দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরালার কংগ্রেস সাংসদ এবং দেশের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শশী থারুর এখন সংবাদের শিরোনামে। গত ১১ জুলাই তার কেন্দ্র থিরুভনন্থপুরমে একটি অনুষ্ঠানে থারুর বলেন, আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে যদি বর্তমান শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জিতে ফের ক্ষমতায় আসে, তাহলে ভারতের ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হতে আর বিশেষ দেরি হবে না!
স্বভাবতই, তার এই মন্তব্য নিয়ে চারিদিকে প্রবল হৈচৈ পড়ে গিয়েছে। বিজেপির পক্ষ থেকে থারুরকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে; অভিযোগ হচ্ছে, তিনি এমন কথা বলে ভারতীয় গণতন্ত্র এবং হিন্দু জাতির অবমাননা করেছেন। দাবি তোলা হয়েছে, কংগ্রেস দলের অধ্যক্ষ নিজে যেন থারুরের এই মন্তব্যের জন্যে ক্ষমা চান।
অবস্থা বেশ বিরূপ বুঝে কংগ্রেসের তরফ থেকে তার সদস্যদের বলা হয়েছে, তারা যেন কথাবার্তা বুঝে শুনে বলেন। বলা হয়, কংগ্রেস ভারতের বহুত্ববাদের ঐতিহ্য বহন করে আসছে আর ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত এতটা নড়বড়ে নয় যে তা পাকিস্তান হয়ে যাবে। কংগ্রেসের বার্তা বিভাগ থেকে সদস্যদের বলা হয় তারা যেন এমন কথা প্রকাশ্যে না বলেন যাতে বিজেপির ‘মেরুকরণের রাজনীতি’ করার পথ সহজ হয়ে যায়।
‘ঘরপোড়া গরু’ কংগ্রেস চায় না আর এ জাতীয় বিতর্ক
এখানে বলা চলে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীকে চা-ওয়ালা বলে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কংগ্রেসের পায়েই কুঠারাঘাত করেন দলের বর্ষীয়ান নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার। তার সেই আক্রমণের পরেই মোদী সেই ‘চা-ওয়ালা’ অস্ত্রেই কংগ্রেসকে চূড়ান্ত ঘায়েল করেন সেই নির্বাচনে। ঘরপোড়া গরুর মতো তাই কংগ্রেস এবার খুব সতর্ক। রাহুল গান্ধীকেও মাঝেমধ্যেই দেখা গেছে দলীয় নেতা-কর্মীদের সাবধান করতে যে, তারা যেন কোনোরকম ব্যক্তিগত আক্রমণে না যান কারণ, তাতে লাভ হবে বিপক্ষেরই। আর তার থারুরের ‘হিন্দু পাকিস্তান’ মন্তব্য নিয়েও কংগ্রেসের অস্বস্তির কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
কিন্তু এ তো গেল নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণের কথা; যুদ্ধজয়ের জন্যে কী করা উচিত আর কী উচিত না তার ফিরিস্তির কথা। গণতন্ত্রে তো শুধু সেটাই শেষ কথা নয়, যদিও পৃথিবীর নানা প্রান্তেই এখন গণতন্ত্রের অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানে দলে যারা ভারী, তাদের কথাই শেষ কথা। এই প্রবণতার ফলে এখন গণতন্ত্র নামক রাজনৈতিক ধর্মটির আদর্শটিরই প্রায় মৃত্যু হয়েছে বলা চলে। আর শশী থারুরের মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা ঠিক এখানেই।
থারুরের বিচক্ষণতা নিয়ে তার অতি বড় শত্রুও প্রশ্ন তুলবে না, আর সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ব্যাপার হলো, থারুরের ‘হিন্দু পাকিস্তান’ মন্তব্যটির মধ্যে যুক্তি যথেষ্ঠ ধারালো এবং সেটা তার মতো পণ্ডিত মানুষ ঠিকঠাক অনুধাবন করেই বলেছেন। কিন্তু পপুলিজম-সর্বস্ব এদেশের গণতন্ত্র ছেঁকে নিয়েছে শুধু বিতর্কটিকে।
তার কারণ, তার এই মন্তব্যে যত বিতর্ক বাড়বে, ততই কার্যসাধন হবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী নেতা-সমর্থক-মানুষদের। তারা মুখে বলছেন ঠিকই থারুর তাদের অপমান করেছেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা খুশিই হয়েছেন নির্বাচনের আগের বছর এমন একটি বিষয় জনজীবনে উত্থাপিত হওয়ার জন্যে। এই ভাঙিয়ে তারা এখন বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা যে ইতিমধ্যেই বানিয়ে ফেলেছেন, তা চোখ বুজে বলে দেওয়া চলে।
থারুর ভুল কিছু বলেননি। এই মুহূর্তে ভারত অর্থনীতির বিচারে যতই এগোক না কেন, দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক/সামাজিক পরিস্থিতি যে খুব স্বস্তিদায়ক, তা বলা যাবে না। গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন তো কমেইনি, উল্টো শাসকদলের বড় নেতাদের এমন কথা বলতে শোনা যাচ্ছে বা করতে দেখা যাচ্ছে যে, সংখ্যালঘু পীড়নের পিছনে যে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষন রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো যে, এই সমস্ত কর্মকাণ্ডে শামিল হতে দেখা যাচ্ছে উচ্চশিক্ষিত নেতাদেরও, যা সংখ্যালঘু নিগ্রহকে এক ধরনের বৈধতা দান করছে।
থারুর মুখ খুলেছেন এরই বিরুদ্ধে। কিন্তু সমস্যা হলো আজকের ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের (আদর্শ বলছি না) রমরমা, তার পিছনে সমর্থন রয়েছে এই বড় অংশের মানুষের- অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে। এবং দেশের ‘লিবারেল’ ঐতিহ্যের অবস্থা এখন এতটাই বেহাল যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার অর্থ এক ধরনের রাজনৈতিক আত্মহত্যা। সংখ্যালঘুদের পীড়নের কথা হয়তো অরাজনৈতিক সমাজ সর্বসমক্ষে সমর্থন করবে না, কিন্তু হৃদয়ের অন্তর্মহলে কোথাও আজ ভারতীয় সত্তা নেহেরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে, ‘হৃদয়সম্রাট’ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীনে।
হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পটিকে যারা ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির উপরে আজ চাপিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর এবং ব্যস্ত, তারা খেলাটি খেলছেন দুভাবে। একদিকে তোলা হচ্ছে উন্নয়নের জিগির, বলা হচ্ছে ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ অর্থাৎ উন্নয়নের মতো একটি সার্বজনীন শব্দবন্ধকে সামনে রেখে দেখানো হচ্ছে যে, বহুমতকে আজও গুরুত্ব দেওয়া হয় ভারতের মাটিতে, কিন্তু অন্যদিকে এক আগ্রাসী নীতির মাধ্যমে এক হিন্দুরাষ্ট্রের নির্মাণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সংখ্যাগুরুর ধর্মকে সংখ্যালঘু ধর্মের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতিই আজ পাকিস্তানকে কুখ্যাত করেছে আর সে দেশের অর্থনৈতিক প্রাবল্য না থাকাতে সেই নির্লজ্জ আগ্রাসনকে ঢেকে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ভারতের যেহেতু অর্থনৈতিক উত্থানের একটি চমকপ্রদ কাহিনী রয়েছে, অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে আড়াল করা এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে কঠিন কাজ নয়।
থারুরের পক্ষে এই জটিল কিন্তু কার্যকরী অক্ষকে ভাঙা সম্ভব নয়। প্রথমত, তিনি এমন একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য যারা আজ সমস্ত ভাবমূর্তি খুইয়ে প্রায় নিঃস্ব। থারুর আজ যতই গলা ফাটিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের উদ্বেগজনক গতিপ্রকৃতিকে বোঝানোর চেষ্টা করুন না কেন, বেশিরভাগই তা বুঝবে না। বরং পাল্টা প্রশ্ন তাকে করা হবে, “আপনাদের দল সত্তর বছরে কী করেছে?”
থারুর নিজেও একজন ‘সংখ্যালঘু’; তার সাফল্যের আশা কম
দ্বিতীয়ত, থারুর নিজেও একজন সংখ্যালঘু। ধর্মীয় কারণে নন, ইন্টেলেকচুয়াল অর্থে। পপুলিজম-এর স্রোতে ভেসে চলা এদেশের গণতন্ত্রে আজ মানুষ কম, উপভোক্তা বেশি। আধা বাজার-অর্থনীতি আর আধা সামন্ততন্ত্রের জগাখিচুড়ি এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় থারুরের পাণ্ডিত্যপূর্ণ মতামত উৎসাহের সঙ্গে শুনবেন এবং বুঝবেন এমন লোক এদেশে খুব বেশি নেই আজ। নেহরুর সময়ে হলে হয়তোবা তাও কিছু প্রশংসা আশা করা যেত, কিন্তু আজ নয়। গণতন্ত্র আজ আর গন্তব্যে পৌঁছানোর রাস্তা নয়, নিজেই একটি গন্তব্য। মোদীর মতো একজন হিন্দু হৃদয়সম্রাট দেশনেতা; অর্থনৈতিক উত্থান; পরমাণু অস্ত্র মজুদ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সুদৃঢ় ইত্যাদি নানা স্বস্তির ঘেরাটোপে থেকে আজ সংখ্যালঘুদের পরিনাম নিয়ে ‘সময় নষ্ট’ করতে বেশি কেউ আর চায় না। তাই থারুরের বক্তব্যে বিবেককে নাড়ানোর এক আবেদন থাকলেও তাতে কাজের কাজ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
ভারতীয় জনজীবনে ভালো কিছু বলুন, ‘পাকিস্তান’ কখনোই নয়
পাশাপাশি বলা দরকার ‘পাকিস্তান’ প্রসঙ্গটির কথাও। আজকের ভারতের এক বিরাট শ্রেণীর মানুষের কাছে পাকিস্তান নামটি একধরনের হিস্টিরিয়া তৈরি করে। কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া নানা কাণ্ড এবং অহোরাত্র তা নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর (অতি)জাতীয়তাবাদী আস্ফালন ভারতজুড়ে এক প্রবল পাকিস্তান-বিরোধী মতামত তৈরি করেছে। দেশটির নামের সামান্যতম উচ্চারণেও এদেশে আজ ঘৃণার পরিপূর্ণ আঁচ পাওয়া যায়। আর সেখানে দাঁড়িয়ে বিজেপি (মোদী) ফের ক্ষমতায় এলে ভারত ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হয়ে যাবে জাতীয় মন্তব্য করা মানে আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়া। মোদীর সঙ্গে পাকিস্তানকে কোনোভাবে জোড়া দেওয়া মানে তা আত্মঘাতী পদক্ষেপ।
থারুরের দুর্ভাগ্য যে এদেশের রাজনীতিতে এখন যুক্তি আর আদর্শের কোনো ভূমিকা নেই। এখন ক্ষমতায় যারা আসেন তারা কোন দানে কাকে বাজিমাত করা যায়, সেটা বুঝেই খেলেন। থিরুভনন্থপুরমে করা তার মন্তব্য এবং তার পরেও ক্রমাগত আত্মসমপর্ণ থারুরের দলকেই আরও অপ্রিয় করছে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী মনোভাবাপন্ন শ্রেণীর কাছে। আর এদের ভোট না পেলে দিনের শেষে সবই ফাঁকা মনে হবে।
Featured Image Source: DNA India