ন প্রয়োজনে এই প্রযুক্তিগুলোই নিশ্চিত করছে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের টিকে থাকা।
কেন বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রবাণিজ্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে বিশ্বের অস্ত্র আর সামর্থ্যের বিচারে সেরা সেনাবাহিনী রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, সময়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় বেড়েছে, বেড়েছে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণও। শতাব্দীর শুরুতে জর্জ ডব্লিউ বুশের দুই মেয়াদের প্রেসিডেন্সিতে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে, আন্তর্জাতিউক অস্ত্র বাণিজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি আয় বাড়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি।
জর্জ ডব্লিউ বুশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অস্ত্রশিল্পের উপর নির্ভরতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বের করে আনার ঘোষণা দিলেও, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার আট বছরের মেয়াদে অস্ত্রের বাণিজ্য বেড়েছে বিরামহীনভাবে। বারাক ওবামার সময়ে অস্ত্র বাণিজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আয় বাড়ে প্রায় দেড়গুণ। বিভিন্ন কারণেই সম্প্রসারিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের বৈশ্বিক বাজার, বাড়ছে অস্ত্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আয়।
প্রথমত, স্নায়ুযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভক্ত ছিল দুই পোলে, গণতান্ত্রিক বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কমিউনিস্ট বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। স্নায়ুযুদ্ধকালে বিভিন্নভাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতা হয়েছে এই দুই পরাশক্তির মধ্যে, নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে দুই পক্ষই জড়িয়েছে ছায়াযুদ্ধে। স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর আন্তর্জাতিক রাজনীতি হয়ে যায় ইউনি-পোলার, একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এ
কবিংশ শতাব্দীতে এসে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রভাব কিছুটা কমেছে। চীন, রাশিয়ার মতো বৈশ্বিক পরাশক্তির পাশাপাশি উত্থান ঘটছে ভারত, জার্মানি, ইরান, তুরস্ক, সৌদি আরবের মতো বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির। আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা চাঙা রাখছে আন্তর্জাতিক অস্ত্রের বাজার, অস্ত্রের বাজারের সবচেয়ে বড় স্টেক হোল্ডার হিসেবে বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বাণিজ্য।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একবিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশে নিরাপত্তার ধারণা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার একটি সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ক্রমাগত আধুনিকায়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, কিনতে হয় নতুন নতুন প্রযুক্তির অস্ত্র আর নজরদারির যন্ত্রপাতি।
নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সবসময়ই এগিয়ে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র শিল্পগুল। আছে সমৃদ্ধ গবেষণা ল্যাবও। ফলে, নিরাপত্তার সংকট বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তির অস্ত্র রপ্তানি করে আয় বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের। যেমন, ইয়েমেনে হুতিদের সশস্ত্র উপস্থিতি সৌদি আরবের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে, এই ধারণা থেকে এই দশকের শুরুতে ইয়েমেনে সরাসরি সামরিক হামলা চালায় সৌদি সামরিক বাহিনী। দশকব্যাপী চলা যুদ্ধে সৌদি আরব যুদ্ধ সামগ্রী সংগ্রহ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। ইরান থেকে আসা হুতিদের জন্য সামরিক সহায়তা দীর্ঘায়িত করেছে যুদ্ধকে। গত কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের প্রধান আমদানিকারক সৌদি আরব।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বহুমেরুকরণের মাধ্যমে একটি অনিশ্চয়তার বিশ্ব তৈরি হয়েছে গত দুই দশকে। এই অনিশ্চয়তার বিশ্বে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটছে, জাতিগত সহিংসতা গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিভিন্ন দেশকে, বিভিন্ন দেশে তৈরি হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। নতুন নতুন এসব সংঘাত বৈশ্বিক অস্ত্রের চাহিদা বাড়াচ্ছে, তাল মিলিয়ে বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বাণিজ্য।
বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র রপ্তানির নির্দেশকগুলো লক্ষ্য করলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। গত দুই দশক ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মধ্যপ্রাচ্য, বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর উত্থানও ঘটছে এই অঞ্চল থেকেই। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি অস্ত্র রপ্তানি করেছে সৌদি আরবে, দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ইরাক। চতুর্থ আর পঞ্চম অবস্থানে ধারাবাহিকভাবে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের আরো দুই দেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত আর কাতার। ষষ্ঠ অবস্থানে ছিল ইসরায়েল।
চতুর্থত, বৈশ্বিক পরাশক্তি অন্যান্য দেশের মতো আমেরিকার অর্থনীতিতে প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠী অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের ফান্ডিংয়ের একটা বড় অংশও আসে তাদের কাছ থেকেই। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা, সিনেট কিংবা হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আইন প্রণয়নের সময় এই স্বার্থগোষ্ঠীর স্বার্থ মাথায় রাখতে হয়, পররাষ্ট্রনীতি তৈরিতেও থেকে যায় তাদের প্রভাব। ফলে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি হওয়া অনেক সংঘাতই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণে বর্ণিত হয় ‘কৃত্রিম সংকট’ হিসেবে।
এই ক্রিয়াশীল প্রভাবকগুলোর কারণে আন্তর্জাতিক অস্ত্রের বাজারে সবচেয়ে প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হওয়া বৈশ্বিক অস্ত্র বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশই করেছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার অংশগ্রহণ ২১%। তালিকাতে ৭.৯ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে ফ্রান্স, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে যথাক্রমে জার্মানি ও চীন। এই সময়ে আন্তর্জাতিক অস্ত্রের বাজারে যুক্তরাজ্যের অংশ ৩.৭ শতাংশ, আছে ষষ্ঠ অবস্থানে।
যুদ্ধ অর্থনীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেড়িয়ে আসা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে উঠা এই অর্থনৈতিক কাঠামো বেশ কিছু বাস্তবিক সমস্যার মুখোমুখি হয়।
প্রথমত, যুদ্ধ অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি বাড়ছিল, বাড়ছিল কর রাজস্বও। কিন্তু, এর সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলো রাষ্ট্রের ঋণ, বাড়তি করও বোঝা হয়ে উঠছিলো নাগরিকদের উপর।
দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ অর্থনীতিতে দেশজ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মাথাপিছু আয়। কিন্তু এই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কোনো প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতায় কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। বরং, যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার কারণে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ায় কমেছে ক্রয়ক্ষমতা।
তৃতীয়ত, যুদ্ধ অর্থনীতির একটি নিয়মিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। হঠাৎ করে জিডিপির আকার বড় হয়ে যাওয়া, রাষ্ট্রীয় ঋণ শোধ করতে মুদ্রা ছাপানো বাড়িয়ে দেয় মুদ্রাস্ফীতি।
এই নেতিবাচক প্রভাবগুলোর পরেও যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা নেই। বরং, অতীত অভিজ্ঞতাগুলো থেকে বলা যায়, সাম্প্রতিক করোনা মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতিগুলো কাঁটিয়ে উঠতে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করবে। কারা এর শিকার হবেন, তা সময়ই বলে দেবে।