রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের যাত্রা শুরুর পর প্রথমদিকের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল সামরিক আমলাতন্ত্র, যেটি পরিচিত সামরিক বাহিনী নামেও। রাষ্ট্রকাঠামোতে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হবসের রাজনৈতিক দর্শনে। হবসিয়ান দর্শনানুযায়ী, প্রাকৃতিক কারণেই একজন মানুষ আরেকজন মানুষের চেয়ে শক্তিশালী হয়। একজন মানুষ আরেকজনের চেয়ে শক্তিশালী শারীরিক কারণে হতে পারে, হতে পারে মানসিক দক্ষতার মাধ্যমেও। কিন্তু, একজন শক্তিশালী মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চায় দুর্বল মানুষের অধিকার হরণ করতে, দুর্বলকে প্রাপ্য রাজনৈতিক সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত করতে। অনেক সময় কিছু শক্তিশালী মানুষ একত্রিত হয়ে বিপুল সংখ্যক দুর্বল মানুষের অধিকার হরণ করে।
রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক কারণেই মানুষকে কিছু জন্মগত অধিকার নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ, আধুনিক সময় এসে এই দায়বদ্ধতার সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক অধিকার চর্চার নিশ্চয়তা দানের দায়িত্ব। সবলের হাত থেকে দুর্বলের জন্মগত এবং রাজনৈতিক অধিকার জন্য রাষ্ট্র তাই নিজেকে গড়ে তুলেছে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে, অর্জন করেছে সংঘাত তৈরিতে একক কর্তৃত্ব। ফলে, পুকুরের ইকোসিস্টেমে বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, সেভাবে সবল মানুষ যাতে দুর্বলের অধিকার হরণ করতে না পারে সেজন্য রাষ্ট্র যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, সামরিক বাহিনী তার একটি।
ভারতের মতো দেশে অভ্যন্তরীণ এই দায়িত্বের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে মোকাবেলা করতে হয়, প্রতিনিয়ত যুদ্ধ-পরিস্থিতির মধ্যে দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। ভারতের সামরিক বাহিনীর এই দায়িত্বের গর্বিত অংশ হয়েছে নারীরা, নিজেদের অধিষ্ঠিত করেছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। পুনিতা আরোরা এই দায়িত্ববান নারী অফিসারদের একজন, যিনি তার চৌকশ ভূমিকা আর কৃতিত্বপূর্ণ সামরিক ক্যারিয়ারের জন্য ভারতের সামরিক বাহিনীতে প্রথম নারী হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি পান।
পুনিতা আরোরা: একজন শরণার্থী থেকে আর্মি অফিসার
ভারতীয় উপমহাদেশের এক বেদনাবিধুর রাজনৈতিক অধ্যায় ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, প্রায় প্রতিটি পরিবারকেই স্পর্শ করে এই রাজনৈতিক পরিবর্তন। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হওয়া দেশভাগে অন্য অনেকের মতো বাসস্থান পরিবর্তন করতে হয় আরোরা পরিবারকে, লাহোরের এক পাঞ্জাবি পরিবারে জন্ম নেওয়া পুনিতাকে এক বছর বয়সেই ছাড়তে হয় নিজের পিতৃপুরুষের ঠিকানা। একটি কম্বল আর একটি গ্লাস নিয়ে ভারতে স্থানান্তরিত হয় পুনিতার পরিবার, শুরু হয় শরণার্থীর জীবন।
খুব দ্রুতই পুনেতে স্থায়ী হয় পুনিতা আরোরার পরিবার, শুরু হয় নতুন সংগ্রাম। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো করা পুনিতা ১৯৬২ সালে সুযোগ পান পুনের আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করার, সুযোগ পেয়েছিলেন কানপুর মেডিকেল কলেজে পড়ারও। বাবার উৎসাহে ভর্তি হন আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে, কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচ ছিল সেটি। পুনিতা আরোরা মেডিকেল কলেজে অসাধারণ কৃতিত্বের প্রমাণ রাখেন, ব্যাচে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
পুনিতা আরোরা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আর্মি মেডিকেল কোরে কমিশনড হোন ১৯৬৮ সালে, ২১ বছর বয়সী পুনিতার প্রথম পোস্টিং হয় ফাতেহনগরে। ইন্টার্নশিপ শেষে লেফটেন্যান্ট হিসেবে সুযোগ পান সরাসরি সামরিক হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা প্রদানের। ফাতেহনগর সাধারণত সংঘাতপ্রবণ একটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের অবাধ ব্যবহার রয়েছে নাগরিকদের মধ্যে। এখানেই পুনিতা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, আরেক আর্মি মেডিকেল কোরের অফিসারের সাথে।
১৯৭১ সালে ভারত যখন বাংলাদেশের পক্ষে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, পুনিতা আরোরা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সেই প্রস্তুতি দেখেছেন জম্মু ও কাশ্মীর থেকে, সন্তান জন্মদানের জন্য তিনি ছিলেন সেখানেই। তার স্বামী তখন জম্মু ও কাশ্মীরের একটি বিমানবন্দরের দায়িত্বে ছিলেন চিকিৎসক হিসেবে, সেই বিমানবন্দরেই বোমাবর্ষণ করে পাকিস্তান বিমান বাহিনী।
২০০২ সালের মে মাসে জম্মুর নিকটবর্তী কালুচাক মিলিটারি ক্যাম্পে হামলা চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা, নিহত হয় সামরিক বাহিনীর সদস্য, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পরিবারের সদস্য ও শিশুরা। সন্ত্রাসীরা হিমাচল প্রদেশের রাস্তা ব্যবহার করে আসার সময় হত্যা করে একটি বাসের সাত আরোহীকে। সামরিক অফিসার হিসেবে পুনিতা আরোরার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময় ছিল এটি, তখন মেজর জেনারেল পুনিতা আরোরা জম্মুর বেইজ হাসপাতালের কমান্ড্যান্ট ছিলেন। সন্ত্রাসীদের হামলা আহতদের চিকিৎসায় সমন্বিত নেতৃত্ব দেন জেনারেল আরোরা, নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ পান বিশিষ্ট সেবা পদক।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা আরোরা
পুনিতা আরোরা তার সামরিক বাহিনীর ক্যারিয়ারে ১৫টি পদক পেয়েছেন, পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা। ডেকোরেটেড এক মিলিটারি ক্যারিয়ারের মাধ্যমে তিনি আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অগণিত অফিসারের কাছে, ছিলেন সামরিক বাহিনীতে দক্ষতাপূর্ণ নারীদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের মতো। কৃতিত্বপূর্ণ সামরিক ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি বিভিন্ন সময়েই পেয়েছেন, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে হন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর প্রথম নারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা আরোরার পদায়ন হয় আর্মি মেডিকেল কলেজে, এই কলেজের প্রথম নারী কমান্ড্যান্টও তিনি।
সেনাবাহিনী থেকে পরবর্তীতে নৌবাহিনীতে বদলি হয়ে যান জেনারেল আরোরা, ভারতীয় নৌবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেন প্রথম নারী সার্জন ভাইস এডমিরাল হিসেবে।
সামরিক বাহিনীকে নিজের অস্তিত্বের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা আরোরা। থ্রি স্টার জেনারেল হিসেবে প্রমোশন পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, ফৌজি হাসপাতাল, জলপাই রঙ কিংবা তিন টনের জলপাই রঙের ট্রাকের মধ্যে আমরা অস্তিত্ব খুঁজে পাই, এখানেই আমাদের শিকড়। জেনারেল আরোরার স্বামী আর্মি মেডিকেল কোর থেকে অবসর নিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে, ছেলে বিমান বাহিনীতে কাজ করেছে ডাক্তার হিসেবে, ছয় বছর সামরিক বাহিনীতে চাকরি করেছে তার মেয়েও।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা আরোরার উদাহরণ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ভারত পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় দেশগুলোর একটি। সেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস রয়েছে, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিচয় আছে, আছে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য। সবকিছু পাশ কাঁটিয়ে একটি জিনিসে ভারতের বৈচিত্র্যহীন বৈশিষ্ট্য রয়েছে; সেখানের সমাজে পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে নারীরা, পিছিয়ে আছেন রাজনৈতিক অধিকার আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দিকে থেকেও।
অক্সফাম ইন্ডিয়া সার্ভে ২০১৮ অনুসারে, ভারতীয় সমাজে পরিবারের পুরুষের কথার অবাধ্য হলে ৪২ শতাংশ নারী তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন, ২৪ শতাংশ শিকার হন শারীরিক নির্যাতনের। পরিবারের প্রধানের অনুমতি ছাড়া অর্থব্যয় করলে ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে মানসিক পীড়নের মুখে পড়েন নারীরা, ২৬ শতাংশ শিকার হয় শারীরিক শাস্তির। ভারতে নারীর প্রধানতম দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয় সন্তান প্রতিপালনকে, কিছু জায়গায় এই দায়িত্বকে বিবেচনা করা হয় একমাত্র দায়িত্ব হিসেবেও। এই কাজে ব্যর্থ হলে ৩৩ শতাংশ শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হন, ৩৬ শতাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় পরিবারের বয়োজ্যোষ্ঠদের দেখভাল ঠিকমতো না করতে পারলে। অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের হলে ৮৬ শতাংশ ক্ষেত্রে নারীকে জেরার মুখে পড়তে হয়, এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ ঘটনা গড়ায় শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত।
সামাজিক সম্মান রক্ষার্থে নারীদের হত্যা করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে, ক্ষেত্রবিশেষে ঘটে শহর বা উপশহরের মতো অঞ্চলগুলোতেও। পূর্বে সতীদাহ প্রথা ছিলো, যেটি বিলুপ্ত হয় ব্রিটিশ পিরিয়ডে। তবে, ব্রিটিশ পিরিয়ডের সমাপ্তির পর যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাধীন ভারতের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তাতেও জড়িয়ে আছে নারীদের হত্যার ঘটনা। দেশভাগের সময় চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে পরিবারের নারী সদস্যদের ইজ্জত রক্ষায় হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই ঘরের নারীদের হত্যা করেছে, দাঙ্গাকারীদের থেকে সম্ভ্রম বাঁচাতে। ২০১৪ সালে ২৮টি সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ঘটনা ঘটে ভারতে, ২০১৫ সালে ঘটে ২৫১টি। ২০১৬ সালে এই ধরনের ঘটনা ঘটে ৭৭টি। মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাবে এই ধরনের হত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। হিন্দু ও মুসলমান, ভারতের দুই সমাজেই কথিত সম্মান রক্ষার্থে খুনের ঘটনা ঘটে।
এমন সংকীর্ণ একটি সমাজে খুব স্বাভাবিকভাবেই নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায় না, জমির ন্যায্য মালিকানা থেকে বঞ্চিত হয়, বঞ্চিত হয় প্রাপ্য বেতন থেকেও। এমন সমাজে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা আরোরার মতো উদাহরণ নায্য সামাজিক কাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়াকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা আরোরার কাছাকাছি সময়েই ভারতীয় বিমান বাহিনীতে থ্রি-স্টার জেনারেল (এয়ার মার্শাল) হিসেবে প্রমোশন পান পদ্মা বন্দোপাধ্যায়। দীর্ঘ বিরতির পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে প্রমোশন পান মাধুরী কানিতকার, ২০২১ সালে সেনাবাহিনীতে আসেন আরেকজন নারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল, রাজশ্রী রামাসেতু। এর মধ্যে নোবাহিনীতে সার্জন ভাইস এডমিরাল হিসেবে প্রমোশন পেয়েছেন শিলা মাথাই।
ভারতীয় সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তনের চিত্রিত রূপই হয়ে থাকবেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা আরোরা। তিনি বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন, পাশাপাশি চিকিৎসার যে মহান ব্রত জীবনের শুরুর দিকে নিয়েছিলেন, পালন করছেন সেটিও। কঠোর পুরুষতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পুনিতা আরোরার উত্থান নিশ্চিতভাবেই আরো হাজারো নারীকে স্বনির্ভরতার পথ দেখাবে।