জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের রাশিয়াযাত্রার গোপন পরিকল্পনা

মার্কিন সরকারের বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর গোপন তারবার্তা ফাঁস করার মধ্য দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ওয়েবসাইট উইকিলিক্সের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ গত ছয় বছর ধরেই প্রায় বন্দী অবস্থায় জীবন যাপন করছেন লন্ডনে অবস্থিত ইকুয়েডরের দূতাবাসে। কেবলমাত্র গত বছর ইকুয়েডর তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে। কিন্তু ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানে গত শুক্রবার প্রকাশিত এক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু নাগরিকত্ব না, অ্যাসাঞ্জকে কূটনৈতিক পদ দিয়ে রাশিয়াতে পাচার করার ব্যাপারে ইকুয়েডর এবং রাশিয়া একটি গোপন পরিকল্পনা করেছিল।

উইকিলিক্স এবং ইকুয়েডরে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাসের পক্ষ থেকে অবশ্য এই দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশ করা গার্ডিয়ানের ঐ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার চব্বিশ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে পৃথকভাবে ইকুয়েডরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠির বরাত দিয়ে প্রায় একই রকম দাবি করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এতে রাশিয়ার ভূমিকার কথা সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও ইকুয়েডর যে অ্যাসাঞ্জকে কূটনৈতিক পদ দিয়ে রাশিয়াতে পাঠাতে চেয়েছিল, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ান কম্পিউটার প্রোগ্রামার জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ প্রথম বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসেন ২০১০ সালে, যখন তিনি সাবেক মার্কিন সেনা এবং রাজনৈতিক কর্মী চেলসি ম্যানিংয়ের দেওয়া ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রচুর গোপন মার্কিন দলিল ফাঁস করতে শুরু করেন। বিব্রত মার্কিন সরকার উইকিলিক্সের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য চায়। এর পরপরই সুইডেন সরকার অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণের মামলায় আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

গ্রেপ্তার হলে সুইডেন তাকে আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করবে, এরকম আশঙ্কায় অ্যাসাঞ্জ ইংল্যান্ডে যান এবং সেখানে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। দশ দিন বন্দী থাকার পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান, কিন্তু ২০১২ সালে তিনি যখন বুঝতে পারেন যে ইংল্যান্ডও তাকে আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত, তখন তিনি জামিনের শর্ত ভঙ্গ করে ইকুয়েডরের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসেই অবস্থান করছেন। গত বছর সুইডেন তার বিরুদ্ধে করা ধর্ষণ মামলা প্রত্যাহার করে, কিন্তু জামিনের শর্ত ভঙ্গ করায় এখনও দূতাবাস ছেড়ে বের হলে যুক্তরাজ্যের পুলিশের হাতে তার গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা আছে।

গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুযায়ী, লন্ডন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে দূতাবাসের বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করার এক ঝুঁকিপূর্ণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার কাছের কিছু ব্যক্তি এবং দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা। একপর্যায়ে তার চূড়ান্ত গন্তব্য হিসেবে রাশিয়ার কথাও বিবেচনা করা হয় এবং রাশিয়ান দূতাবাসের কর্মকর্তারাও পরিকল্পনার সাথে জড়িত হন। পরিকল্পনা অনুযায়ী অ্যাসাঞ্জকে দূতাবাসের কাগজপত্র দেওয়ার কথা ছিল, যেন তিনি কূটনৈতিক দায়মুক্তি লাভ করেন। এরপর ২০১৭ সালের বড়দিনের আগের দিন রাতে দূতাবাসের কূটনৈতিক গাড়িতে করে তাকে দূতাবাস থেকে বের করে প্রথমে অন্য কোনো দেশে এবং পরবর্তীতে রাশিয়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

নাম প্রকাশ না করে চারটি ভিন্ন ভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান দাবি করে, এই পরিকল্পনার একপর্যায়ে রাশিয়াও জড়িত ছিল। দূতাবাসের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলির সাথে পরিচিত দুটি সূত্রের বরাত দিয়ে তারা দাবি করে, এই পরিকল্পনায় অ্যাসাঞ্জের সাথে রাশিয়ার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিলেন ফিদেল নারভায়েজ, যিনি কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও লন্ডন দূতাবাসে ইকুয়েডরের কনসাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাথে গোপন সম্পর্কের অভিযোগ অবশ্য এটাই প্রথম না। এর আগে সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা এডওয়ার্ড স্নোডেন, যিনি অ্যাসাঞ্জের মতোই মার্কিন গোপন তথ্য ফাঁস করে আলোচিত হয়েছিলেন, তাকে হংকংয়ের বন্দীদশা থেকে রাশিয়াতে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার ব্যাপারে তিনি সাহায্য করেছিলেন। নারভায়েজ অবশ্য অ্যাসাঞ্জের ব্যাপারে তার সাথে রাশিয়ার যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছেন।

গার্ডিয়ান দাবি করে, ইকুয়েডরের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান রমি ভ্যালেও অ্যাসাঞ্জের সফরের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করার জন্য ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বরে বা তার আশেপাশের সময়ে রাশিয়া সফর করেছিলেন। কিন্তু পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের পথে একটি বড় বাধা ছিল, যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্র তার যেকোনো নাগরিককে কূটনৈতিক কোনো পদে নিয়োগ দিলেও যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য তার নিয়োগ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি কূটনৈতিক দায়মুক্তি লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হন না। ফলে সাফল্যের সম্ভাবনা কম থাকায় শেষপর্যন্ত নির্ধারিত তারিখের মাত্র কয়েকদিন আগে পরিকল্পনাটি বাতিল করা হয়।

এদিকে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বার্তা সংস্থা রয়টার্সও প্রায় একই রকম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইকুয়েডর সত্যি সত্যিই জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে রাশিয়াতে অবস্থিত তাদের দূতাবাসে প্রেরণের উদ্দেশ্যে তাকে একটি কূটনৈতিক পদে দায়িত্ব দিয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাজ্য অ্যাসাঞ্জের নিয়োগ গ্রহণ না করায় শেষপর্যন্ত তা কার্যকর হতে পারেনি। রয়টার্স দাবি করে, তাদের প্রতিবেদকরা ইকুয়েডরের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একটি চিঠি থেকে ব্যাপারটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঐ চিঠিটি মূলত ২৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদনের সারমর্ম। ইকুয়েডরের এক সংসদ সদস্য পাওলা ভিন্তিমিলা দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তাদের সর্বশেষ কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা উত্তরে একটি চিঠি দিয়ে তাকে এসব তথ্য জানান। ঐ চিঠি অনুযায়ী, ইকুয়েডর গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর অ্যাসাঞ্জকে একটি কূটনৈতিক পদে দায়িত্ব দিয়েছিল, কিন্তু দুদিন পর ২১ ডিসেম্বর ব্রিটেন সরকার তা গ্রহণ করতে এবং অ্যাসাঞ্জকে কোনো রকম কূটনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

মার্কিন সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে এবং তার প্রতিষ্ঠিত উইকিলিক্সকে রাশিয়ার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে এসেছে। এ অভিযোগ সবচেয়ে জোরালো হয় যখন ২০১৬ সালের নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে উইকিলিক্স প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারী ক্লিনটনের প্রায় ৫০,০০০ হাজার ইমেইল ফাঁস করে দেয়। সে সময়ই অভিযোগ ওঠে যে, ইমেইলগুলো হ্যাক করেছিল রাশিয়ান হ্যাকাররা। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যদিও স্বীকার করেছিলেন যে তিনি তৃতীয় পক্ষ থেকে ইমেইলগুলো পেয়েছিলেন, কিন্তু রাশিয়ার সাথে কোনো সম্পর্ক তিনি সব সময়ই অস্বীকার করে এসেছেন।

কিন্তু গত জুলাই মাসে নির্বাচনে রাশিয়ান হস্তক্ষেপ বিষয়ে তদন্তকারী বিশেষ কৌসুলি রবার্ট মালার ঐ হ্যাকিংয়ের পেছনে রাশিয়ানদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবি করেন এবং প্রায় এক ডজন রাশিয়ান গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরকম সময়ে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের রাশিয়ায় যাওয়ার প্রচেষ্টা সংক্রান্ত সর্বশেষ এই ঘটনাটি নিঃসন্দেহে মার্কিন রাজনীতিতে নতুন আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিবে এবং ছয় বছর ধরে দূতাবাসে বন্দী অ্যাসাঞ্জের মুক্তির পথও আরো দুরূহ হয়ে উঠবে।

ফিচার ইমেজ – The Daily Dot

Related Articles

Exit mobile version