রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর আগে রুশ–ইউক্রেনীয় দ্বন্দ্বের নিরসনের জন্য যেসব প্রস্তাবনা উত্থাপিত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘ইউক্রেনের ফিনল্যান্ডাইজেশন’ (Finlandization of Ukraine)। ইংরেজি ভাষায় ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘ফিনল্যান্ডীকরণ’ বা ‘(কোনো কিছুকে) ফিনল্যান্ডে পরিণত করা’। আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্য ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার নাম। সংক্ষেপে বলতে গেলে, স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ফিনল্যান্ড কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি অনুসৃত নীতির অনুসৃতির প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’।
ফিনল্যান্ড উত্তর ইউরোপে অবস্থিত একটি রুশ সীমান্তবর্তী নর্ডিক রাষ্ট্র। ১৮০৮–০৯ সালের রুশ–সুইডিশ যুদ্ধে রাশিয়ার নিকট সুইডেনের পরাজয়ের ফলে ফিনল্যান্ড রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৮০৯ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ‘গ্র্যান্ড প্রিন্সিপালিটি অফ ফিনল্যান্ড’ ছিল রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে ফিনল্যান্ড রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৭ সালে সংঘটিত বলশেভিক বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় (পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে) কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, ফিনল্যান্ডের শাসনব্যবস্থা ছিল কট্টর কমিউনিজমবিরোধী এবং এর ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফিনল্যান্ডের মধ্যবর্তী সম্পর্ক ছিল সাধারণভাবে শত্রুভাবাপন্ন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৩৯–৪০ সালে সংঘটিত ফিনিশ–সোভিয়েত যুদ্ধে ফিনল্যান্ড পরাজিত হয় এবং ফিনল্যান্ডের প্রায় ৯% ভূখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তগত হয়। ১৯৪১ সালে ফিনল্যান্ড অক্ষশক্তির সঙ্গে মিলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু ১৯৪৪ সাল নাগাদ ফিনল্যান্ড সামরিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে বাধ্য হয় এবং আরো কিছু ফিনিশ ভূখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তগত হয়। তদুপরি, উক্ত চুক্তি অনুসারে ফিনল্যান্ড তাদের ভূখণ্ড থেকে জার্মান সৈন্যদের অপসারণ করতে সম্মত হয় এবং এই শর্ত বাস্তবায়নের জন্য তাদেরকে জার্মানির বিরুদ্ধে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে এস্তোনিয়া, লাতভিয়া ও লিথুয়ানিয়া এবং রুমানিয়ার অংশবিশেষ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়, এবং পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়া সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লিখিত প্রতিটি ভূখণ্ডে সোভিয়েত ধাঁচের একদলীয় কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা স্থাপিত হয় এবং শেষোক্ত ছয়টি রাষ্ট্র সোভিয়েত–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ওয়ারশ জোটে’র অন্তর্ভুক্ত হয়। ফিনল্যান্ড ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী, সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় ফিনল্যান্ডের সামরিক–অর্থনৈতিক সামর্থ্য ছিল বহুগুণে সীমিত এবং অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে প্রস্তুত ছিল না। এমতাবস্থায় ফিনল্যান্ড পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের মতো একটি সোভিয়েত–নিয়ন্ত্রিত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হবে, এরকম সম্ভাবনা ছিল।
কিন্তু ফিনিশ রাষ্ট্রনায়করা চাতুর্যের সঙ্গে এই পরিস্থিতি এড়াতে সক্ষম হন। ফিনিশ রাষ্ট্রপতি জুহো পাসিকিভি (১৯৪৬–১৯৫৬) সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে ফিনল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব (internal sovereignty) বজায় রাখার চেষ্টা করেন। ১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফিনল্যান্ডের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে, জার্মানি বা তার মিত্ররা ফিনল্যান্ডের ওপর বা ফিনিশ ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করলে ফিনল্যান্ডকে উক্ত আক্রমণ প্রতিহত করতে হতো। এমতাবস্থায় ফিনল্যান্ড চাইলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সামরিক সহায়তা চাইতে পারতো। কিন্তু অন্য কোনো দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের শিকার হলে সেক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিক সহায়তা প্রদান করতে বাধ্য ছিল না। তদুপরি, এই চুক্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব থেকে ফিনল্যান্ডের দূরে থাকার ইচ্ছাকে স্বীকার করে নেয়।
এই চুক্তির ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ডকে বলপূর্বক নিজস্ব প্রভাব বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করার বা ফিনল্যান্ডে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকে। এর ফলে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ফিনল্যান্ডকে ওয়ারশ জোটে যোগদান করতে হয়নি এবং ফিনল্যান্ডে গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় সরকারব্যবস্থা বজায় ছিল। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফিনল্যান্ড একটি ‘নিরপেক্ষ রাষ্ট্র’রূপে পরিচিতি লাভ করে। পাসিকিভি ও তার উত্তরসূরী ফিনিশ রাষ্ট্রপতি উরহো কেক্কোনেন (১৯৫৬–৮২) সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি এই নীতি অব্যাহত রাখেন এবং এজন্য এই নীতিকে ‘পাসিকিভি–কেক্কোনেন ডকট্রিন’ বা ‘পাসিকিভি–কেক্কোনেন লাইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
অবশ্য পাসিকিভি ও কেক্কোনেন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালে এমন বেশকিছু অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন, যেগুলোকে সোভিয়েতঘেঁষা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ফিনল্যান্ড ‘মার্শাল প্ল্যান’কে প্রত্যাখ্যান করে এবং মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগদান থেকে বিরত থাকে। ফিনল্যান্ড নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে একটি প্রতিরক্ষা জোট গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। জাতিসংঘে ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড সাধারণত সোভিয়েত–নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষে ভোট দিতো নয়তো নিরপেক্ষ থাকতো। ফিনল্যান্ডে সোভিয়েতবিরোধী বইপত্র ও চলচ্চিত্র প্রকাশের ওপর বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ ছিল। তদুপরি, ফিনিশ রাজনীতিবিদরা সাধারণভাবে সোভিয়েতবিরোধী অবস্থান গ্রহণ থেকে বিরত থাকতেন।
কিন্তু এটি ধরে নিলে ভুল হবে যে, স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি সোভিয়েতঘেঁষা ছিল। বস্তুত পাসিকিভি ও কেক্কোনেন ফিনল্যান্ডের অভ্যন্তরে নিজেদের ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ককে ব্যবহার করেন। তদুপরি, ফিনল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা যতদূর সম্ভব সীমিত রাখতো এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে গোপনে সহযোগিতা করতো। সুতরাং ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি সোভিয়েতঘেঁষা ছিল, এমনটা নয়।
ফিনল্যান্ডের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এরকম পররাষ্ট্রনীতিই ছিল তাদের জন্য বাস্তবসম্মত। তাদের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির কারণে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ফিনল্যান্ড দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়নি। তদুপরি, মস্কো যেভাবে সোভিয়েত বলয়ভুক্ত পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতো, ফিনল্যান্ডের অনুসৃত নীতির কারণে তারা কখনো ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে সেরকম প্রচেষ্টা চালায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির এবং ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য উক্ত রাষ্ট্রগুলোতে সৈন্য প্রেরণ করেছিল। ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে তারা কখনো অনুরূপ পদক্ষেপ নেয়নি। এটিকে ‘পাসিকিভি–কেক্কোনেন ডকট্রিন’ বা ‘পাসিকিভি–কেক্কোনেন লাইনে’র সাফল্য হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে।
অর্থাৎ, স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ছিল এরকম: ফিনল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা ও (বহুলাংশে) বাহ্যিক সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতো। এই প্রক্রিয়াটিই ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কোনো বৃহৎ শক্তির সীমান্তবর্তী/নিকটবর্তী রাষ্ট্র যদি উক্ত বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজস্ব স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে উক্ত রাষ্ট্রটির ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ ঘটেছে বলা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ফিনল্যান্ড উক্ত নীতি পরিত্যাগ করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে ফিনল্যান্ড সোভিয়েত–ফিনিশ ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তা’ চুক্তিটিকে একপাক্ষিকভাবে বাতিল ঘোষণা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে এবং ২০২২ সালে ফিনল্যান্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোয় যোগদানের জন্য আবেদন করেছে। অর্থাৎ, ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ এখন আর খোদ ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। তদুপরি, পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’কে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতো এবং সোভিয়েত প্রভাব বিস্তারের একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতো।
কিন্তু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর আগে যদি ইউক্রেনের ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ করা হতো, অর্থাৎ যদি ইউক্রেন তার প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ও ন্যাটোয় যোগদানের প্রচেষ্টা থেকে বিরত থেকে নিজস্ব স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালাতো, সেক্ষেত্রে এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তুলনামূলকভাবে সীমিত। এজন্য বলা যেতে পারে যে, ফিনল্যান্ড নিজে ‘ফিনল্যান্ডাইজেশন’ প্রক্রিয়া থেকে সরে এলেও উক্ত প্রক্রিয়াটি এখনো অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে।