ঐতিহাসিকভাবে ইরানের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস, রয়েছে জাতীয় ঐতিহ্য। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে ইরানে প্রতিষ্ঠিত আকেমেনিদ সাম্রাজ্য একসময় সুবিশাল আকার ধারণ করে, এখনো ইরানীদের মনে গর্বের সঞ্চার করে এই সাম্রাজ্য। বহু শৈল্পিক সংস্কৃতি ইরানীদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করেছে, ‘শাহনামার’ মতো মহাকাব্যও তাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মতো বৈচিত্র্যময় ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসও। সময়ের পরিক্রমায় উত্থান ঘটেছে বহু রাজবংশের, মিলিয়ে গেছে সময়ের সাথেই। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইরানে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র থেকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, জনগণের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়া শুরু হয় মজলিসের সদস্যরা। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে মজলিসের উপস্থিতি থাকলেও, সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল রাজার (শাহের) কাছে। ইরানি বিপ্লবের মাধ্যমে পতন ঘটে রেজা শাহ পাহলভীর, গণভোটের মাধ্যমে ইরানে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামিক রিপাবলিক। ইরানের বিপ্লবকে দেখা হচ্ছিল ইসলামিক শাসনতন্ত্র আর গণতন্ত্রের প্রথম মিশ্রণ হিসেবে।
বিপ্লবের পরে কিছুদিন ইরানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা চর্চার সুযোগ থাকলেও, দ্রুতই বিপ্লবীদের বিভাজন কট্টরপন্থীদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ করে দেয়, ইরানের শুরু হয় বিপ্লব পূর্ববর্তী রাজনৈতিক কাঠামোতে ফিরে যাওয়া। গণভোটের মাধ্যমে পাশ হওয়া সংবিধানে তৈরি হয় সুপ্রিম কমান্ডারের পদ, যেটি বিপ্লব পূর্ববর্তী শাহের পদের অনুরূপ ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রণ উপভোগ করে। ইরানের শাহরা যেভাবে সাভাকের মতো গোপন পুলিশ বাহিনীগুলোকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক নিপীড়ন চালিয়েছে, বিপ্লব পরবর্তী সরকার রেভ্যলুশনারি গার্ড তৈরি করেছে একইভাবে ভিন্নমত দমন করার জন্য। শাহের আমলে তাকে বেষ্টন করে রাখত কতিপয় অভিজাত শ্রেণির মানুষ, বর্তমান ইরানে সুপ্রিম কমান্ডারকে কেন্দ্র করে একইরকম ভূমিকায় রয়েছে গার্ডিয়ান কাউন্সিল, রয়েছে কট্টরপন্থী রক্ষণশীলেরা।
শাহের আমলে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ছিল, উপস্থিতি ছিল আইনসভার। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে যে আইনসভা তৈরি হয়েছে, তার ভূমিকাও বিপ্লবী পূর্ববর্তী আইনসভার থেকে খুব একটা বেশি না। বিপ্লব পূর্ববর্তী ইরানে যেমন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল রেজা শাহ পাহলভীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া কিছু অভিজাতের কাছে, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে সুপ্রিম কমান্ডারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া কিছু ধর্মীয় রক্ষণশীলের কাছে।
চলমান মহামারির সময়ে ইরানের রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের আরো রূঢ় প্রকাশ ঘটেছে, জরুরি অবস্থার অজুহাতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করেছে, সীমিত করেছে রাজনৈতিক অধিকার। সামগ্রিকভাবে, বিভিন্ন দিক থেকেই ক্রমাগত কঠোর কর্তৃত্ববাদী এক রাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছে ইরানের রাষ্ট্রকাঠামো।
রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণের সুযোগ
হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইরানে বহু শক্তিমান শাসকের উত্থান ঘটেছে, সেই শাসক আবার হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে, পথ করে দিয়েছে নতুন শক্তিমান শাসকের উত্থানের। রাজনৈতিক এই উত্থান-পতনের ঘটনা দক্ষিণ এশিয়াতেও ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মতো ইরানীদের কখনোই উপনিবেশ শাসনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি। ইরানের বন্ধুর ভূপ্রকৃতি আর ইরানীদের স্বাধীনচেতা জাতীয় চরিত্র এই রাজনৈতিক অর্জনে ভূমিকা রেখেছে।
তুলনামূলকভাবে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের চেয়ে ইরানের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি, বেশি রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার আগ্রহও। এজন্য একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, “পাঁচজন ইরানের নাগরিক একসাথে হলে সেখানে ছয়টি রাজনৈতিক দল তৈরি হয়।” নাগরিকদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা থাকার পরও ইরানে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা রক্ষণশীলদের আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আদর্শের রাজনৈতিক দল গঠন করা সম্ভব, আদর্শ সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেই সম্ভব রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রক্ষণশীলদের অনুগত রাজনৈতিক নেতারা রাষ্ট্রীয় সমর্থন উপভোগ করেন, উপভোগ করেন নিজের রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। বিপরীতে, ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাদের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়, রাষ্ট্রীয় নাগরিক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হন সংস্কারপন্থীরাও। বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাধারণত রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারের সুযোগ পান না, সুযোগ পান না রাজনৈতিক মত তৈরির। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে রক্ষণশীল এস্টাবলিশমেন্ট নিজেদের কার্যক্রমের রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করে, রাজনৈতিকভাবে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে উপস্থাপন করে বিরোধীদের। বেশিরভাগ ইরানির কাছে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমই তথ্যপ্রাপ্তির একমাত্র উৎস হওয়ায় এই প্রক্রিয়ার বিশাল রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এর বাইরে, বেসরকারি সংবাদমাধ্যমগুলোর উপরও নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সরকারের।
রাজনৈতিক ভিন্নমত জাতিগত পরিচয়ের জায়গা থেকে হতে পারে, বর্ণের পরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনৈতিক গ্রুপ তৈরি হতে পারে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল তৈরি হতে পারে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মনোযোগ চাইতে পারে যেকোনো গোষ্ঠী। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে এই সকল ধরনের গোষ্ঠী রাজনৈতিক কর্মকান্ডে স্বাধীনতা উপভোগ করার কথা। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইরান একটি রিপাবলিক হলেও, বিভিন্ন পরিচয়ের ভিত্তিতে সেখানে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অত্যন্ত কম। সুন্নি মুসলমানরা ধর্মীয় কাজে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটে ইরানে, মানবাধিকার কর্মীদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দমন-পীড়নের মুখোমুখি হতে হয়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সেখানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। চীনের পরই সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় ইরানে, যার অধিকাংশই কার্যকর হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবেচনায়।
রাজনৈতিক ভিন্নমতধারীদের উপর একইভাবে রাজনৈতিক নিপীড়ন চালিয়েছেন রেজা শাহ, জোরপূর্বক ভিন্নমত দমন করেছে তার অনুগত সাভাকের সদস্যরা, করেছে আগণিত রাজনৈতিক হত্যা।
ইরানের নির্বাচনী কাঠামো
ইরানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী সুপ্রিম কমান্ডার। এক্সপার্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্বাচিত সুপ্রিম কমান্ডার ক্ষমতায় থাকেন মৃত্যু পর্যন্ত। রাষ্ট্রকাঠামোর প্রায় সকল ক্ষমতা এসে কেন্দ্রীভূত হয় সুপ্রিম কমান্ডারের কাছে। সুপ্রিম কমান্ডার ইরানের সামরিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন, বিচার বিভাগের প্রধানকে নিয়োগ দেন, গার্ডিয়ান কাউন্সিলের ছয় সদস্য নিযুক্ত হন তার মাধ্যমেই। এক্সপার্ট কাউন্সিল সুপ্রিম কমান্ডারের ক্ষমতা আর কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের কথা থাকলেও, বাস্তবিকভাবে সুপ্রিম কমান্ডারের অসীম ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান ইরানে নেই, নেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুযোগ।
সুপ্রিম কমান্ডারের পর ইরানের দ্বিতীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে প্রেসিডেন্টের পদ। ইরানের প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। কিন্তু, এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সুপ্রিম কমান্ডারের হস্তক্ষেপ চলে, হস্তক্ষেপ চালায় গার্ডিয়ান কাউন্সিলও। চূড়ান্ত প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে অংশগ্রহণ করতে প্রয়োজন হয় বারো সদস্যের গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদনের। ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ১,৬০০ প্রার্থীর মধ্যে মাত্র সাতজনকে ইরানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেয় গার্ডিয়ান কাউন্সিল, ২০২১ সালেও সুযোগ দেয় মাত্র ৭ জনকে। অনেক জনপ্রিয় প্রার্থীকেই এই প্রক্রিয়াতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে ইরান।
৮৬ সদস্যের কাউন্সিল অব এক্সপার্টসের সদস্যরা নির্বাচিত হন জনগণের ভোটের মাধ্যমে, এদের মেয়াদ থাকে আট বছরের। এদের ভোটের মাধ্যমে সুপ্রিম কমান্ডার নির্বাচিত হয়, গার্ডিয়ান কাউন্সিল আর আইনসভার মধ্যে কোন ইস্যুতে মতবিরোধ তৈরি হলে তাতে মধ্যস্ততাও করে এক্সপার্টস কাউন্সিল। তবে, এখানকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেও প্রয়োজন হয় গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদন, সংস্থারপন্থী আর উদারপন্থীদের ছাটাই করে সাধারণত ২০ শতাংশ প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতার সুযোগ দেয় গার্ডিয়ান কাউন্সিল। বিপ্লবপূর্ব ইরানেও একই প্রক্রিয়ায় সরকারে বদল আনতেন রেজা শাহ, নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো রাষ্ট্রকাঠামো।
২৯০ সদস্যের আইনসভার সদস্যরা নাগরিকদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ক্ষমতা থাকে সীমাবদ্ধ। পার্লামেন্টের অধিকাংশ বিতর্ক তিক্ততায় রূপ নেয়, রাজনৈতিক বিভাজনকে পরিণত করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিদ্বেষে। সুপ্রিম লিডারের কোনো কাজের সমালোচনা সাধারণত আইনসভাতে হয় না, ধর্মীয় রক্ষণশীল এস্টাবলিশমেন্টও থাকে সমালোচনার উর্ধ্বে। বিপ্লবপূর্ব ইরানে একই ধরনের কাঠামো ছিলেন শাহকে কেন্দ্র, রেজা শাহ পাহলভী ছিলেন সমালোচনার উর্ধ্বে।
সরকারের জবাবদিহিতা
রাষ্ট্রকাঠামোতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা থাকে সীমিত, অধিকাংশ নীতিই নির্ধারণ করেন ইরানের সুপ্রিম কমান্ডার। পার্লামেন্টের বিতর্কেও আছে বিভিন্ন ধরনের রেডলাইন, আছে সমালোচনার উর্ধ্বে থাকার মতো হাজারো বিষয়। এই ধরনের কেন্দ্রিক কাঠামো সাধারণত দুর্নীতেতে নিমজ্জিত হয়ে যায়, রাষ্ট্র আমলাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানগুলো পরিচালিত হয় রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ইরানের ক্ষেত্রেও একই ধরনের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, দেখা গেছে বিপ্লবপূর্ব ইরানেও।
এই রকম কাঠামোতে ইরানের রেভ্যলুশনারি গার্ডের মতো অন্যান্য শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব না, সম্ভব না নাগরিক সুবিধাবান্ধব আমলাতন্ত্র তৈরি করা। বিপ্লবপূর্ব ইরানের রাষ্ট্রকাঠামো ছিলো আমলানির্ভর, একই ধরনের নির্ভরতা দেখা যাচ্ছে বর্তমান সময়েও, সুপ্রিম লিডারকে কেন্দ্র করে সামরিক ও বেসামরিক আমলারাই চালাচ্ছেন ইরান।
আগামী দিনের ইরান
বর্তমান সুপ্রিম কমান্ডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বয়স আশি পেরিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছেন দুরারোগ্য ব্যাধির সাথে। পরবর্তী সুপ্রিম কমান্ডার পরে রক্ষণশীলদের একজন আসা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে তোড়জোড় শুরু করেছে রুক্ষণশীলরা, এই প্রক্রিয়াকে নির্বিঘ্ন করতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তুলে এনেছে ইব্রাহিম রাইসিকে। পরবর্তী সুপ্রিম কমান্ডার যে-ই হোক, ইরানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দ্রুত বদল ঘটবে না, বদল ঘটবে না ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতেও।