২০১৫ সালে চীনে কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা উ জিং এর হাত ধরে ‘উলফ ওয়ারিয়র’ (Wolf Warrior) নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। মুক্তির পর পরই পুরো চীনজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এই মুভিটি, বক্স অফিসে তোলপাড় তুলে ৯০ মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে। এর ব্যবসায়িক সফলতায় অনুপ্রাণিত হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা উ জিং এর সিক্যুয়েল নির্মাণে হাত দেন।
দুই বছর পর ২০১৭ সালে আগের চলচ্চিত্রের সিক্যুয়েল হিসেবে ‘উলফ ওয়ারিয়র ২’ মুক্তি পায়। এটিও আগের মতো ব্যবসাসফল, শুধু আগের চেয়েই নয়, বরং চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা হওয়ার খ্যাতি লাভ করে। বক্স অফিস তোলপাড় করে দিয়ে ৮৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করে ‘উলফ ওয়ারিয়র ২’, যেখানে এর বাজেট ছিল ২০০ মিলিয়ন ডলার।
উলফ ওয়ারিয়র ও এর সিক্যুয়েল উলফ ওয়ারিয়র ২– দুটোই চীনা জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষাপটে বানানো চলচ্চিত্র। দুটো চলচ্চিত্রের গল্প বানানো হয়েছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (People’s Liberation Army) বা পিএলএ-র মাধ্যমে চীনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে থাকা শত্রুদের পতন ঘটিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডার সুনিপুণ মিশ্রণে তৈরি হওয়া এই ঘরানার চলচ্চিত্রগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। দর্শকদের উদ্দেশ্য করে দুটো চলচ্চিত্রেই যে বার্তা দেয়া হয়েছে তা হলো– তুমি ভেতরের কোনো নাগরিক কিংবা বাইরের কোনো ব্যক্তিই হও না কেন, চীনের ক্ষতি করলে কিছুতেই তোমাকে শাস্তি ছাড়া যেতে দেয়া হবে না।
যে বিষয়ের জন্য জাতীয়তাবাদী চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ আনা হলো, তা শুরু করা যাক। চীনের বর্তমান যেসব কূটনীতিক বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে দায়িত্বরত আছেন কিংবা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির যারা মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন, তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর, বেশি আক্রমণাত্মক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেক বেশি সক্রিয়। চীনের প্রতি যেকোনো তীর্যক মন্তব্যের বিপরীতে তারা পাল্টা আক্রমণ হিসেবে তীর্যক মন্তব্য ছুড়ছেন, কোনো ছাড় দিচ্ছেন না। তারা যেন ‘উলফ ওয়ারিয়র’ চলচ্চিত্রের একেকজন ওয়ারিয়র, যারা চীনের জাতীয় মর্যাদা রক্ষায় পাল্টা আক্রমণ করতেও কখনও পিছপা হবেন না।
আক্রমণকারীর প্রতি কোন নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন না করে তারাও পাল্টা আক্রমণ করতে প্রস্তুত। চীনের এই ছেড়ে কথা না বলার, পাল্টা জবাব দেয়ার কূটনীতিকেই ‘উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসি’ বলা হচ্ছে।
ঐতিহাসিকভাবে চীনের কূটনীতির যে চরিত্র, তা থেকে ‘উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসি’র চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। চীন এতদিন ধরে অন্য দেশের সাথে কূটনৈতিক সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিল, প্রতিপক্ষ কিংবা প্রতিবেশী দেশগুলোকে সমীহ করে আলোচনার টেবিলে আসতো। চীনের বিরুদ্ধে মতাদর্শিক কারণে আগে থেকেই পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর দ্বন্দ্ব ছিল, আগে থেকেই চীনের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা চালানো হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে যেখানে পরিবর্তন এসেছে তা হলো– চীন আগে তার প্রতি তীর্যক ও আক্রমণাত্মক মন্তব্যগুলোতে যে নমনীয়তা প্রদর্শন করতো, এখন ঠিক তার উল্টোটা করে।
সাবেক চীনা প্রেসিডেন্ট দেং শিয়াওপিং একবার মন্তব্য করেছিলেন, “শত্রুকে কখনও নিজের সামর্থ্য দেখিও না, সময়ের অপেক্ষায় থাকো ও পর্যবেক্ষণ করো।” নিজেদের কূটনীতিতে এতেদিন এই বাক্যেরই বাস্তবায়ন ঘটিয়ে আসছিল চীনারা। কিন্তু বর্তমানে সম্ভবত প্রেসিডেন্ট দেং শিয়াওপিংয়ের বলা সেই সময় চলে এসেছে, চীনও তার কূটনীতিতে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিচ্ছে।
করোনাভাইরাসের আক্রমণ যখম শুরু হলো, তখন পশ্চিমা মিডিয়া ও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রতি বর্ণবাদী মন্তব্য করতে অকাতরে সময় ব্যয় করেছেন। করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’, ‘উহান ফ্লু’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর প্রত্যুত্তরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অবতারণা ঘটিয়েছেন, আমেরিকাকে ভাইরাসের পেছনে দায়ী করেছেন। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যহত করতে ও বিশ্বে চীনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য আমেরিকার সেনাবাহিনী নিজেদের ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাস তৈরি করেছে ও উহানে এসে তা অবমুক্ত করেছে এরকম উদ্ভট কথা বললেও পাল্টা আক্রমণ হিসেবে তা যথেষ্টই বলা চলে।
হংকংয়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন চলছে গত বছরের শেষ থেকে। চীন বরাবরই এর পেছনে মার্কিনীদের দায়ী করে এসেছে, বৈদেশিক ষড়যন্ত্র হিসেবে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে মূল্যায়ন করেছে। মে মাসের শেষের দিকে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট যখন হংকংয়ের আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করলো, তখন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের আরেকজন মুখপাত্র টুইটারে “I can’t breathe.” বলে টুইট করেন। এর অর্থ হলো চীনারা বলতে চাইছে, আমাদের বিষয়ে নাক না গলিয়ে তোমরা তোমাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন চলছে, তাতে মন দাও।
শুধু যে আমেরিকার বিরুদ্ধেই চীন ‘উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসি’র প্রয়োগ ঘটাচ্ছে, তেমনটা ভাবলে ভুল হবে। আমেরিকা ও আমেরিকা মিত্র ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলোই কূটনীতির প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু বাকি দেশগুলোও আক্রমণাত্মক মন্তব্যের হাত থেকে রেহাই পাবে না। ভেনেজুয়েলা সরকারি কর্মকর্তারা করোনাভাইরাসকে ‘উহান ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করার পর চীনের দূতাবাস পাল্টা বার্তায় জানিয়ে দিয়েছিল ভেনেজুয়েলার কর্মকর্তাদের উচিত মাস্ক পরিধান করে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা। কানাডাতে যখন চীনা টেক জায়ান্ট হুয়াওয়ের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মেন ওয়ানঝু গ্রেফতাহ হলেন, তখন কানাডাকে ‘শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যে জর্জরিত একটি রাষ্ট্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন চীনের কূটনীতিকরা।
দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলোতে কোনো রাষ্ট্র যদি হঠাৎ করে দম্ভ দেখাতে শুরু করে কিংবা আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা আক্রমণ করার সাহস দেখায়, তাহলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে রাষ্ট্রটির অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। চীনের ক্ষেত্রে কথাটি পুরোপুরি সত্য। চীনের অর্থনীতি এখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। চীন তার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ঘটিয়ে দিন দিন উন্নত করে চলেছে। আগের প্রেসিডেন্টদের সময়ে হয়তো চীনের অর্থনীতি তেমন শক্তিশালী ছিল না, সামরিক বাহিনী সমীহ-জাগানিয়া ছিল না। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনকে অর্থনীতি ও সামরিক খাতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্বিবাদী, নমনীয় চীনা কূটনীতি থেকে উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসির দিকে যাত্রা করার পেছনে এগুলো বড় কারণ।
চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উলফ ওয়ারিয়র ডিপ্লোমেসি কাজে দিচ্ছে। চীনের জনগণকে প্রবল জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে কূটনীতিকদের ছোড়া আক্রমণাত্মক বাক্যগুলো ভালো ভূমিকা রাখছে। চীনের নিজস্ব সমস্যা থেকে জনগণের চোখ সরিয়ে রাখতেও এই কূটনীতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে ব্যাপক সাহায্য করছে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্ত অবস্থান সাধারণ মানুষের সামনে পরিষ্কার করায় পার্টির ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হচ্ছে। আর বিদেশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে চীন প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে নিজেদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামাতে নির্দেশ দিচ্ছে। এটা একটা সতর্কবার্তা হিসেবে পাঠ করা যায়। চীন তার শত্রুকে সতর্ক করছে, যেটা যেকোনো সরাসরি সংঘাত এড়ানোর জন্য জরুরি।
তবে এই কূটনীতি চীনের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ভূমিকা পালন করবে– এরকম আভাসও মিলছে। আলোচনার টেবিলে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঠোর বাক্যবাণ ছোড়ার মাধ্যমে শুধু শত্রুতাই বাড়বে।আমেরিকার মতো সবসময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা ও প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মতো দেশের বিরুদ্ধে নিজেদের আত্মমর্যাদা টিকিয়ে রাখতে হয়তো চীন এই ধরনের কূটনীতি চালিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে এই কূটনীতির প্রয়োগে চীনকে নিঃসন্দেহেই ভাবতে হবে।