২০১৩ সালের জানুয়ারির দিকে চীন সরকার ঘোষণা দিল, তাদের ১২তম পঞ্চবর্ষী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা তিব্বতের ইয়ারলাং সাংপো নদীর বুকে আরও তিনটি বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে। চীনের এই ঘোষণার পরপরই নড়েচড়ে বসে বিশ্ববাসী। সবার প্রথম প্রশ্ন ছিল, “আর কয়টি বাঁধ নির্মাণ করবে চীন?” আর প্রশ্ন উঠবেই না কেন, কারণ গত দশক পর্যন্ত গণচীন প্রায় ৮৭ হাজারের মতো বাঁধ নির্মাণ করেছে। এসকল বাঁধের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে প্রায় ৩৫২.২৬ গিগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হচ্ছে নিয়মিত। এত বিদ্যুৎ দিয়ে ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মতো বড় বড় তিনটি দেশের বিদ্যুতের চাহিদা অনায়াসে পূরণ করা যাবে। গত চার দশকে চীনের জলবিদ্যুৎ সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০ গুণ। তারপরেও চীনের বাঁধপ্রীতি যেন থামছে না। আভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণ শেষে তারা হাত বাড়িয়েছে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর দিকে। ইয়ারলাং সাংপো তেমনই একটি আন্তর্জাতিক নদী।
নতুন তিন বাঁধ নির্মাণের ঘোষণায় জোর প্রতিবাদ জানায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। তারা নতুন বাঁধ নির্মাণ না করার জন্য চীনকে অনুরোধ করে। মনে হতে পারে, চীন তাদের নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করবে, এখানে ভারতের কী? আপাতদৃষ্টিতে এটি ভারতের ব্যাপার না মনে হলেও বিষয়টি সহজ নয়। কারণ, চীনের বুকে যা ‘ইয়ারলাং সাংপো’, ভারতের বুকে তা-ই ব্রহ্মপুত্র। তাই বাঁধের সিদ্ধান্ত শুধু চীনের একার নেওয়ার এখতিয়ার আছে, তা মানতে নারাজ ভারত। এ বিরোধ যেন বহু বছর ধরে চীনের নদীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রচেষ্টার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
চীনের বাঁধপ্রীতি
চীনের বিগত ১২তম এবং ১৩তম পঞ্চবর্ষী পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল চীন অধ্যুষিত তিব্বত অঞ্চলের নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করা। বিগত কয়েক দশকে দেশটির বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি বিভাগের ‘জলবিদ্যুৎ’ প্রীতি যেন নদী নিয়ন্ত্রণের এ যজ্ঞ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। ১৩তম পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে চীন তাদের জলবিদ্যুৎ ক্ষমতা তিন গুণ বৃদ্ধি করে ৩০০ গিগাওয়াটে উত্তীর্ণ করবে। এ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে নির্মাণ করতে হবে বেশ কয়েকটি নতুন বাঁধ। তিব্বত অঞ্চলে বিদ্যমান তামা, স্বর্ণ এবং রৌপ্য খনিগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সহজ করার লক্ষ্যে এ অঞ্চলগুলোতে বাঁধ নির্মাণ করছে চীন।
তাছাড়া, কয়েক দশক পূর্বে তিব্বতে শুরু হওয়া বনায়ন কর্মসূচির কারণে সেখানে কৃষিকাজ এবং নানা শিল্প গড়ে উঠেছে, যার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানি দরকার। চীনের নাগরিকদের মধ্যে শহরে বসবাস করার প্রবণতাও বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৫৮ শতাংশ নাগরিক শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। নগরগুলোতে পানির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। কাগজে-কলমে এটি প্রধান উদ্দেশ্য হলেও এর পেছনে আরও অনেক কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এবং সুপেয় পানিবাহী নদীর কারণে তিব্বত চীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এশিয়ার আন্তর্জাতিক নদীগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটির উৎপত্তিস্থল তিব্বত অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে। এজন্য তিব্বতকে ‘এশিয়ার জল মিনার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিব্বত থেকে উৎপত্তি হওয়া নদীগুলো এশিয়ার ১০টির বেশি দেশে প্রবাহিত হচ্ছে। এদের মধ্যে চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং পাকিস্তান রয়েছে। জনসংখ্যার হিসাবে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবনধারণের জন্য তিব্বতি নদীগুলোর উপর নির্ভরশীল, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেক।
তাই তিব্বতি নদীগুলোর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পুরো অঞ্চলের উপর শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে পারবে চীন। কয়েক দশক ধরে তিব্বত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে আছে গণচীন। চীনের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় তিব্বতের নদীগুলো থেকে মাত্র ০.৬ শতাংশ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা থেকেই নদীগুলোর উপর একের পর এক বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে চীন।
ইতোমধ্যে ২৮টির বেশি প্রস্তাবনা সরকারের নিকট জমা দিয়েছেন দেশটির বিজ্ঞানীরা। ইয়াংৎসি, ইয়েলো, ইয়ারলাং সাংপো, সিন্ধু, মেকং, সালউইনসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক নদীর বুকে বাঁধ এই প্রস্তাবনাগুলোর অন্তর্ক্তভু রয়েছে।
যাহা ইয়ারলাং সাংপো, তাহাই ব্রহ্মপুত্র
তিব্বতের পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত কৈলাস শৃঙ্গ থেকে জন্ম নিয়েছে এক মহানদী, যার নাম ইয়ারলাং সাংপো। এই নদীকে সংক্ষেপে ‘সাংপো’ নামেও ডাকা হয়। উৎপত্তিস্থল থেকে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পথ তিব্বতের পাহাড়ি বুকে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর তিব্বতের পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে এই নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে পশ্চিমমুখী হয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতের বুকে প্রবেশ করে। ইয়ারলাং সাংপো নদীর এই গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ার স্থানকে ভূতাত্ত্বিকরা ‘গ্রেট বেন্ড অভ দ্য সাংপো’ বা সাংপো নদীর মহাবাঁক হিসেবে নামকরণ করেছেন।
ভারতের বুকে এ নদীর নাম অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হতে থাকে। দিহাং, লোহিত, লৌহিত্য এবং ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত হয় এই নদীর ধারা। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্রহ্মপুত্র হিসেবেই সুপরিচিত হয় এটি। যাত্রাপথে এর দিক বদলে দক্ষিণমুখী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সেদেশে এর একটি ধারা ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ’ হিসেবে প্রবাহিত হয়েছে। আরেকটি ধারা ‘যমুনা’ হিসেবে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে পদ্মার বুকে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
তিব্বতে নদীর নেওয়া মহাবাঁক অঞ্চলে নদীটি প্রায় ৪,৯০০ মিটার উচ্চতায় নামচে বারওয়া এবং গেয়ালা পেলরি নামক দু’টি তুষারচূড়ার মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তারপর এ নদী আরও ২৪০ কিলোমিটার দূরে প্রায় ২,৭০০ মিটার নিচে প্রবাহিত হয়েছে, যা ‘ইয়ারলাং সাংপো গিরিখাত’ নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাত, যা যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে দ্বিগুণ গভীর।
বেশ দুর্গম এই অঞ্চল বহু বছর ধরে অভিযাত্রিকদের অধরা ছিল। ১৯৯৮ সালে ইয়ান বেকার এবং কেন স্টর্ম নামক দুই অভিযাত্রিক এই গিরিখাত অঞ্চলে ৩০ মিটার উঁচু একটি জলপ্রপাত আবিষ্কার করেন, যা হিমালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড়। দুর্গম হলেও এ ধরনের ভৌগোলিক গঠনের কারণে চীনা প্রকৌশলীরা এই গিরিখাতকে দেখছেন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বেশ সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে।
১৯৯৬ সালের এক খসড়া নকশা অনুযায়ী, এখানে এক অতিকায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ৩৮ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে, যা হবে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঁধের (থ্রি গর্জেস বাঁধ, চীন) সক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। আর তাই ইয়ারলাং সাংপোর বুকে বাঁধ নির্মাণ করতে পারা হবে চীনের অন্যতম সফলতার প্রতীক।
ব্রহ্মপুত্রের বুকে বাঁধ
একদা এশিয়ার বুকে অবিরাম বয়ে চলতো ইয়ারলাং সাংপো বা ব্রহ্মপুত্র নদী। নদীর এই মুক্ত প্রবাহে লাগাম বেঁধে দিয়েছে চীন। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্রের বুকে ১১টি বাঁধ নির্মাণ করেছে তারা। চীনা ভূতাত্ত্বিক ইয়াং ইয়ুং-এর ভাষায় যা ‘তিব্বতি নদীতে জলবিদ্যুৎ যুগের সূচনা’। প্রাথমিকভাবে নদীর বুকে বাঁধ নির্মাণের কোনো বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি চীন। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ব্রহ্মপুত্রে ৫টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা স্বীকার করে তারা। সবগুলো বাঁধ তিব্বতের লাসার পূর্বাঞ্চলে নির্মিত করা হবে বলে জানানো হয়।
২০১৪ সালে ব্রহ্মপুত্রের বুকে নির্মিত বৃহত্তম বাঁধ জাংমুর যাত্রা শুরু হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,২৬০ মিটার উচ্চতায় নির্মিত জাংমু বাঁধ প্রায় ৫৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। বাঁধের উচ্চতা প্রায় ১১৬ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৩৯০ মিটার। ব্রহ্মপুত্রের বুকে নির্মিত অন্যান্য বাঁধগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে- গিয়াতসা, ঝোংদা, জিয়েক্সো, লাংঝেন ইত্যাদি। গিয়াতসার সক্ষমতা ৩৬০ মেগাওয়াট এবং জিয়েক্সোর সক্ষমতা ৫১০ মেগাওয়াট।
২০১৩ সালে চীন নতুন আরও ৩টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ব্যক্ত করে যা বহুদিন ধরেই বিশেষজ্ঞদের অনুমিত ছিল। নতুন ৩টি বাঁধের নাম যথাক্রমে দাগু (৬৬০ মেগাওয়াট), আরেকটি জিয়েক্সো (৫৬০ মেগাওয়াট) এবং জিয়াচা বাঁধ (৩২০ মেগাওয়াট)। এদের মধ্যে দাগু ও জিয়েক্সো নির্মিত হবে জাংমুর উজানে এবং জিয়াচা নির্মিত হবে ভাটিতে।
ব্রহ্মপুত্রের বুকে বাঁধ নির্মাণের জন্য ইতোমধ্যে হুয়ানেং, হুয়াদিয়ান, গুদিয়ান এবং দাতান- এই চার শক্তি উৎপাদন প্রতিষ্ঠান তিব্বতের অভ্যন্তরে তাদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন চীনা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নতুন নির্মিত বাঁধগুলো চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধ থেকে ৩ গুণ বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারবে। চীনের এই সিদ্ধান্তের কারণে ব্রহ্মপুত্রের ভাটিতে থাকা বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে চীন সরকার বারবার এই দুই দেশকে আশ্বাস দিয়েছে যে, বাঁধ নির্মাণের কারণে কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু এই আশ্বাস মিথ্যে বলে দাবি করেছে ভারত। সম্প্রতি সাংপো নদীর ধারায় ৭১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ু বাঁধ এবং মহাবাঁকের সন্নিকটে ইয়োং নামক এক উপনদীতে ঝোংগিয়ু বাঁধ (৮০০ মেগাওয়াট) নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়েছে চীন। বাঁধের অবস্থান এবং প্রভাব বিশ্লেষণের পর দেখা যায়, এর ফলে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হবে চীন।
আর্থ-সামাজিক প্রভাব
চীনের ব্রহ্মপুত্র বাঁধযজ্ঞ পুরোদমে চলছে এবং থামার কোনো লক্ষণ আপাতত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আমরা ভারত এবং বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বড় রকমের বিরূপ প্রভাব দেখতে পাবো। ভারতের আসাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এই নদী। এসব অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন উপায়ে জীবিকার জন্য এই নদীর উপর নির্ভরশীল। বাঁধ নির্মাণের ফলে তাদের জীবিকা অর্জন চরমভাবে ব্যাহত হবে। গবাদি পশু পালন, কৃষিকাজ, মৎস্যশিল্প, কলকারখানা, নৌপরিবহন ব্যবস্থাসহ নদীনির্ভর শিল্পগুলো মুখ থুবরে পড়বে। অরুণাচল এবং আসামের বাসিন্দারা এ নদীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অরুণাচলের আদিবাসীরা ব্রহ্মপুত্রকে ‘মাতা’ হিসেবে সম্মান করবে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাকে অরুণাচলের ‘অন্নপাত্র’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। আসামের ২২ জেলার প্রায় ৬০ শতাংশ নাগরিক এই নদীর মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে। তাই মুক্ত প্রবাহিত নদী ছাড়া এই অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাপন করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম ধারা যা ‘যমুনা’ হিসেবে বাংলাদেশে প্রবাহিত হচ্ছে, তা দেশটির অন্যতম প্রধান নদী। এই নদীর নাব্যতা এবং বিশালতাকে কাজে লাগিয়ে এখানেও গড়ে উঠেছে বড় বড় শিল্প। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এই নদীর প্রবাহের গুরুত্ব দুই-এক বাক্যে লিখে বুঝানো অসম্ভব। তাছাড়া নদীর অন্য ধারা ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ’ এখন হুমকির মুখে। বাঁধের পানি নিয়ন্ত্রণের ফলে এই বিশাল অঞ্চলের লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে।
প্রতিবছর ব্রহ্মপুত্রের বন্যায় ভারতের আসাম রাজ্যে প্রতিবছর ২৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনিয়ন্ত্রিত এই বন্যা পরিস্থিতিকে আরও ভয়ংকর করে তুলবে চীনের বাঁধগুলো। পরবর্তীতে এই পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জেলা নিমজ্জিত করে ফেলবে। বাংলাদেশে বন্যার কারণে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ গৃহ ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েক কোটি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিঃস্ব হয়। চীনা বাঁধের ফলে অসময়ের বন্যায় এই ক্ষতির অংক কয়েকগুণ বেড়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে।
মানুষ ছাড়াও ব্রহ্মপুত্রের মায়ায় নিজের আবাস খুঁজে নিয়েছে প্রায় ৭,২৩৩ প্রজাতির প্রাণী। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিপন্ন প্রাণীও রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় এসব প্রাণী। ব্রহ্মপুত্র মরে গেলে এসব প্রাণীও আর বাঁচতে পারবে না।
রাজনৈতিক হাতিয়ার
ব্রহ্মপুত্রের বুকে বাঁধ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার আর্থ-সামাজিক দৃশ্যপটেই পরিবর্তন আনবে না, বরং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও এর প্রভাব বিস্তৃত থাকবে। বিশেষ করে, চীনের ভেতর আন্তর্জাতিক নদীগুলোর উৎপত্তিস্থল থাকায় সেগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আনার মাধ্যমে পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চল নিজেদের কব্জায় আনতে পারবে চীন। সেক্ষেত্রে এই বাঁধগুলো হবে চীনের সবচেয়ে ধারালো হাতিয়ার।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে চীনের রাজনৈতিক সুবিধার বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, যা চীনের নিকট দক্ষিণ তিব্বত হিসেবে পরিচিত, তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিবাদ চলমান রয়েছে বহু বছর ধরে। প্রায় ৯০ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখের মতো। ব্রহ্মপুত্রের বুকে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এই অঞ্চলের বিতর্কে ভারতকে চাপে ফেলে দিতে পারবে চীন। ভারতকে হয় চীনের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে বাঁধ নির্মাণে বাঁধা দিতে হবে নয়তো বাঁধ নির্মাণের কারণে পরবর্তীতে পানি বন্ধ করে দিলে অরুণাচলসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়াও হবে ভারতের জন্য একটি ব্যয়বহুল উদ্যোগ।
চীন ইতোমধ্যে পানিকে হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করেছে ভারতের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি গালওয়ান অঞ্চলে চীন ও ভারতের মধ্যে ঘটা সংঘর্ষের সময় চীন সরকার গালওয়ান নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। যার ফলে নদীর পানি শুকিয়ে স্রেফ কাদামাটি অবশিষ্ট ছিল। এই ঘটনায় লাদাখ অঞ্চলের বহু নদীনির্ভর শিল্প চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ২০১৭ সালে সিকিম সীমান্তে দোকলাম অঞ্চলে চীন-ভারত সংঘর্ষের ৭৩ দিনের মাথায় ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ সম্পর্কিত সকল তথ্য প্রদান বন্ধ করে দেয় চীন। এর ফলে ২০১৮ সালে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়, চীন সরকার প্রতি বন্যা মৌসুমে ১৫ মে থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করবে ভারতকে।
এভাবে বাঁধের সাহায্যে চীন ভাটিতে থাকা দেশগুলোকে যেকোনো পরিস্থিতিতে বৈঠকে বসার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া যেকোনো ইস্যুতে নদীর তথ্য প্রদান করতে অপারগতা প্রকাশের মাধ্যমে চীন পরিস্থিতি জটিল করে দিচ্ছে।
ভারতের পাল্টা বাঁধ নির্মাণ
আন্তর্জাতিক নদীর উপর কোনো রাষ্ট্রের একক কর্তৃত্ব নেই- এমন দাবি তুলে ইন্দোচীন অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো ১৯৯৫ সালে চীনকে মেকং নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করতে নিষেধ করে। তবে চীন তাদের প্রতিবাদ তোয়াক্কা না করে নদীগুলোর উপর একাধিক বাঁদ নির্মাণ করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এমনকি প্রাথমিকভাবে তাদের দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করলেও চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করে চীন। এর ফলে লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় চীন।
১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর নৌপরিবহন ব্যতীত অন্যান্য উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ। তবে পানিপ্রবাহ সম্মেলনে এই আইনের বিপক্ষে ভোট দেয় চীন। এসব ঘটনা থেকে আন্তর্জাতিক নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্রহ্মপুত্রের বুকে নতুন বাঁধ নির্মাণের ঘোষণার পর এবার জোর প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত। এর আগে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা হয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণের পূর্বে ভারতের সাথে আলোচনায় বসবে চীন। কিন্তু কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই সমঝোতা না হওয়ায় আইনগতভাবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। চীন এই আইনি ফাঁকির সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়ে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। লয়ি ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে চীনের এই নীতি নিয়ে লেখা আছে,
“তিব্বতের পানির উপর একক কর্তৃত্ব দাবি করছে চীন। দেশটি ৭টি আন্তর্জাতিক নদীর উজানের পানি নিয়ন্ত্রণ করছে। নদীগুলো হচ্ছে- গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, ইরাবতি, সালউইন, ইয়াংৎসি এবং মেকং। এই নদীগুলো বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, লাওস, পাকিস্তান এবং ভিয়েতনাম দিয়ে প্রভাহিত হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থেকে নদী প্রবাহের এটি বৃহত্তম উদাহরণ। এদের মধ্যে প্রায় ৪৮% পানি ভারতের বুকে প্রবাহিত হচ্ছে।”
সঙ্গত কারণেই চীনের বাঁধ নির্মাণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে ভারত এবং বাংলাদেশ। ভারত ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাল্টা ১০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বাঁধ নির্মাণের হুমকি দিয়েছে। তবে বাঁধ-পাল্টা বাঁধ যুদ্ধ ঠিক কতটুকু সমস্যা সমাধান করতে পারবে তা কারও বোধগম্য নয়। ভারত পাল্টা বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সাময়িক অব্যাহতি লাভ করলেও এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নাজুক। তাই বিকল্প সমাধান না বের করলে অচিরেই এই অঞ্চলে পানি নিয়ে প্রকট সমস্যা দেখা দেবে, যার উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব রাখবে চীন।