২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথমবারের মতো ধরা পড়া করোনাভাইরাস কয়েকমাসের মধ্যেই ছড়িয়ে পরে পুরো পৃথিবীতে, বদলে দেয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধরন, মানুষের যাপিত জীবনের নিয়মগুলোও বদলে যায় এই সময়ে। এরপর গত দেড় বছরে রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের রক্ষায় একের পর এক প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষে থাকা দেশগুলো উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষেধক তৈরির। গত এক শতাব্দীর মধ্যে ভয়াবহ মানবিক দুর্যোগ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই মহামারি থেকে উত্তরণের একটি উপায়ই এখন পর্যন্ত মানবসভ্যতার কাছে আছে। সেটি হচ্ছে, চিকিৎসাবিজ্ঞান আর জনস্বাস্থ্যের সাথে জড়িত গবেষকদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন।
এখন পর্যন্ত এই মহামারিতে ১৮২ মিলিয়নের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ। মহামারিকালে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার বিঘ্নিত হয়েছে, রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের সাথে কর্তৃত্ববাদী আচরণ বাড়িয়েছে, প্রথাগত আর অপ্রথাগত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে রয়েছে, স্বাভাবিক জীবন থেকে সরে গিয়ে মানুষকে মেনে নিতে হয়েছে ‘নিউ নর্মাল’ জীবন। সরকারপ্রধানদের চাপে আর উদ্ভাবকদের নিরলস পরিশ্রমে রেকর্ড পরিমাণ কম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে, প্রায় সবগুলোই এখন বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হচ্ছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন; ২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণযোগ্য এই ভ্যাকসিন ইতোমধ্যেই পেয়েছে ব্যবহারের অনুমোদন। যুক্তরাষ্ট্র আর জার্মানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ফাইজার-বায়োনটেক কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন, যুক্তরাষ্ট্র আর নেদারল্যান্ডসের যৌথ উদ্যোগে উদ্ভাবিত হয়েছে জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন। চীনের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন, রাশিয়ার ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে সর্বাধিক কার্যকারিতা দেখাচ্ছে স্পুটনিক-ভি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি
প্রথাগতভাবে, ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি বলতে স্বীয় দেশের নাগরিকদের ভ্যাকসিনের নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক তৎপরতা এবং উৎপাদক দেশের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে ভ্যাকসিন সরবরাহ করাকে বোঝায়। এ প্রক্রিয়াতে জাতীয় স্বার্থের প্রাধান্য থাকে সর্বোচ্চ, যেটি জনস্বাস্থ্য আর প্রথাগত ডিপ্লোমেসির একটি হাইব্রিড প্রক্রিয়া।
প্রথাগত এই জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির বাইরেও আরো দুই ধরনের ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, আঞ্চলিক সংগঠন, জনস্বাস্থ্যকেন্দ্রিক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও, বৈশ্বিক সিভিল সোসাইটিকে নিয়ে যে ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির কাঠামো তৈরি হয়, সেটি পরিচিত মাল্টি-স্টেকহোল্ডার ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি হিসেবে। কোভিড-১৯ মহামারিকে কেন্দ্র করেও একই ধরনের একটি কাঠামো গড়ে উঠেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে, যা পরিচিতি পেয়েছে কোভ্যাক্স নামে। এ ধরনের কাঠামোর লক্ষ্য থাকে পৃথিবীব্যাপী ভ্যাকসিনেশনে সমতা আনা, বৈশ্বিক ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করা এবং বৈষম্য কমিয়ে আনা। তৃতীয় যে ধরনটি রয়েছে ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির, সেটি পরিচিত ইনফরমাল ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি নামে। এ প্রক্রিয়ায় সাধারণত ভ্যাকসিন উৎপাদকের সাথে ব্যক্তি বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়, যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সাথে দায়বদ্ধ নয়।
ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ
এখন পর্যন্ত যেহেতু ভ্যাকসিনই হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের একমাত্র পথ এবং মহামারির ফলে সৃষ্ট বাস্তবতাগুলো থেকে উত্তরণের সহজ উপায়, সেজন্য পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সরকারই উৎপাদিত ভ্যাকসিন থেকে নিজের দেশের নাগরিকদের জন্য যথেষ্ট ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাচ্ছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এটা খুব আশ্চর্যজনক নয় যে, এ প্রতিযোগিতায় নিরঙ্কুশভাবে এগিয়ে রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলো। নিজের দেশের নাগরিকদের জন্য তারা ভ্যাকসিন পুরোপুরি নিশ্চিত করতে আগ্রাসী নীতি নিয়েছে, বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যালসগুলোর সাথে ভ্যাকসিনের চুক্তি করছে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণের। কানাডা তার জনসংখ্যার তুলনায় পাঁচগুণ বেশি ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করেছিল গত বছরে। এই বছরে যুক্তরাষ্ট্র একটা দীর্ঘ সময়ে তার উদ্বৃত্ত ভ্যাকসিন মজুত করে রেখেছিল।
ভ্যাকসিনের উৎপাদক দেশগুলোও হাঁটছে একই পথে, ভ্যাকসিনকে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম হিসেবে। চীন শুরু থেকেই নিজের প্রভাববলয়ের মধ্যে থাকা দেশগুলোকে ভ্যাকসিনের যোগান দিচ্ছে, ভ্যাকসিনকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক বলয় তৈরি করতে। এ প্রক্রিয়ায় চীন তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে। সরবরাহ করছে ভ্যাকসিনেশনের প্রক্রিয়াতে পিছিয়ে পড়া আফ্রিকাতে। একই ভূমিকা দেখা গেছে দক্ষিণ এশিয়ার আরেক উৎপাদক দেশ ভারতের ক্ষেত্রেও। আবার, নিজ দেশে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে করা চুক্তি রক্ষা না করে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা বন্ধ করেছে।
মানবিক প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে, নিজের দেশের নাগরিকদের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে আগ্রাসী নীতি নেওয়া এবং রাজনৈতিক স্বার্থে ভ্যাকসিনের সরবরাহকে প্রভাবিত করার যে চেষ্টা উৎপাদক এবং ধনী দেশগুলো নিয়েছে, এটিই ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ।
বৈশ্বিক ভ্যাকসিনেশনে এর নেতিবাচক প্রভাব
বিভিন্ন কারণেই ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ বৈশ্বিক ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রথমত, প্রযুক্তির উৎকর্ষে থাকা ভ্যাকসিন উৎপাদক দেশগুলো ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ায় ‘মি-ফার্স্ট অ্যাপ্রোচ’ নিয়েছে, একই ধরনের প্রবণতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী অবস্থানে থাকা দেশগুলোরও। তাদের এহেন আচরণের ফলে ঝুঁকির বিচারে ভ্যাকসিনেশন করা সম্ভব হচ্ছে না বৈশ্বিকভাবে। অধিকাংশ গবেষণাই বলছে, বয়স্ক মানুষেরা করোনায় আক্রান্ত হলে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন, তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিতে থাকেন অল্পবয়সীরা। এ ঝুঁকি বিবেচনায় ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম পরিচালনা করলে মহামারির কারণে মানবিক দুর্ভোগের পরিমাণ কমে আসত।
দ্বিতীয়ত, কট্টর জাতীয়তাবাদী নীতি থেকে অনেক উৎপাদনকারী দেশ ভ্যাকসিনের প্রবাহকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ায়। একই ভূমিকা রাখছে উদ্ভাবক দেশগুলোও। উদ্ভাবক দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ‘ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অভ ইন্টারন্যাশনাল প্রপার্টি’ বা মেধাস্বত্ব থেকে দায়মুক্তি দেয়নি। ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই দায়মুক্তি স্বল্পোন্নত দেশগুলো পেলে বৈশ্বিক ভ্যাকসিনের সংকট দ্রুত কেটে যেত, এসব দেশের মানুষেরা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত। ভ্যাকসিন উৎপাদনের স্বত্ব থেকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুবিধার জন্যই এই দায়মুক্তি দেয়নি উদ্ভাবক দেশগুলো।
তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনতুষ্টিবাদী সরকারের উত্থান ঘটেছে, উত্থান ঘটেছে কর্তৃত্ববাদী সরকারের। এই দুই শ্রেণির সরকারপ্রধানদেরই সাধারণত বিভিন্ন শ্রেণিস্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে। ক্ষমতার বৈধতা বজায় রাখতে এদের থাকতে হয় নিজস্ব রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যেই। কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই সমীকরণের একটি প্রকাশ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ঘটতে দেখা যায়। এই রাজনৈতিক বলয়ের সমীকরণ নেতিবাচক প্রভাব রাখছে ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ায়, দীর্ঘায়িত করছে বৈশ্বিক হার্ড ইনিউনিটি অর্জনের প্রক্রিয়াকেও।
ভ্যাকসিনেশন বৈষম্য
প্রতি ১০০ জন নাগরিকের বিপরীতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৫১টি ডোজ দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইসরায়েল ১০০ জনের বিপরীতে দিয়েছে ১২৩ ডোজ, চিলি দিয়েছে ১১৪ ডোজ, যুক্তরাজ্য দিয়েছে ১১১ ডোজ আর যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে ৯৬ ডোজ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী কানাডা প্রতি ১০০ জনের বিপরীতে এখন পর্যন্ত দিয়েছে ৯১ ডোজ, জার্মানি দিয়েছে ৮৫ ডোজ, স্পেন দিয়েছে ৮৩ ডোজ, ইতালি আর চীন যথাক্রমে দিয়েছে ৮০ আর ৭৯ ডোজ।
অন্যদিকে আফ্রিকার দেশ চাদে প্রতি ১০০ জন নাগরিকের বিপরীতে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে ০.০৫ ডোজ, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে ০.০৬ ডোজ, বেনিনে ০.২২ ডোজ, দক্ষিণ সুদানে ০.২৯ ডোজ, জাম্বিয়াতে ০.৮২ ডোজ, মালিতে ০.৮৯ ডোজ, নিগারে ১.০৬ ডোজ, সোমালিয়াতে ১.২ ডোজ, সিয়েরা লিওনে ১.২২ ডোজ, মোজাম্বিকে ১.৪ ডোজ, সুদানে ১.৪৪ ডোজ।
ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের ঝুঁকি
আগ্রাসী ভ্যাকসিন নীতির মাধ্যমে ধনী দেশগুলো তাদের নাগরিকদের ভ্যাকসিনেশন নিশ্চিত করলেও, এটি বৈশ্বিক হার্ড ইউমিউনিটি তৈরিতে ভূমিকা রাখবে না। বরং, ভ্যাকসিনেশন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে না পারা দেশগুলোতে ভাইরাসটির নতুন নতুন প্রকরণ তৈরি হতে থাকবে, যেগুলো হবে আগের চেয়ে বেশি সংক্রামক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট কাবু করতে পারে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আসা লোকদেরকেও। ফলে, পৃথিবীকে দ্রুত হার্ড ইউমিউনিটির দিকে নিতে, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে প্রয়োজন সমন্বিত, মানবিক উদ্যোগ, যা দেশ বা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সীমানার বাইরে গিয়ে গ্রহণ করতে হবে।