অবশেষে ২০১৮ সালের অন্তিম প্রাদেশিক নির্বাচনগুলির ফলাফল প্রকাশিত হলো ১১ ডিসেম্বর। এবং বিগত কয়েক বছরের বেশিরভাগ নির্বাচনের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হলো এই নির্বাচনের ফল। গত নভেম্বর মাসে শুরু হয়েছিল উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মোট পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। এদের মধ্যে তিনটি বড় রাজ্য- রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতায় ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। অপর দুটি রাজ্য তেলাঙ্গানা এবং মিজোরামে ক্ষমতাসীন ছিল যথাক্রমে তেলাঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বা টিআরএস এবং কংগ্রেস। তেলাঙ্গানায় টিআরএস বড় জয় পেলেও মিজোরামে কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হয়।
কিন্তু এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চমক হিন্দি বলয়ের তিনটি রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে বিজেপির পরাজয় এবং কংগ্রেসের পুনরুত্থান। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে বিজেপি সেই ২০০৩ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় ছিল এবং আশা করেছিল যে এবারও তাদের দুই জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান (মধ্যপ্রদেশ) এবং রামন সিং (ছত্তিসগঢ়) জিতবেন।
‘সেমিফাইনালে’ বিজেপির এই হারে উল্লসিত বিরোধীরা
২০১৯-এর লোকসভা বা জাতীয় নির্বাচন খুব দূরে নয়। আর কয়েক মাসের মধ্যেই তার দামামা বেজে যাবে। আর ঠিক সেই বড় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে শাসকদলের এই ধাক্কা যে মোদীকে ভাবাবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম বড় মোদী-বিরোধী মুখ, সোজাসুজি বলেই দিয়েছেন যে, সেমিফাইনালের এই হার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ফাইনালে কী হতে চলেছে।
উনিশের জাতীয় নির্বাচনে কী হবে, সেটা এখনই বলা দুস্কর। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে কখন কী হবে, তা আগাম বলা বোকামি। আর তাছাড়া, রাজ্য নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের ইস্যু এক নয়। রাজ্য নির্বাচনে স্থানীয় নেতৃত্ব, ইস্যু ইত্যাদি নিয়ে লড়াই হয়, জাতীয় প্রেক্ষাপটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষিত অন্য। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে মোদীর বিকল্প নেতা পাওয়া গেছে বলে খুব বেশি দাবি উঠবে না, তার ঘোর সমালোচকদের মধ্যে থেকেও নয়- এই পাঁচটি রাজ্যের ফলের পরেও। কিন্তু এই নির্বাচনগুলো এই বার্তাই দিল যে, মোদী সরাসরি না হারলেও তিনি হাসতে হাসতে জিতে যাবেন, সেটা বলাও কঠিন। বিজেপির আসন সংখ্যা যদি হু-হু করে কমে যায় উনিশের নির্বাচনে, তাহলে সঙ্গী-সাথী খুঁজে বের করে সরকার তৈরি করা মোদীর পক্ষে সহজ কাজ হবে না, যেহেতু বিভাজনের রাজনীতি করার অভিযোগ তার দলের বিরুদ্ধে যথেষ্ট বেশি। সেদিক থেকে জোট তৈরি করার সম্ভাবনা কংগ্রেসের অনেক ভালো, কারণ নানা ব্যর্থতার মধ্যেও তার মধ্যপন্থী ভাবমূর্তিটি এখনও রাজনৈতিকভাবে ফায়দাজনক।
এই নির্বাচন ফলাফলে বিরোধী খুশি হবে এই কারণেও যে, তারা একের পর এক নির্বাচনে কংগ্রেসের হারে যারপরনাই হতাশ হয়ে পড়ছিল। কংগ্রেসের ভালো ফল করা বিভিন্ন মোদী-বিরোধী আঞ্চলিক শক্তিগুলির কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এরা যে যার রাজ্যে শক্তিশালী হলেও জাতীয় স্তরে প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে এদের সবারই সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং যেহেতু কংগ্রেসই একমাত্র জাতীয় দল বিজেপি ছাড়া, তাই রাহুল গান্ধীর সঙ্গ এদের মোদী হঠাও মিশনের সাফল্যের জন্যে নিতান্তই প্রয়োজনীয়। বর্তমান সময়ের দুর্বল কংগ্রেসের পক্ষে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভবপর না হলেও ‘কর্ণাটক মডেল’-এর আদলে একটি আঞ্চলিক দলকে সামনে রেখে ‘ভোট ট্রান্সফার’ করার কৌশল বিজেপিকে বেশ দেওয়ার পক্ষে খুব খারাপ নয়। আর সেটাই বিরোধীরা চাইবে দেশজুড়ে বলবৎ করে মোদী-বিরোধী ভোটকে একাট্টা করতে।
কৌশলের পাশাপাশি রয়েছে ইস্যুর প্রশ্নও
তবে এ তো গেল নির্বাচনী কৌশলের কথা। এই নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ করতে গেলে অবশ্যই প্রয়োজন ইস্যু নিয়ে কথা বলাও। বলা হচ্ছে, যে বড় কারণে বিজেপি হিন্দি বলয়ে তিনটি রাজ্যই হাতছাড়া করল তা হলো কৃষি সঙ্কট। মোদী সরকার গত কয়েক বছরে নানা প্রকল্প চালু করলেও দেশের কৃষকদের কষ্ট লাঘবে তা সম্পূর্ণ ব্যর্থই থেকেছে। গতবছর মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন কৃষকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। যেহেতু রাজসান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ় কৃষিপ্রধান রাজ্য এবং সাম্প্রতিক অতীতে এই রাজ্যগুলোর স্থান কৃষি সূচিতে নিচের দিকে নেমেছে, তাই শাসকদলের প্রতি যে দ্বেষ জন্মাবে তা আর অস্বাভাবিক কি?
এছাড়াও রয়েছে আদিবাসীদের ক্ষোভ, অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, হিন্দুত্ব নিয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠদের উপর নিপীড়ন। এই সমস্ত কারণের বিভিন্ন মাত্রার প্রভাব এই নির্বাচনের ফলাফলে পড়েছিল এবং শিবরাজ, রামন এবং রাজস্থানের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজ্যে নিঃসন্দেহে এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়াকে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
উল্টোদিকে, কংগ্রেসকেও বাহবা দিতে হয় যেভাবে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেস তাদের পুরো স্থানীয় নেতৃত্বকে নকশাল হানায় হারায়। কিন্তু তার পাঁচ বছরের মধ্যে ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতায় ফিরে কংগ্রেস দেখিয়ে দিল যে তারা ফুরিয়ে যায়নি। অন্যদিকে, বিজেপি তাদের অনেক পুরোনো প্রার্থী বদল করেও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চ্যালেঞ্জকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। কংগ্রেসের এই নির্বাচনে আরও একটি বড় জয় এই যে, বিজেপির বড় মুখগুলোর বিরুদ্ধে সেভাবে কোনো পাল্টা মুখ হাজির না করাতে পেরে, উপরন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দলের আশঙ্কা নিয়েও বড় তিনটি রাজ্যে জিৎ হাসিল করতে সক্ষম হলো। এই নির্বাচনে কংগ্রেস যদি ফের হারত, তাহলে ২০১৯ এর নির্বাচন মোটামুটি নিয়মরক্ষার খেলা হয়ে দাঁড়াত; রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে ফের আরেকবার বালিশে মুখ গুঁজতে হতো কংগ্রেসকে। কিন্তু সেটা আর হলো না, আর তা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সুখবর। কারণ ভারসাম্য হারালে গণতন্ত্রের অস্তিত্বই বিপাকে পড়ে যায়। তবে কংগ্রেসের দায়িত্ব এই নির্বাচনে জিতেই শেষ হয়ে যায় না। এই তিন রাজ্যের রাজ্যের সাধারণ ভোটার বিজেপিকে বর্জন করে কংগ্রেসের কাছে জানতে চাইবে তাদের কাছে কী বিকল্প রয়েছে, আর সেই বিকল্প রাহুল গান্ধীর দলকে প্রস্তুত করতে হবে অতি শিগগিরই।
কী হতে পারে ২০১৯ এ?
আগেই বলেছি রাজনীতিতে আগাম বলা ঝুঁকির কাজ। তবে এই নির্বাচনগুলোর ফল দেখে দুটি সম্ভাব্য ফলের কথা বলা যেতে পারে আগামী লোকসভা নির্বাচনে। এক, বিজেপির বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা এক ধাক্কায় অনেকটা নেমে এল যার ফলে মোদীর কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিল জোট নির্মাণ। মোদী যেহেতু প্রথম থেকেই একজন বিভাজনকারী নেতা হিসেবে অভিযুক্ত, তাই বিজেপি পিছলে পড়লে কতজন নেতা তার পাশে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল, আর সেক্ষেত্রে বৃহত্তম দল হয়েও ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার দুর্ভাগ্য ফের বিজেপির সঙ্গ দিতে পারে (যেমন কর্ণাটকে হয়েছে এই বছরেই)। আর দুই, বিজেপির সোজাসুজি পরাজয়। এই পরিণতিটি কতটা সত্য হতে পারে তা সময়ই বলবে কিন্তু রাজনীতিতে অসম্ভব কিছুই নেই।