গতানুগতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে সাধারণত শহুরে আফগান নারীদের অধিকার নিয়েই বেশি আলোচনা করা হয়। আড়ালে রয়ে যায় গ্রামীণ আফগান নারীদের চাওয়া-পাওয়ার কথা। অথচ এরাই মূলত আফগানিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল নারী। কারণ আফগানিস্তানের ৭০% মানুষই গ্রামে বসবাস করে। সেই নারীদের কথাই নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের একটি দীর্ঘপাঠ প্রবন্ধে তুলে এনেছেন সাংবাদিক আনন্দ গোপাল।
সেই সাথে প্রবন্ধটিতে উঠে এসেছে আমেরিকান বাহিনীর এবং তাদের সহযোগী আফগান ন্যাশনাল আর্মির সীমাহীন অমানবিকতার কথা, আফগান জনগণের উপর চালানো তাদের গণহত্যার কথা এবং তালেবানদের বিজয়ের পেছনের কারণগুলোর কথা।
আমাদের এই সিরিজটি দীর্ঘ এই চমৎকার প্রবন্ধটিরই অনুবাদ। মোট সাতটি পর্বে করা অনুবাদ সিরিজটির এটি প্রথম পর্ব। সবগুলো পর্বের লিঙ্ক এখানে: ১ম পর্ব | ২য় পর্ব | ৩য় পর্ব | ৪র্থ পর্ব | ৫ম পর্ব | ৬ষ্ঠ পর্ব | ৭ম পর্ব
গত আগস্টের এক বিকেল বেলা শাকিরা শুনতে পায়, তাদের বাড়ির প্রধান ফটকে কারা যেন আঘাত করছে। দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমন্দ প্রদেশের সাংগিন উপত্যকার এই এলাকায় মহিলাদের অনাত্মীয় পুরুষদের সাথে দেখা করার নিয়ম নেই। কাজেই শাকিরার উনিশ বছর বয়সী ছেলে আহমেদ গিয়ে দরজা খোলে। বাইরে কার্তুজের বেল্ট আর কালো পাগড়ি পরা দুজন লোক রাইফেল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা ছিল তালেবান সদস্য, যারা আফগান ন্যাশনাল আর্মির কাছ থেকে আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করার জন্য আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের একজন আহমেদকে সতর্ক করে দিয়ে বলে, “এই মুহূর্তে যদি তোমরা এলাকা না ছাড়, তাহলে সবাই মারা পড়বে।”
চল্লিশোর্ধ্ব শাকিরা তার স্বামী এবং আট সন্তানের পরিবারকে একত্রে জড়ো করে। তার স্বামী একজন আফিম ব্যবসায়ী, যে নিজের পণ্যের নেশায় নিজেই মত্ত হয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত ছিল। তার আট সন্তানের মধ্যে সবার বড় নিলুফার, যার বয়স যুদ্ধের বয়সের প্রায় সমান- বিশ বছর। ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনার ব্যাপারে মাকে সাহায্য করে বলে শাকিরা তাকে “ডেপুটি” বলে সম্বোধন করে। পরিবারটি একটি খালের উপর অবস্থিত একটি পুরাতন সংকীর্ণ সেতু অতিক্রম করে। এরপর নলখাগড়া আর এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া শিম গাছ এবং পেঁয়াজ ক্ষেতের মধ্য দিয়ে অন্ধকার এবং পরিত্যক্ত বাসাবাড়ি পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের প্রতিবেশীদেরকেও তালেবানরা সতর্ক করে দিয়েছিল। এবং এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো মুরগি আর মালিকানাহীন হয়ে পড়া গরু ছাড়া গ্রামটি পুরোপুরি জনশূন্য হয়ে পড়েছিল।
জ্বলন্ত সূর্যের উত্তাপের মধ্য দিয়ে শাকিরার পরিবার কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত হেঁটে চলে। এরপর তারা দূর থেকে আসা ভারি কিছুর পতনের আওয়াজ অনুভব করতে শুরু করে। শাকিরা দেখতে পায়, নদীর তীরের গ্রামগুলো থেকে মানুষ স্রোতের মতো বেরিয়ে আসছে: যেসব জিনিস ফেলে আসা সম্ভব না, সেগুলোর বোঝার ভারে পুরুষরা নিচের দিকে নুইয়ে পড়ছে, আর মহিলারা তাদের বোরকা তাদেরকে যতটুকু অনুমোদন দিচ্ছে, ততটুকু দ্রুত হাঁটছে।
আফগান সেনাবাহিনীর একটি ফাঁড়িতে তালেবানের আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া কামানের গোলার শব্দে বাতাস ভারি হয়ে আসে, আকাশ গর্জে এবং ঝলসে ওঠে। শাকিরা তার দুই বছর বয়সী কনিষ্ঠ সন্তানকে নিতম্বের উপর রেখে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। রাতের দিকে তারা উপত্যকার কেন্দ্রীয় বাজারে এসে উপস্থিত হয়। দোকানগুলোর ঢেউখেলানো লোহার দরজাগুলোর অধিকাংশই যুদ্ধের সময় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শাকিরা অক্ষত ছাদ বিশিষ্ট এক কক্ষের একটি দোকান খুঁজে বের করে এবং সেদিন রাতের জন্য তার পরিবারকে নিয়ে সেখানেই বসতি স্থাপন করে। বাচ্চাদের জন্য শাকিরা এক সেট কাপড়ের পুতুল তৈরি করে রেখেছিল। এটি ছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর বছরগুলোতে তার তৈরি করা চিত্তবিক্ষেপের অনেকগুলো উপকরণের মধ্যে একটি। ম্যাচের আলোয় শাকিরা যখন পুুতুলগুলোকে তুলে ধরে, তখনই গোলার আঘাতে তাদের পৃথিবী কেঁপে ওঠে।
ভোরের দিকে বাইরে বেরিয়ে এসে শাকিরা দেখতে পায়, কয়েক ডজন পরিবার পরিত্যক্ত বাজারের এখানে-সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। একসময় এটি ছিল উত্তরাঞ্চলীয় হেলমন্দের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বাজার। এখানে দোকানদারদেরকে দাঁড়িপাল্লায় জাফরান আর জিরা ওজন করতে দেখা যেত, গাড়ি বোঝাই করে মহিলাদের গাউন বিক্রি হতো, আর নির্দিষ্ট কিছু দোকান ব্যবহৃত হতো শুধুই আফিম বিক্রি করার কাজে। এখন সেখানে বিচ্ছিন্ন স্তম্ভগুলো দাঁড়িয়ে আছে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে, আর বাতাসে ভেসে আসছে মৃত পশুর এবং পোড়া প্লাস্টিকের পচা গন্ধ।
দূর থেকে হঠাৎ দুনিয়াজুড়ে বিস্ফোরণের আওয়াজ আসে। মাটির টুকরো ফোয়ারার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আফগান সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো মাথার উপর গুঞ্জন করতে থাকে। তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করে পরিবারগুলো দোকানগুলোর পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। উত্তরে পাথরের প্রাচীর বরাবর এবং পশ্চিমে নদীর তীর ধরে যুদ্ধ চলছিল। পূর্বদিকে শাকিরা যতদূর দেখতে পাচ্ছিল, ততদূর পর্যন্ত ছিল শুধু লাল বালির মরুভূমি। একমাত্র বিকল্প ছিল দক্ষিণ দিকের সবুজ পল্লবিত শহর লস্করগাহের দিকে যাত্রা করা, যা তখনও আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
এই যাত্রায় তাদেরকে একটি বিরান সমতল ভূমি পাড়ি দিতে হবে, পরিত্যক্ত মার্কিন ও ব্রিটিশ ঘাঁটি অতিক্রম করতে হবে, যেসব ঘাঁটিতে বর্তমানে স্নাইপাররা আস্তানা গেড়েছে। সেই সাথে তাদেরকে এমন সব কালভার্ট পাড়ি দিতে হবে, যেগুলো সম্ভাব্য বিস্ফোরক দিয়ে বোঝাই করা। অল্প কয়েকটি পরিবার যাত্রা শুরু করে, কিন্তু লস্করগাহে পৌঁছতে পারলেও সেখানে তারা কী পাবে, সে ব্যাপারে তারা কেউ নিশ্চিত না।
তালেবানদের অভিযান শুরুর পর থেকেই আফগান সৈন্যরা দলে দলে আত্ম সমর্পণ করছিল, তাদেরকে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে দেওয়ার জন্য ভিক্ষা করছিল। এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, তালেবানরা শীঘ্রই কাবুলে পৌঁছে যাবে। সেই সাথে এটাও বোঝা যাচ্ছিল, তাদেরকে পরাজিত করার জন্য যে ট্রিলিয়ন ডলার এবং বিশ বছর উৎসর্গ করা হয়েছিল, তার কিছুই শেষপর্যন্ত কাজে আসেনি।
শাকিরার পরিবার মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিল। গোলাগুলির শব্দ আরও কাছ থেকে শোনা যাচ্ছিল। শাকিরা তালিবানদের গাড়িগুলোকে বাজারের দিকে ছুটে যেতে দেখল। সে সিদ্ধান্ত নিলো, সে এখানেই থাকবে। তার শরীরের হাড়গুলো পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তার স্নায়ু ভেঙে পড়েছিল। সে ঠিক করল, সামনে যা কিছু আসুক, সে সেটারই মুখোমুখি হবে, সেটাকেই সে তার বিধান হিসেবে মেনে নেবে। “আমরা আমাদের সারা জীবন পালিয়ে বেড়িয়েছি,” সে আমাকে বলেছিল। “আর কোথাও যাচ্ছি না আমি।”
আমেরিকার ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ হয় গত ১৫ আগস্ট, যখন তালেবান একটিও গুলি না চালিয়ে রাজধানী কাবুল দখল করে নেয়। কালো পাগড়ি এবং দাড়িতে শোভিত শীর্ণকায় পুরুষরা রাষ্ট্রপতি ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং রাজধানীর চারপাশে আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরাতের অনাড়ম্বর সাদা পতাকা উত্তোলন করে। তাদের বিজয় অনেকের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে। কিছু মহিলা তাদের স্কুলের রেকর্ড পুড়িয়ে ফেলে এবং আত্মগোপনে চলে যায়। তারা নব্বইয়ের দশকের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করছিল, যখন তালেবানরা নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ করেছিল এবং মেয়েদের একা একা বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
আমেরিকানদের জন্য ব্যাপারটি ছিল আরও কঠিন। তাদের বিগত দুই দশকের সমস্ত অর্জন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার যে বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা তাদের সামনে একটি অসম্ভব কঠিন সিদ্ধান্ত বাছাই করার পরিস্থিতি হাজির করেছিল: পুনরায় আপাতদৃষ্টিতে অন্তহীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, অথবা আফগান নারীদেরকে পরিত্যাগ কর।
আফগান নারীরা নিজেরা এই উদীয়মান দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কী ভাবছে, সেটা শোনার জন্য এই গ্রীষ্মে আমি আফগানিস্তানের গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলাম। আমি এমন মহিলাদের সাথে দেখা করেছিলাম, যারা ইতোমধ্যেই তালেবানদের অধীনে বসবাস করছিল। সত্তর শতাংশেরও বেশি আফগান নাগরিক গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। এবং গত এক দশকে তালেবান এই গ্রামগুলোর বিশাল অংশ গ্রাস করে নিয়েছিল।
তুলনামূলকভাবে উদার কাবুলের বিপরীতে এই অন্তর্ভূমিতে নারীদের সাথে দেখা করা বেশ কঠিন: তালেবানদের শাসন ছাড়াও ঐতিহ্যগতভাবেই এখানে নারীরা অনাত্মীয় পুরুষদের সাথে কথা বলে না। ব্যক্তিগত এবং জনজীবন এখানে তীব্রভাবে বিভক্ত। কোনো মহিলা যখন ঘর থেকে বের হয়, তখন সে বোরকার মাধ্যমে নিজেকে নির্জনতায় আবদ্ধ করে রাখে। তালেবানদের উত্থানের শত শত বছর আগে থেকেই এখানে এই ব্যবস্থা চলে আসছে।
মূলত বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই মেয়েরা তাদের বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যায়। এরপর যদি কখনও বেরিয়ে আসে, সেটা কেবল দাদী হবার পর। এই বৃদ্ধ দাদীদের মাধ্যমেই, একজনের সুপারিশে আরেকজনকে খুঁজে বের করে এবং অনেকের মুখ না দেখেই আমি বিভিন্ন বয়সের কয়েক ডজন মহিলার সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছিলাম। তাদের অনেকেই শাকিরার মতো মরুভূমির তাঁবুতে বা খালি দোকানের ভেতর বাস করছিল। তালেবানরা যখন হেলমন্দের বাজারে লুকিয়ে থাকা এই পরিবারগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল, তখন তাদের যোদ্ধারা মাইন পরিষ্কার না করা পর্যন্ত তাদেরকে বাড়ি ফিরে যেতে নিষেধ করেছিল। এই হেলমন্দের একটি সেফ হাউজেই শাকিরার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। “আমি এর আগে কখনও কোনো বিদেশী দেখিনি,” লাজুকভাবে বলেছিল শাকিরা। “আসলে, বন্দুক ছাড়া কোনো বিদেশী দেখিনি।”
দুঃখের মধ্যেও হাস্যরস খুঁজে পাওয়ার একধরনের দক্ষতা শাকিরার আছে। সেই সাথে আছে তার জীবনে পুরুষদের নিছক অযৌক্তিক ভূমিকার মাঝেও হাস্যরস খুঁজে পাওয়ার দক্ষতা। নব্বইয়ের দশকে তালেবানরা গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় ধূসর দাড়িওয়ালা বৃদ্ধরা কালো জাদুর ভয়ে প্রথমে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। “আমরা মহিলারা অবশ্য জানতাম বিদ্যুতে কোনো সমস্যা নেই,” শাকিরা হাসতে হাসতে বলেছিল। হাসার সময় সে তার গায়ের শালটি মুখের উপর টেনে নিয়ে কেবল চোখদুটো উন্মুক্ত রাখছিল। আমি যখন তাকে জানালাম, তার নামে বিশ্ব বিখ্যাত একজন পপ তারকা আছে, তখন তার চোখে দ্যুতি খেলে গেল। “আসলেই?” সে তার সাথে সেফ হাউজে থাকা এক বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করল। “এমনও কি হয়?”
আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া অন্যান্য মহিলাদের মতো শাকিরাও সাংগিন উপত্যকায় বেড়ে উঠেছিল। তীক্ষ্ণ পর্বতশ্রেণির উদগত স্তরের মাঝখানে অবস্থিত একটুকরো গভীর সবুজ খাদ এটি। হেলমন্দ নদী এবং পঞ্চাশের দশকে আমেরিকানদের দ্বারা নির্মিত একটি খাল এতে পানি সরবরাহ করে। কয়েক ডজন ছোট ছোট গ্রাম, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করা পায়ে চলা একটি সেতু এবং কাদামাটির দেয়াল অতিক্রম করে উপত্যকাটির প্রস্থ বরাবর পাড়ি দিতে মাত্র এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে।
ছোটবেলায় শাকিরা তার মায়ের মুখে পুরনো দিনের গল্প শুনেছিল। তাদের গ্রামের নাম ছিল পান কিল্লায়। সেখানে প্রায় আশিটির মতো পরিবারের বসবাস ছিল। শিশুরা সেখানে উষ্ণ রোদে খালের পানিতে সাঁতার কাটত, আর মহিলারা পাথরের হামানদিস্তায় শস্য মাড়াই করত। শীতকালে মাটির চুলা থেকে ধোঁয়া বের হতো, আর বসন্তকালে জমিগুলো পপি গাছে ছেয়ে যেত।
১৯৭৯ সালে শাকিরা যখন শিশু, তখন কমিউনিস্টরা কাবুলে ক্ষমতা দখল করে। হেলমন্দ প্রদেশ — যেটি আয়তনে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কাছাকাছি, কিন্তু যেখানে মেয়েদের স্কুলের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল — সেখানে কমিউনিস্টরা একটি নারী-স্বাক্ষরতা কর্মসূচি চালু করার চেষ্টা করে। গোত্রীয় প্রবীণ নেতারা এবং জমিদাররা তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। গ্রামবাসীদের বর্ণনানুযায়ী, উপত্যকায় নারী অধিকার আনার জন্য বহিরাগতদের জোরাজুরির প্রেক্ষিতেই সাংগিনের ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা রাতারাতি ভেঙে পড়ে। “আমাদের সংস্কৃতি মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে স্কুলে পাঠানোর অনুমতি দেয় না,” শাকিরা মন্তব্য করেছিল। “আমার বাবা-দাদাদের আমলের আগে থেকেই এরকম চলে আসছে।”
কর্তৃপক্ষ যখন মেয়েদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তাদেরকে ক্লাসে যেতে বাধ্য করে, তখন গ্রামে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয় নিজেদেরকে মুজাহেদিন বলে পরিচয় দেওয়া একদল সশস্ত্র লোক। তাদের প্রথম অপারেশনে তারা উপত্যকার সকল স্কুল শিক্ষককে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং জবাই করে হত্যা করে। পরদিন মুজাহেদিনদেরকে অর্থায়ন করার সন্দেহে সরকার গোত্রীয় প্রবীণ নেতাদেরকে এবং জমিদারদেরকে গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনার পর থেকে এই নেতাদেরকে আর কখনও দেখা যায়নি।
কমিউনিস্ট সরকারকে সাহায্য করার জন্য এবং নারীদেরকে মুক্ত করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ট্যাঙ্কের বহর সীমান্ত অতিক্রম করে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। শীঘ্রই আফগানিস্তান কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে, যেখানে যুবকরা মেয়েদের স্কুল এবং ভূমি সংস্কারসহ নতুন পদ্ধতির জীবনযাত্রা আরোপ করার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে ইচ্ছুক ছিল, সেখানে মেয়েরা অদৃশ্যই থেকে যায়। অন্যদিকে শহরে সোভিয়েত-সমর্থিত সরকার বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করে এবং মেয়েদেরকে তাদের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার প্রদান করে। সেখানে মেয়েরা রেকর্ড সংখ্যায় স্কুলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, এবং আশির দশকের শুরুর দিকে মহিলারা সংসদীয় আসনে, এমনকি উপ-রাষ্ট্রপতি পদেও নিজেদের স্থান করে নেয়।
গ্রামের দিকে সহিংসতার বিস্তার অব্যাহত থাকে। শাকিরার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন একদিন খুব ভোরে তার এক আন্টি তাকে তাড়াহুড়া করে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। গ্রামের বয়স্করা বাচ্চাদেরকে একটি পাহাড়ের গুহায় নিয়ে যায়। সেখানে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জড়াজড়ি করে বসে থাকে। রাতের বেলা শাকিরা আকাশে কামানের গোলার ঝলকানি দেখতে পায়।
শাকিরার পরিবার যখন পান কিল্লায়ে ফিরে আসে, ততক্ষণে গ্রামের গম ক্ষেতগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, সোভিয়েত ট্যাঙ্ক সেগুলোর উপর দিয়ে নিজেদের পদচিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে, এবং মেশিনগান দিয়ে তাদের গরুগুলোকে ধরাশায়ী করা ফেলা হয়েছে। শাকিরা যেদিকেই তাকাচ্ছিল, সেদিকেই সে প্রতিবেশী পুরুষদেরকে — যাদেরকে সে “চাচা” বলে সম্বোধন করত — রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখছিল। শাকিরার দাদা তাদের সাথে গুহার ভেতরে ছিল না। এবং শাকিরাদের পরিবার ফিরে আসার পর তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বড় হওয়ার পর শাকিরা জানতে পেরেছিল, তার দাদা ভিন্ন একটি গুহায় গিয়ে লুকিয়েছিল; সোভিয়েতরা সেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং পরে হত্যা করে।
রাতের বেলা ঘর ছাড়া নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠতে থাকে। শাকিরার জন্য এটি ছিল উত্তেজনার উৎস: গুহার অন্ধকার কোণ, কোলাহলপূর্ণ শিশুদের দল। “আমরা রাশিয়ান হেলিকপ্টারের খোঁজে আকাশের দিকে তাকাতাম,” শাকিরা বলেছিল আমাকে। “এটি ছিল অচেনা পাখি খুঁজে পাওয়ার মতো।” মাঝে মাঝে সেই পাখিগুলো নিচে নেমে এসে ছোঁ মারত, এবং এর পরপরই পৃথিবী বিস্ফোরিত হয়ে উঠত। বাচ্চারা ঘটনাস্থলে ছুটে যেত লোহার টুকরো সংগ্রহ করার জন্য, যা ভালো দামে বিক্রি করা যেত। শাকিরা নিজেও মাঝে মাঝে পুতুলের ঘর বানানোর জন্য ধাতব টুকরো সংগ্রহ করত। একবার সে তার মাকে একটি ম্যাগাজিনে পাওয়া প্লাস্টিকের পুতুলের ছবি দেখিয়েছিল, যেখানে নারীর শরীরের অবয়ব দেখা যাচ্ছিল। তার মা তার হাত থেকে সেটি ছিনিয়ে নিয়েছিল, কারণ তার মতে সেটি ছিল অনুপযুক্ত। পরে শাকিরা কাপড় আর লাঠি দিয়ে পুতুল তৈরি করা শিখে নিয়েছিল।
শাকিরার বয়স যখন এগারো বছর, তখন সে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তার দুনিয়া তার বাড়ির তিনটি কক্ষ এবং উঠোনের মধ্যে সংকুচিত হয়ে পড়ে। সেখানেই সে সেলাই শেখত, তন্দুরে রুটি বানাত এবং গরুর দুধ দোহন করত। একদিন জেট প্লেনের আওয়াজে তাদের বাড়ি যখন থরথর করে কেঁপে ওঠে, তখন সে একটি আলমারির ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে কাপড়ের স্তূপের নিচে সে বাচ্চাদের একটি বর্ণমালার বই আবিষ্কার করে। বইটি ছিল তার দাদার, যে তাদের পরিবারে স্কুলে যাওয়া সর্বশেষ ব্যক্তি। দুপুরবেলা তার বাবা-মা যখন ঘুমিয়ে থাকত, তখন শাকিরা একটু একটু করে পশতু শব্দগুলোর সাথে ছবি মেলানোর চেষ্টা করত। সে স্মৃতিচারণ করে, “আমার পরিকল্পনা ছিল প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেকে পড়তে শেখানো।”
১৯৮৯ সালে সোভিয়েতরা পরাজিত হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু তারপরেও শাকিরা তাদের বাড়ির মাটির দেয়ালের বাইরে মর্টারের আওয়াজ শুনতে থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বী মুজাহেদিন গ্রুপগুলো তখন নিজেদের মধ্যে দেশ ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। পান কিল্লায়ের মতো গ্রামগুলো ছিল তাদের জন্য লাভজনক লক্ষ্যবস্তু: সেখানে কর আদায় করার মতো কৃষক ছিল, ব্যবহার করার মতো মরচে পড়া সোভিয়েত ট্যাঙ্ক ছিল এবং রপ্তানি করার মতো আফিম ছিল। “আমরা একটা রাতও শান্তিতে কাটাতে পারতাম না,” পাশের গ্রামের পাজারো নামের এক মহিলা স্মৃতিচারণ করে। “আমাদের আতঙ্কের একটা নাম ছিল। এবং এটা ছিল ‘আমির দাদো’।”
পরবর্তী পর্বে থাকছে কীভাবে আমির দাদো শাকিরাদের জীবনে ত্রাস হয়ে এসেছিল, এবং কীভাবে তালেবান এসে সাংগিনবাসীকে সেই ত্রাস থেকে উদ্ধার করে। পড়তে ক্লিক করুন এখানে।