মানবসভ্যতার ইতিহাস যতদিনের, মানুষের শৃঙ্খলিত জীবনে রাষ্ট্র তৈরির ইতিহাস যতদিনের, সুনীল রাতের মতো মানুষের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার ইতিহাসও ততদিনের। মানবসভ্যতার ইতিহাসে হাজার রকমের অপরাধ রয়েছে, পার্থক্য রয়েছে অপরাধের ধরন আর প্রকৃতিতে। সাধারণভাবে, যেসব চুক্তির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র তৈরি, সেগুলোর লঙ্ঘনকেই অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যাপক অর্থে, সমাজের প্রথা বা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিগুলো লঙ্ঘনও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন, প্রাচীনকালে বিলাসবহুল জীবনকে বিচ্যুতি হিসেবে গণ্য করা হতো, রোমান সভ্যতায় বিবেচনা করা হতো ‘পাপ’ হিসেবে। তবে, পালনের বাধ্যবাধকতা না থাকায়, প্রথার লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্র সাধারণত কোনো শাস্তি দেয় না।
রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে চেয়েছে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে, অপরাধকে স্বাভাবিক জীবনের মূলধারা থেকে দূরে রাখতে। ফলে, রাষ্ট্রের প্রথম তৈরি তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ছিল জেলখানা, বাকি দুইটি ছিল হাসপাতাল ও মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্র।
কিশোররা কেন অপরাধে জড়াচ্ছে?
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অপরাধের একটি নতুন ধারার উত্থান ঘটছে। ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও খুনের মতো পরিকল্পিত অপরাধগুলোতে যুক্ত হচ্ছে কিশোররা। এসব কিশোর অপরাধীর বয়স সাধারণত ১২ থেকে ১৮ এর মধ্যে থাকে। কিশোরদের নিঃসঙ্গতা, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া, বন্ধুবান্ধবদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, অস্ত্রের সহজলভ্যতা, পারিবারিক কলহের সংস্কৃতি, বাবা মায়ের বিচ্ছেদ, আলাদা বসবাস, ভঙ্গুর পারিবারিক কাঠামো, অপরাধপ্রবণ সমাজ, অপরাধী প্রতিবেশী কিশোরদের অপরাধী হয়ে উঠার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
আবার, মাদকের সহজলভ্যতা, শিক্ষার অভাব, স্কুলে শিক্ষকদের দূর্ব্যবহার, স্কুলের ফলাফলে ক্রমাগত খারাপ করা, অর্থনৈতিক সংকট, অর্থনৈতিক চাপও কিশোরদের অপরাধের পথে নিয়ে যায়। এই পরিবেশের মধ্যে থাকা কিশোররা সাধারণত অপরাধী চক্রগুলোর নজরে থাকে এবং কিশোরদের অপরাধী চক্রে যুক্ত হয়ে যাওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে যায়।
তবে, এই কারণগুলো সাধারণভাবে কিশোরদের একক বা বিচ্ছিন্ন অপরাধ বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে। কিন্তু, কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধ বিস্তারের ক্ষেত্রে, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোর বাইরেও কিছু কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে দুইটি প্রধান কারণ আছে কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধ বিস্তারের ক্ষেত্রে এবং কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র গড়ে উঠার ক্ষেত্রে। প্রথমত, রাজনৈতিক সংস্কৃতি; দ্বিতীয়ত, অপরাধী চক্রগুলোর পেছনে থাকা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি
একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা বোঝার জন্য আদর্শ মানদণ্ড দিতে পারে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাপারে ধারণা। একটি রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করা নাগরিকদের মৌলিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতার চর্চা, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাটি একটা দীর্ঘ সময় ধরে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। গ্যাব্রিয়েল এলমন্ড ও সিডনি ভার্বার পর্যালোচনায় তিন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি ও মেক্সিকোর রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণের মাধ্যমে। তিন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে- সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাবজেক্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পরিণত রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
সব ধরনের সংস্কৃতিতেই কিশোররা অপরাধে জড়ায়, গড়ে উঠে কিশোরদের অপরাধী চক্র। তবে, সাধারণভাবে সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশগুলোতে কিশোর অপরাধের সংখ্যা বেশি। তুলনামূলকভাবে বেশি সহিংস অপরাধে জড়ায় এসব দেশেই। কিশোরদের অপরাধী চক্রগুলোর উপস্থিতিও সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশগুলোতেই বেশি।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা
একটি দেশের শাসনতন্ত্র যথাযথভাবে কাজ করার জন্য অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে নাগরিক সুবিধা আর মৌলিক অধিকারগুলো সরবারহের ক্ষেত্রে। যেসব দেশে সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থাকে, সেসব দেশের নাগরিকদের জীবন হয় অনেকটা ‘প্রজার’ মতো, রাজনৈতিক সচেতনতা তাদের মধ্যে কম থাকে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোতে অংশগ্রহণের সুযোগও কম। ফলে, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে যেমন এদের জ্ঞানের স্বল্পতা থাকে, একইভাবে ঔদাসীন্য থাকে রাষ্ট্রের দায়িত্বগুলো ঠিকঠাকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা, সে বিষয়েও।
নাগরিকদের এই রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার ফলে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় একক কাঠামোর কাছে, ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কতিপয় মানুষের হাতে। রাষ্ট্রের সকল নীতি নির্ধারিত হয় কতিপয় সেই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীটিকে কেন্দ্র করে। ফলে, কতিপয় মানুষের বাইরে রাষ্ট্রের বিরাট একটা অংশ ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে, একটি অঞ্চলে যখন কিশোর অপরাধের উত্থান ঘটে, তখন নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র সাধারণত কিছুই করে না। এরই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার কিশোর অপরাধীরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তোলে, যার মাধ্যমে তারা বড় ধরনের অপরাধগুলো সংঘটিত হয়।
যেসব দেশে সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে, সেসব দেশের বড় একটা অংশ গত শতাব্দীতে স্বাধীনতা পেয়েছে। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের মতে, এগুলো পরিবর্তনশীল সমাজ। পরিবর্তনশীল সমাজগুলোতে আমলাতন্ত্রে আসা শিক্ষিত অংশতার মধ্যে সমাজের প্রথাগত মূল্যবোধ আর বৈশ্বিক মূল্যবোধের একটা মানসিক দ্বন্দ্ব থাকে, যা একটা সময় মূল্যবোধহীন করে তোলে। এই মূল্যবোধহীন অংশটা ব্যাপকভাবে দূর্নীতির সাথে জড়িয়ে যায়। পরিবর্তনশীল সমাজ, যেগুলোতে সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি রয়েছে, যেসব দেশে কিশোর অপরাধের বিস্তার এবং অপরাধী চক্র গড়ে উঠার পেছনে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সীমাহীন দূর্নীতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কিশোর অপরাধী চক্রগুলোর টিকে থাকা নির্ভর করে আমলাতন্ত্রের দূর্নীতির উপর ভিত্তি করেই।
সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা
যেকোনো অপরাধ বিস্তার রোধে প্রাথমিক ভূমিকা রাখে সমাজ। সমাজের ভূমিকাই হয়ে উঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রেও এই প্রভাবকটির ভূমিকা আছে অন্য সকল প্রভাবকের চেয়ে বেশি। সাধারণভাবে, একটি সামাজিক কাঠামো সুস্থভাবে কাজ করলে, সামাজিক কাঠামোতে নীতি আর নৈতিকতার চর্চা থাকলে, সেই সমাজ থেকে কিশোর অপরাধী কম তৈরি হয়।
তুলনামূলকভাবে, যেসব সমাজের কাঠামো অস্থিতিশীল, সামাজিক কাঠামোর মধ্যে অপরাধীদের বসবাস রয়েছে, মাদকের সহজলভ্যতা রয়েছে, রয়েছে অস্ত্রের সহজলভ্যতা, সেসব সমাজে কিশোর অপরাধের বিস্তার ঘটে বেশি। কিশোর অপরাধের ঘটনাগুলো ঘটলে, রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া অনেক সময়ই নাগরিকদের প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়। সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কিশোর অপরাধের ঘটনা ঘটলে, সেই দেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকায় আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর সাথে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা না থাকায়, কিশোর অপরাধীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো বাঁধা পায় না। বাঁধা আসে না সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো থেকেও।
সাবজেক্ট পলিটিক্যাল কালচারে নাগরিকদের একটা অংশ রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকে। বাকি বিরাট একটা অংশেরই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনো আগ্রহ থাকে না। থাকে না রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোতে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা। তবে, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় অংশটি বিভিন্ন সময়ে কিশোর অপরাধের ঘটনাগুলোতে প্রতিক্রিয়া দেখায়, যেগুলো বিভিন্ন কারণে জাতীয় পরিসরে আলোচনায় আসে। ফলে, রাষ্ট্রের উদ্যোগও হয় অনেকটা ‘সিলেক্টিভ’। যেসব ঘটনা সকলের নজরে আসে, রাষ্ট্র সাধারণত সেসব ঘটনাতেই প্রতিক্রিয়া দেখায়, অপরাধীদের বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করে। সমাজ থেকেও একই ধরনের প্রতিরোধ দেখা যায়, যেটি কিছু জায়গায় প্রকট হয়।
অংশগ্রহণমূলক বা পরিণত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সাধারণত রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি থাকে, সকল ধরনের অপরাধের ঘটনাই কম ঘটে, রাষ্ট্রের সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের উপস্থিতি থাকায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উপস্থিতিও দেখা যায়। এসব সমাজে কিশোর অপরাধের ঘটনা সামাজিকভাবে প্রবল প্রতিক্রিয়ার তৈরি করে, একজটা স্থিতিশীল সামাজিক কাঠামো থাকায় সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের উপস্থিতিও থাকে একেবারেই সীমিত পরিসরে। এসব চক্রও থাকে রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে, রাষ্ট্র উদ্যোগ নেয় অপরাধ প্রতিরোধে ও প্রতিকারে।
জনতুষ্টিবাদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব
নব্বইয়ের দশকে একক শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। তবে, এসব দেশে রাজনৈতিক বিকাশ না হওয়ায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার উদাহরণ তৈরি না হওয়ায়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ না ঘটায়, দ্রুতই বিকাশ ঘটে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের উত্থানের দুইটি বড় ঢেউ দেখা গেছে, যার প্রথমটি ঘটে নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে, এশিয়ার ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের পরবর্তী সময়ে। দ্বিতীয় ঢেউ দেখা গেছে গত দশকে, বৈশ্বিক মহামন্দার পরে।
চাণক্যের মতে, রাজনীতি রাষ্ট্রের অপরাপর সকল বিষয়ের নিয়ন্ত্রক। ফলে, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিতে নেতারা যখন বিভিন্ন বিভাজনকে উস্কে দেয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করে, জাতিগত বিভাজনকে স্থায়ী রূপ দিতে গিয়ে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ঘৃণা তৈরি করে, এর প্রভাব কিশোরদের মনস্তত্বে পড়ে, তাদেরকে আগ্রাসী করে তোলে। বয়সন্ধিকালে পরিচয়ের সন্ধানে থাকা কিশোররা তাই দ্রুতই এসব রাজনোইতিক বয়ানে আকৃষ্ট হয়ে সংখ্যালঘুদের উপর সংঘবদ্ধ আক্রমণ করে, অন্য জাতিগোষ্ঠীর উপর বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করে।
আবার, জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদদের সময়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, কর্তৃত্ববাদের উত্থান ঘটে। এর সাথে আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে উঠে, নিপীড়ক হয়ে উঠে। বিভাজনের বিন্যাসে সামাজিক কাঠামো হয়ে যায় অস্থিতিশীল। এগুলো কিশোর অপরাধ বিকাশে সহায়ক।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা
আটলান্টিক রেভ্যুলুশনের পরেই জাতিরাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ ঘটে। পরের কয়েক দশকে আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাড়ে ঘটে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন, নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বদলে কিছু জায়গায় আসে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, কিছু জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় জনতন্ত্র। বর্তমান সময়ে প্রায় দুইশোর মতো জাতিরাষ্ট্রের উপস্থিতি আছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাঠামোতে।
তবে, অর্থনৈতিক সাম্য, রাজনৈতিক জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচারের মতো যেসব মূল্যবোধ নিয়ে জাতিরাষ্ট্রের ধারণার বিকাশ ঘটে, তার অধিকাংশই পূরণ হয়নি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। বরং, পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে বিকাশ ঘটেছে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থনীতির’। আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থনীতির সাথে যুক্ত হয় সাবেক সামন্তরা, সাবেক জমিদারেরা, বিপুল জমির মালিকানার সাথে সাথে তারা স্থানীয় ক্ষমতার প্রবাহকেও নিয়ন্ত্রণ করে। আবার, আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থনীতির সাথে যুক্ত হয় সহিংসতার চর্চা করা রাজনীতিবিদেরাও, প্রথাগতভাবে এই অর্থনীতির সাথে যুক্ত থাকে অবৈধ পণ্যের ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরাও।
ক্ষমতার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য এরা স্বাভাবিকভাবেই সংঘাত তৈরিতে দক্ষ লোকদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে। আবার, স্থানীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকে ‘জকি’ও খুঁজে। কিশোরদের সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রগুলোকে তাই রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে আন্ডারগ্রাউন্ড অর্থনীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা, পৃষ্ঠপোষকতা করে অর্থনৈতিকভাবেও।
পৃষ্ঠপোষকরা কিশোর অপরাধী চক্রগুলোতে সাধারণত ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত, কিছু কিছু অঞ্চলে পরিচিত ‘গডফাদার’ হিসেবেও। পৃষ্ঠপোষকের হয়ে কিশোর অপরাধী চক্রগুলো বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করে, অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে, বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সহিংসতার ঘটনা ঘটায়। কিশোর অপরাধীরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় মাদক আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে- মাদক কেনা বা বিক্রি, গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদিতে।
অনেক সময় হত্যার মতো অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায় কিশোর অপরাধী চক্রগুলো, পৃষ্ঠপোষকের স্বার্থকে বাস্তবায়ন করতে, স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করতে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাতে কিশোর অপরাধী চক্রগুলোর মাধ্যমে অপহরণ হওয়া ব্যক্তিদের আঁটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। বিনিময়ে, পৃষ্ঠপোষক কিশোর অপরাধীদের আইনি সুরক্ষা দেয়, কোনো অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হলে সাধারণত অফিসিয়ালদের ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। কিশোর অপরাধীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষাও দেয় পৃষ্ঠপোষকেরা। পৃষ্ঠপোষকদের সহযোগিতা ছাড়া, কিশোর অপরাধী চক্রগুলোর অস্তিত্বের লাভ-খরচের হিসাব নেতিবাচক হতো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।