২ অক্টোবর, ২০১৮; তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে নিজের বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত কাগজপত্র আনতে যান সাংবাদিক জামাল খাশোগজি। কনস্যুলেটের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন খাশোগজির বাগদত্তা, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ফিরে আসার জন্য। তার অপেক্ষা ফুরোয়নি, সৌদি কনস্যুলেট থেকে আর জীবিত ফিরে আসেননি জামাল খাসোগজি।
জামাল খাসোগজি দীর্ঘ সময় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ পরামর্শক হিসেবেও। স্বনামধন্য সাংবাদিক হিসেবে তিনি আফগানিস্তানে রাশিয়ার আক্রমণের খবর কাভার করেছেন, কাভার করেছেন আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনের উত্থানপর্বও। সৌদি রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে খাশোগজি কাজ করেছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফের অধীনে, আমেরিকা-ঘনিষ্ঠ যে প্রিন্স বিশেষজ্ঞ ছিলেন কাউন্টার টেরোরিজমের উপরে। মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থানের বলি হতে হয়েছে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে, দেশ ছাড়তে হয়েছিলো নায়েফের ঘনিষ্ঠ জামাল খাশোগজিকে।
আমেরিকায় থাকা অবস্থায় জামাল খাশোগজি সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে প্রতি মাসে কলাম লিখেছেন ওয়াশিংটন পোস্টে, সমালোচনা করতেন মোহাম্মদ বিন সালমানের। ফলে তিনি যখন নিখোঁজ হন, সন্দেহের তীর গেল সৌদি রাজপরিবারের দিকেই, বিশেষ করে ডি ফেক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে। সৌদি আরব শুরু থেকে খাশোগজির নিখোঁজের দায় নিতে অস্বীকার জানালেও ১৮ দিন পর সৌদি আরব হত্যার দায় স্বীকার করে। সৌদি নিরাপত্তা সংস্থার অপারেটিভদের মাধ্যমে জামাল খাশোগজির হত্যার বিষয়টি স্বীকার করলেও মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়।
খাশোগজি ইস্যুতে বাইডেনের অবস্থান
সৌদি আরব অস্বীকার করলেও জামাল খাশোগজি ইস্যুতে মূল দায় বর্তায় মোহাম্মদ বিন সালমানের উপর, তুরস্কের হাজির করা প্রমাণগুলো এই অবস্থানের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত তৈরি করে। সিআইএ-র নিজস্ব তদন্তের প্রতিবেদনেও উঠে আসে, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশেই হয়েছে খাশোগজির হত্যাকাণ্ড।
জো বাইডেন শুরু থেকেই খাশোগজির ইস্যুটি নিয়ে সরব ছিলেন, দাবি করেছেন মোহাম্মদ বিন সালমানের বিচারও। প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে জামাল খাশোগজির হত্যার জন্য বাইডেন সরাসরি দায়ী করেন মোহাম্মদ বিন সালমানকে, প্রতিশ্রুতি দেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সৌদি আরবকে বৈশ্বিক রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার নীতি নেওয়ার ব্যাপারে। এর মাধ্যমে নির্বাচনের সময় জো বাইডেন মানবাধিকার গ্রুপগুলোর সমর্থন আদায় করেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে জো বাইডেন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন, বৈশ্বিক নেতাদের সাথে যোগাযোগের সময় সৌদি আরবের ডি-ফেক্টো লিডার মোহাম্মদ বিন সালমানের পরিবর্তে কথা হয় বাদশাহ সালমানের সাথে। মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে যোগাযোগের জন্য পাঠানো হয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল লয়েড অস্টিনকে। ট্রাম্পের আমলে হোয়াইট হাউজে অবাধ প্রবেশাধিকার পাওয়া মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তিকর, অপমানজনক। মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথম বিদেশ সফর সৌদি আরবে করার ধারাবাহিকতাও ভঙ্গ করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন, প্রেসিডেন্সির প্রথম দেড় বছর সৌদি আরব সফরে যাননি জো বাইডেন।
তবে, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বাইডেনের এই অবস্থানে ফাটল ধরায়। রাশিয়ার তেলের প্রবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় তেলের বাজারে বাড়তে থাকে দাম, একইসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মুদ্রাস্ফীতি। আমেরিকার নির্বাচনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক সূচক আর দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পূর্বাভাসগুলো। এই বছরের শেষদিকে মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে বাইডেনের সামনে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানো ব্যতীত কোনো বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানোর জন্য প্রয়োজন তেলের দরপতন, যেটি কেবল সম্ভব গালফ স্টেটগুলোর তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমেই। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর শুরু হয়।
মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক বৈধতা
সৌদি আরবে মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক উত্থান একদিকে বিশ্লেষকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে, আরেকদিকে তৈরি করেছে সীমাহীন বিতর্ক। নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া, স্টেডিয়ামে প্রবেশাধিকার দেওয়া থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনার ধারণাকে সামনে নিয়ে এসে মোহাম্মদ বিন সালমান প্রশংসা কুড়ান, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে অবাধ প্রবেশাধিকার পান হোয়াইট হাউজে।
বিপরীতে, সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটদের হোটেলে বন্দি করা থেকে শুরু করে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে ক্রাউন প্রিন্সের পদ থেকে সরানোর ঘটনায় সমালোচিত হয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তবে, মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা জামাল খাসোগজির হত্যা, যেটি তাকে বৈশ্বিক ভিলেনে পরিণত করার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও একঘরে করে দেয়।
গত দেড় বছরে মোহাম্মদ বিন সালমান তাই একরকম লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিলেন, রাজনৈতিকভাবেও ছিলেন কিছুটা নিশ্চুপ। বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে আবারও ফেরার সুযোগ পেয়েছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান, সুযোগ পেয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে নিজের মতো সাজিয়ে নেওয়ার। ফলে, বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর কি মোহাম্মদ বিন সালমানকে রাজনৈতিক বৈধতা দিয়ে গেছে?
মোহাম্মদ বিন সালমানের রাজনৈতিক অর্জন
বাইডেনের প্রেসিডেন্সিয়াল বহর যখন জেদ্দার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করছিল, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তখন প্রাসাদের বাইরে দাঁড়িয়ে বাইডেনকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলেন। বাইডেন গাড়ি থেকে নেমে নিজের ব্লেজার ঠিক করছিলেন, ক্রাউন প্রিন্স তার দিকে এগিয়ে আসায় তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে নিজের মুষ্টি এগিয়ে দেন।
গত কয়েক বছরে এই ধরনের দৃশ্য নিয়মিত দেখা গেলেও, বাইডেন আর মোহাম্মদ বিন সালমানের এই উষ্ণ অভিবাদন বিনিময়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব অন্যরকম। গত দেড় বছর ধরে স্থবিরতার পর আবারও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা শুরু হচ্ছে এই সাক্ষাতের মাধ্যমে, ফিরছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথাগত পররাষ্ট্রনীতি।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর এসেছে রাজনৈতিক বৈধতার সূত্র হিসেবে, এসেছে নিজের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার পাশাপাশি অপরিহার্যতা প্রমাণের।
প্রথমত, বাইডেনের এই সফরের মাধ্যমে জামাল খাশোগজি হত্যার বিচারের দাবিতে যে আন্দোলনটি চলছিল ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে, সেটি রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। পাশাপাশি, মোহাম্মদ বিন সালমান ইস্তাম্বুলের এই ঘটনার ব্যাপারে অবহিত ছিলেন না, সৌদি আরবের এই ন্যারেটিভ আরো শক্তিশালী অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় প্রেসিডেন্সিয়াল ধারণার পতন ঘটে, পতন ঘটে নতুন নতুন প্রেসিডেন্টদের স্ট্যাটাস কো পরিবর্তনের চেষ্টাও। মোহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরবকে একঘরে করে রাখা যে সম্ভব না, তাদেরকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি যে সাজানো সম্ভব না, বাইডেনের সফরের মাধ্যমে সৌদি আরব সেটি প্রমাণ করেছে। অর্থাৎ, প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ভুল প্রমাণ করেছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।
তৃতীয়ত, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই জো বাইডেন বলার চেষ্টা করছেন, বৈশ্বিক হিজিমন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নিজের অবস্থানে ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে মিত্রদের রক্ষার প্রতিশ্রুতির ব্যাপারেও। বৈশ্বিক মঞ্চের মতো মধ্যপ্রাচ্যেও নতুনভাবে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন বাইডেন, যার কেন্দ্রে ছিল সৌদি আরবের ব্যাপারে বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি। প্রেসিডেন্সি শুরুর দেড় বছর পর বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরে মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে উষ্ণ ফটোসেশন প্রমাণ করেছে, বৈশ্বিক মঞ্চে ফিরে আসলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মতোই দুর্বল।
নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ফিরিয়ে আনার জন্য মোহাম্মদ বিন সালমানের বাইডেনের সাথে কেবল একটি ছবিই প্রয়োজন ছিল। তিনি সেটি পেয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্য সফরে বাইডেনের রাজনৈতিক ঝুঁকি
মধ্যপ্রাচ্য সফরে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। ইসরায়েলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া, পূর্বসূরী ট্রাম্পের আব্রাহাম অ্যাকর্ডকে ছাড়িয়ে যাওয়া, পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন থেকে ইরানকে দূরে রাখার মতো বিষয়গুলো ছিলো চ্যালেঞ্জ হিসেবে। তবে, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মোহাম্মদ বিন সালমানের মুখোমুখি হওয়া, মুখোমুখি হওয়ার পরে সমালোচনাগুলো সামাল দেওয়া।
প্রথমত, জো বাইডেন নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তেল কিংবা অস্ত্র নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূলে থাকবে মানবাধিকার। মধ্যপ্রাচ্যের এই সফরের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি মুখ থুবড়ে পড়েছে, জয় হয়েছে প্রথাগত পররাষ্ট্রনীতির।
দ্বিতীয়ত, জামাল খাশোগজির হত্যার ব্যাপারে সৌদি আরব আর মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রতি যে কঠোর অবস্থানের দর্শন প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এই মধ্যপ্রাচ্য সফরে মাধ্যমে সেটির মৃত্যু ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিরামহীন সমালোচনার শিকার হচ্ছেন বাইডেন, ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদক মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের উষ্ণ অভিবাদন আদান-প্রদানকে ‘লজ্জাজনক’ ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পাশাপাশি, ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি।
তৃতীয়ত, বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার হাতে অল্পই পলিটিক্যাল কারেন্সি আছে। ইতোমধ্যেই ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে জনপ্রিয়তা হারানো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য সফরের মাধ্যমে ট্র্যাকে ফেরার স্বপ্ন দেখছিলেন। আপাতত বাইডেনের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি, বরং আরো গভীর সংকটে পড়েছে তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্সিয়াল ড্রিম।
সবমিলিয়ে, মধ্যপ্রাচ্য সফরে উচ্চ রাজনৈতিক ঝুঁকির বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাজনৈতিক বৈধতা দিয়ে গেছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে, যিনি হোয়াইট হাউজে আবার আগের মতো অবাধ যাতায়াতের সুযোগ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন।