প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে গণতান্ত্রিক দেশুগুলোতে নাগরিকরা তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের ব্যাপারে সচেতন হচ্ছেন। সরকারের কাছে থাকা একজন নাগরিকের তথ্য বা ডাটা কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তা ব্যবহারে নাগরিকের অনুমতি নেওয়া হচ্ছে কিনা তাও জানতে চাইছেন অনেকেই। কারণ শক্তিশালী কম্পিউটিং যন্ত্রের সুবাদে এই বিশাল তথ্য উপাত্ত সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা সহজ এখন। এখান থেকে একটি জনগোষ্ঠী থেকে ব্যক্তির প্রতিটি কাজকর্মের উপর ভিত্তি করে তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিচয় বের করা ফেলা যায়, এবং তাদের উপর আলাদা করে প্রভাব ফেলা যায়। নাগরিক সুযোগ সুবিধাকে গতিশীল করার জন্য জনগণের স্বাস্থ্যসেবার রেকর্ড, অর্থনৈতিক লেনদেন, যাতায়াতের রেকর্ডসহ একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্যের একটি বড় অংশ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকে। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই তথ্য ব্যবহার করে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে তাহলে কী অবস্থার তৈরি হতে পারে?
কারণ এ ধরনের তথ্য ব্যবহার করে একটি পক্ষ চাইলেই নির্বাচন-গণভোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ফলাফল বদলে দিতে পারে। এর ভিত্তিতেই রাজনীতিতে ক্যামব্রিজ এনালাইটিকার মতো পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের উত্থান হয়েছে, যেখানে তারা মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি কোথায় কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে তা বের করে ফেলতে সক্ষম। ফলে এই তথ্যের ভিত্তিতে ভোটারদেরকে প্রভাবিত করা হয়ে উঠেছে সহজ। নির্বাচন গণভোটে বারবার এমন ঘটতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের প্রতিযোগিতা রাজনীতির মাঠ থেকে সরে জনগণকে প্রতিনিয়ত নজরদারি এবং তাদের তথ্য হস্তগত করার দিকে সরে যাবে।
নাগরিক সুবিধার জন্য তাদের তথ্য রাষ্ট্রের হাতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেটি কীভাবে ব্যবহার হবে তার ব্যাপারে ইউরোপের দেশে এস্তোনিয়া একটি উদাহরণ হতে পারে। এখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নাগরিকদের বিভিন্ন তথ্য আছে, কিন্তু কোনো একক প্রতিষ্ঠানের সব তথ্য ব্যবহারের অধিকার নেই। এক সংস্থা যদি আরেক সংস্থার কাছে থাকা তথ্য ব্যবহার করতে চায় তখন নাগরিকের সম্মতি নেওয়া জরুরী। এতে কোনো একক প্রতিষ্ঠান জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমানায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ইউরোপের অনেক দেশেই ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে এই ব্যবস্থা। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের নাগরিকদের তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘General Data Protection Regulation (GDPR)’ নামে একটি নীতিমালাও করেছে। যেখানে ব্যক্তিগত তথ্য যদি সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে সেক্ষেত্রে তথ্যের মালিকের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারটিকে জোর দেওয়া হয়েছে।
ল্যাটিন আমেরিকার বৃহত্তম গণতন্ত্র ব্রাজিল। দীর্ঘদিন ধরে নাগরিকদের তথ্যের সুরক্ষার ব্যাপারে ব্রাজিল ছিল অন্য দেশের কাছে উদাহরণ। ইন্টারনেট ব্যবহারের তথ্য কিংবা সরকারের কাছে থাকা তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১৯৯৫ সালেই ব্রাজিলে ‘ইন্টারনেট স্টিয়ারিং কমিটি’ করা হয়। যেখানে নাগরিকদেরকে তাদের তথ্যের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। নাগরিকদের তথ্যের অপব্যবহার রোধে অনেকটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য সুরক্ষা নীতিমালার অনুরূপ ‘LGPD’ আইন পাশ হয় ব্রাজিলের আইনসভায়।
তবে ব্রাজিলের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জায়ার বলসোনারো দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উল্টোপথে, তথ্য প্রযুক্তি এবং নাগরিক তথ্যের ক্ষেত্রগুলোতে ব্রাজিলকে করে তুলছেন কর্তৃত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ আসার আগেই ব্রাজিলে জায়ার বলসোনারোর নির্দেশে তার প্রশাসন নাগরিকদের বিপুল তথ্য সংরক্ষণ এবং নজরদারী ব্যবস্থার নির্মাণে নেমেছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে, বলসোনারোর জারিকৃত এক ডিক্রি অনুযায়ী, ফেডারেল সংস্থাগুলোকে তাদের হাতে থাকা নাগরিক তথ্য সরকারের হাতে দিতে হবে।
‘Cadastro Base do Cidadão (Citizen’s Basic Register)’ নামের এই তথ্যভান্ডারে নাগরিকদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রেকর্ড থেকে শুরু করে বায়োমেট্রিক তথ্য সবই অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। একটি বিশাল কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার বা ‘মাস্টার ডাটাবেজ’ এর এই প্রকল্পে জনগণ তাদের তথ্য দিতে সম্মত কিনা সেই ব্যাপারে কোনো আলোচনাও হয়নি।
অনেক গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, নাগরিকদের তথ্য কেন্দ্রীভূত করার এই বিশাল পদক্ষেপ প্রযুক্তিভিত্তিক কর্তৃত্ববাদ বা ‘techno-authoritarianism’, এর দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। এবং করোনার কারণে এ বিষয়টি আরো গতিশীল হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ধরনের সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার জনগণের সেবাপ্রাপ্তিকে সহজ করবে। প্রায় ১২ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে সরকারি সুবিধায় জটিলতা কমাতে, ভোট জালিয়াতি কমাতে এই কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার সহায়ক হবে বলেই জানানো হচ্ছে সরকারি সূত্র থেকে। তবে অনেক সমালোচক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জায়ার বলসোনারোর নেতৃত্বে থাকা ডানপন্থী সরকার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে এই বিশাল পরিমাণ তথ্যকে ব্যবহার করতে পারে। কারণ তথ্য সংগ্রহের ব্যাপ্তি আর বিশালতার যে পরিকল্পনা সরকার হাতে নিয়েছে সেটি ব্রাজিলকে করে তুলতে পারে ‘নজরদারীমূলক রাষ্ট্র’ বা ‘surveillance state’।
সত্তরের দশকের ব্রাজিলে সামরিক একনায়কের অধীনে একই ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে, যেখানে একটি বিশাল সিস্টেমে জনগণের সব তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। এবং এর মাধ্যমে প্রতিটি মানুষকে চাইলে নজরদারী করা সম্ভব। সামরিক সরকারের সেই প্রস্তাবের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয় সামরিক প্রশাসনের মাঝেই এবং সরকারি কর্মকর্তারাও এর বিরোধিতা করে। নজরদারীর আওতায় একবার চলে আসলে যদি কেউ সামরিক সরকারের অনুগত না থাকে, তাহলে শাস্তি পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তাই সরকার তখন সেই প্রস্তাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
ব্রাজিলের বর্তমান রাষ্ট্রপতি জায়ার বলসোনারো রাজনীতিতে আসার আগে কাজ করেছেন সেনাবাহিনীতে। চোখে পড়ার মতো ব্যাপারটি হলো, তার নির্বাচনী দৌড়ে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছেন সাবেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা। তার নীতি নির্ধারণী পর্যায়েও আছেন বেশ কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা। ব্রাজিলের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বর্ধমান খরচ, মুদ্রাস্ফীতির সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সময় নিয়েছে বেশি। তাই বলসোনারো প্রকাশ্যেই স্বৈরতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের সাফাই গেয়েছেন। এমনকি নব্বইয়ের দশকে ব্রাজিলের আইনসভায় দাঁড়িয়েও তিনি সামরিক শাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাই বলসোনারোর অধীনে দেশ আবার আধুনিক নজরদারীমূলক রাষ্ট্র হয়ে উঠবে কিনা এই আশঙ্কা করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাওয়া একটি তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, ব্রাজিলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘ABIN’ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব একটি সংস্থা ‘Serpro’ কে তাদের হাতে থাকা তথ্য দিতে বলা হয়েছে। ‘Serpro’ নামের এই প্রতিষ্ঠানটি বিশাল জাতীয় তথ্যের ভাণ্ডার, সাড়ে সাত কোটির অধিক ব্রাজিলিয়ান জনগোষ্ঠীর ড্রাইভিং লাইসেন্সের তথ্য এখানে সংরক্ষিত আছে। নাম, ঠিকানা, গাড়ির নাম্বার এবং লাইসেন্সধারীর ছবির মতো সংবেদনশীল তথ্যের ভাণ্ডারে গোয়েন্দারা প্রবেশ করতে পারছেন প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর জারিকৃত ডিক্রির ক্ষমতাবলে।
ব্রাজিলের অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এমন কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ তৈরি করাও বেশ ঝুঁকির ব্যাপার। ২০১৬ সালে সাও পাওলো শহরে ডাটাবেজটি অনিচ্ছাকৃতভাবেই উন্মুক্ত হয়ে যায়, যেখানে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষাধিক মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সামনে চলে আসে। তাই এমন ডাটাবেজ তৈরির আগে প্রযুক্তিগত সুরক্ষা নিয়েও চিন্তা করতে হবে, জনগণের মতামত যাচাই করতে হবে।
২০১৪ ফুটবল বিশ্বকাপ এবং ২০১৬ সালের অলিম্পিকের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যাপকভাবে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ব্রাজিলের পুলিশ এবং গোয়েন্দা বিভাগে সেই সিসিটিভি ফুটেজ এবং ফেসিয়াল ‘রিকগনিশন টেকনোলজি’র ব্যবহার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যে এই টেকনোলজি ব্যবহার করে ১৫১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। প্যারাগুয়ের সাথে ব্রাজিলের সীমান্তে মাদক চোরাচালানের রুট পর্যবেক্ষণ করতেও ব্রাজিলিয়ান কর্তৃপক্ষ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
ব্রাজিলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফেসিয়াল রিকগনিকশন বেশ গতি এনেছে। ফেসিয়াল রিকগনিশনের সাথে এই ডাটাবেজকে কাজে লাগিয়ে ব্রাজিলে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের একটি নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ব্রাজিলের মানবাধিকার সংস্থা এবং গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, এই ফেসিয়াল রিকগনিশন টেকনোলজি শ্বেতাঙ্গ মানুষকে শনাক্ত করতে ভালো হলেও কৃষ্ণাঙ্গ বা বাদামী চেহারার মানুষের ক্ষেত্রে অনেকাংশে ব্যর্থ। বাণিজ্যিকভাবে যে ফেসিয়াল রিকগনিশন টেকনোলজিগুলো ব্যবহারের জন্য বাজারে সেগুলোকে এমআইটি এবং স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যাচাই করে দেখেছনে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত ভুল ফলাফল আসছে। তাই ব্রাজিলের এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার নিয়ে শঙ্কিত অনেক মানবাধিকার সংগঠন।
তবে আশার ব্যাপার হলো, ব্রাজিলে তথ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করার মতো বেশ কয়েকটি সংগঠন আছে। ব্রাজিলের আইনী ব্যবস্থায় জনগণ সমন্বিতভাবে যদি মনে করে সরকারের কোনো প্রস্তাব তাদের জন্য ক্ষতিকর তবে তারা আইনি লড়াইয়ে যেতে পারে। জুন মাসে বলসোনারো প্রশাসন কোভিড-১৯ এর প্রতিদিনের পরিসংখ্যান দেওয়া বন্ধ করে দিলে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে তা আবার চালু করতে বাধ্য হয়।
তবে ব্রাজিলের দেশিয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষকদের ধারণা, বলসোনারো প্রশাসনিকভাবে অন্য সরকারের চেয়ে আলাদা। এই সরকারের ভেতর থেকে বাইরে জড়িয়ে আছে সামরিক বাহিনী। ব্রাজিলের প্রগতিশীল আর উদারপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, আমলাতন্ত্র এবং সাধারণ জনগণের তাদের প্রতি অবিশ্বাস থেকেই উগ্র-ডানপন্থী নেতা বলসোনারোর উত্থান। তার মন্ত্রীসভা এবং উপদেষ্টা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আছেন সাবেক এবং বর্তমান সেনা কর্মকর্তা, ব্রাজিলের সেনা শাসনের পতনের পর এত বেশি সংখ্যক সেনা সদস্য মন্ত্রীসভায় আর কখনোই দেখা যায়নি। নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় এদের প্রভাবের কারণে এদেরকে গনমাধ্যমে কেউ কেউ ‘রাষ্ট্রপতি ভবনের জেনারেল’ (Presidential Palace Generals) বলে থাকেন।
তাই বিরোধী মত দমনে সামরিক শাসনের সময়কার মতোই যদি আইনের রদবদল করে ‘মাস্টার ডাটাবেজ’কে নজরদারীতে ব্যবহার করা হয় তবে ব্রাজিলের সামনে আবারো অপেক্ষা করছে নতুন অন্ধকার সময়, যেখানে জনগণের লড়াই করতে হবে প্রযুক্তির দানবের সাথে।