সম্প্রতি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করলেন’। হ্যাঁ, প্রবেশ করলেন, কারণ, ভারতের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জাতীয় অধ্যক্ষ অমিত শাহ এই বছর বিশ্বখ্যাত এই সাহিত্যিকের ১৮১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে তাকে স্মরণ করলেন; বক্তব্য রাখলেন তার হিন্দু দর্শন নিয়ে। বিরোধীদের ভাষায়, অমিত শাহ বঙ্কিমকে নিয়েও এবার ভোটের রাজনীতি করলেন।
সত্যি কথা বলতে কী, বিজেপির ‘বঙ্কিমকে ভাঙিয়ে খাওয়ার’ এই পরিকল্পনাটিকে এত দেরিতে বাস্তবায়িত হতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে ধর্মের নামে ভোট ঝুলিতে ভরা বেশ কষ্টসাপেক্ষ কাজ, সেখানে বঙ্কিমের মতো আপাত রক্ষণশীল হিন্দুকে বিজেপি কেন এতদিন ‘কাজে লাগানোর’ কথা ভাবল না, তা বেশ অদ্ভুত। রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দের চেয়ে তাত্ত্বিক বিচারে বঙ্কিম বিজেপির কাছে এক আদর্শ অস্ত্র হয়ে উঠতে পারতেন এতদিনে। এ কি তবে ইন্টেলিজেন্স-এর ব্যর্থতা?
কী কারণ আদতে সেটা বিজেপির নেতৃত্বই বলতে পারবেন, কিন্তু বঙ্কিম তাত্ত্বিক অর্থে বিজেপির কাছে আদর্শ হলেও যে কারণে বিজেপি তাকে নিয়ে পড়েছে, অর্থাৎ বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালদের উপরে প্রভাব বিস্তার করা- তাতে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহরা এখনও যোজনখানেক পিছিয়ে। অর্থাৎ, আপাতদৃষ্টিতে বঙ্কিমকে বিজেপির কাছের বন্ধু মনে হলেও আসলে ঘটনা তা নয়।
‘রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আর নতুন কিছু করার নেই’
বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রসঙ্গে যখন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির নেতৃত্ব জানায় যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে যেহেতু আর নতুন করে কিছু করার বা বলার নেই, তাই তারা ঠিক করেছেন বঙ্কিমকে স্মরণ করবেন কারণ, পশ্চিমবঙ্গে তিনি এখনও সেভাবে স্বীকৃত নন।
মন্তব্যটি বেশ সারবত্তাহীন। যদি বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালদের আকৃষ্ট করাই শাহের নতুন নির্বাচনী কৌশল হয়ে থাকে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে, তবে “রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আর নতুন কিছু করার নেই” ধরনের উক্তি তাতে নিশ্চিতভাবেই জল ঢালবে। প্রকৃত ইন্টেলেকচুয়ালদের কাছে রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিম কোনো আলাদা আলাদা শিবিরের সৈনিক নন যে, একজনকে না পাওয়া গেলে আরেকজনকে ভাড়া করে নিলেই হবে। এতে বিজেপির প্রাথমিক চিন্তাভাবনার দৌর্বল্যই প্রকট হয়।
বঙ্কিমচন্দ্রেকে আপাতদৃষ্টিতে কট্টর হিন্দুপন্থী মনে করা হলেও, আজকের রাজনীতির কারবারিদের এটুকু মাথায় রাখা প্রয়োজন যে সেই সময়কার এই বিশ্ববরেণ্য মানুষগুলো ভোটবিলাসী ছিলেন না। তাদের দর্শন-আদর্শ-মৌলিক চিন্তাগত অবস্থানকে আজকের রাজনীতিবিদরা নিজেদের মতো বিশ্লেষণ করে মানুষকে প্রভাবিত করতে চাইলেও, সে প্রয়াসের দুর্বলতা কখনও না কখনও বেরিয়ে পড়বেই আর বিজেপির এই বঙ্কিম পর্বেও তা-ই দেখা যাচ্ছে। বঙ্কিমকে একটি বিশেষ ধর্মের বেড়াজালে বেঁধে ফেলার চেষ্টা নেহাতই মূর্খামি আর এই মুর্খামিকে কখনোই আস্কারা দেবেন না বঙ্গদেশের প্রকৃত ইন্টেলেকচুয়ালরা।
বঙ্কিমকে নিয়ে নয়া আইডেন্টিটি পলিটিক্স
আসলে বিজেপির মতলব হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুরু করা ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’কে হাতিয়ার করে তার পথেই তাকে পরাস্ত করা। কিন্তু বিজেপি ধর্মীয় দিকটি বুঝতে পারলেও শাসক তৃণমূলের সঙ্গে এখনও বঙ্গীয় এলিটশ্রেণীকে প্রলুব্ধ করার খেলায় এঁটে উঠতে পারেনি। এমন নয় যে পশ্চিমবঙ্গের তামাম এলিট/ইন্টেলেকচুয়াল শ্রেণীর মানুষ মমতাকে কাছে টেনে নিয়েছেন কিন্তু মমতার বেশ কিছু পদক্ষেপ এই শ্রেণীর একটি অংশের সঙ্গে তার একটি সখ্য তৈরি করেছে যা বিজেপির কাছে এখনও অধরা।
মমতা ক্ষমতায় আসার পরে নিয়মিতভাবে বিগত দিনের কৃতী বাঙালিদের জন্মদিন উদযাপন করেছেন; বর্তমান সময়ে নানা বয়সী কৃতী বাঙালিদের পুরস্কৃত ও সম্মানিত করেছেন যা তার পূর্বসূরি বামফ্রন্টের সময়ে দেখা যায়নি বিশেষ। সময়ে সময়ে নানা সরকারি সভা বা কমিটিতে নিযুক্ত করেছেন সংস্কৃতি জগতের মানুষদের; এমনকি তাদের ঢালাও নির্বাচনী টিকিট দিয়ে জিতিয়ে এনেছেন কেন্দ্রের লোকসভায় এবং রাজ্যের বিধানসভায়। হ্যাঁ, বিভিন্ন সময়ে এই সাংস্কৃতিক বা ইন্টেলেকচুয়াল মানুষের সঙ্গে যে মমতা সরকারের মতানৈক্য হয়নি তা নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই শ্রেণীর মধ্যে তৃণমূল নেত্রীর সার্বিক জনপ্ৰিয়তা কমেনি সেভাবে। মমতা তার সহজাত ক্ষমতায় কাছে টেনে নিয়েছেন এই সমস্ত মানুষকে।
অন্যদিকে, বিজেপি এখনও এই কৌশলের বিন্দুবিসর্গও আত্মস্থ করতে পারেনি। মুখে বঙ্কিম বা রবিঠাকুরের বা শ্রীরামকৃষ্ণ বা বিবেকানন্দের কথা তারা বলছে ঠিকই মানুষকে আকৃষ্ট করতে, কিন্তু আত্মিক যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা প্রকট হচ্ছে বরাবরই। শুধুমাত্র অতীতের মনীষীদের নাম উচ্চারণ করে বঙ্গীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কামড় বসানো যে প্রায় অসম্ভব, মোদী-শাহ-এর দলকে সেই সত্য বুঝতে হবে অতি শীঘ্রই।
রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্কিমকে নিয়ে গোদা আইডেন্টিটি পলিটিক্স করতে গিয়ে বিজেপি ইন্টেলেকচুয়াল তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গের অনেক সাধারণ মানুষের মনেও বিরক্তির উদ্রেক ঘটাবে। বঙ্কিমচন্দ্র উনবিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রনির্মাণ নিয়ে কী বলে গিয়েছেন তা নিয়ে তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত চর্চা করা বিশেষজ্ঞ ছাড়া সাধারণ মানুষের সেভাবে মাথাব্যথা হয়তো নেই। কিন্তু তাদের এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, গেরুয়াবাহিনীর হোতারা আচমকা বঙ্কিমের আদর্শ নিয়ে পড়েছেন শুধুমাত্র নির্বাচনের সময়ে ফসল ঘরে তোলার লক্ষ্যে।
যদি সত্যিই বিজেপি চায় বঙ্কিমকে ফের জনমানসে চাঙ্গা করতে এবং ইন্টেলেকচুয়ালদের বোঝাতে যে সাহিত্যসম্রাটের চিন্তাভাবনা-দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক, তবে তাকে বিশেষজ্ঞদের হাত ধরেই তৈরি করতে হবে এক বড় কর্মসূচি, যা প্রকৃত অর্থেই প্রভাবিত করবে সমসাময়িক জনসাধারণকে এবং এলিট শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের।
শুধু বঙ্কিমের উপরে গবেষণা করে, তার শুধুমাত্র হিন্দু-কেন্দ্রিক বক্তব্যটুকু তুলে ধরে এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক হোতাদের দিয়ে সেই বক্তব্যগুলোতে রাজনীতির প্রলেপ লাগিয়ে জনসমক্ষে পরিবেশন করে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বঙ্কিমকে নিয়ে অমিত শাহের সেই বক্তৃতাসভায় পশ্চিমবঙ্গের অনেক বিশিষ্টব্যক্তি আমন্ত্রিত হলেও যাননি অনেকেই। বিজেপির পক্ষ থেকে তার জন্যে তৃণমূলের ‘খবরদারি’কে দায়ী করা হলেও এর পিছনে যে বিজেপির বাঙালি মননকে বুঝতে উঠতে পারার ব্যর্থতাই প্রকট হয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিকভাবে দাগ কাটতে হলে বিজেপিকে প্রথমেই সেখানকার সমাজ-জীবনের উপরে গভীরভাবে আলোকপাত করতে হবে। শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক রেকর্ড যেরকমই হয়ে থাকুক না কেন, তার সময়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি-সমাজনীতিতে এক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। বাম জমানার এলিটিজমকে অন্তঃসারশূন্য প্রমাণ করে তিনি এক ধরনের সাব-অল্টার্ন সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার পাশাপাশি এক বাঙালি খণ্ডজাতীয়তাবাদকে চাগিয়ে তুলেছেন। বিজেপির রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদী জিগিরের পক্ষে তাতে আচমকা মিশ খেয়ে যাওয়া বেশ কঠিন; এমনকি বঙ্কিমের রাষ্ট্রীয় চিন্তার উপরে আলোকপাত করেও। রাজনৈতিকভাবে হয়তো পশ্চিমবঙ্গে মোদী ঝড় আগামী দিনেও উঠবে, কিন্তু সেই রাজ্যের মনন-সংস্কৃতিতে যতক্ষণ না নিজেদের ছাপ পাকাপাকি ভাবে ফেলতে পারছে বিজেপি, ততদিন সেই ঝড়কে যুগান্তকারী বলা বোধহয় সম্ভব হবে না।
কিন্তু কোন পন্থায় এই পাকাপাকি ছাপ ফেলা সম্ভব?
প্রথমত, স্থানীয় পর্যায়ে যোগ্য নেতৃত্ব তুলে ধরা আর যেটা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই মুহূর্তে নেই। মুখে মারকাটারি কথা বার্তা বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করার সস্তা রাজনীতি না করে জনসাধারণের মধ্যে আরও পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে বিজেপিকে। আর মমতা রবীন্দ্রপ্রীতি দেখাচ্ছেন বলে আমাকেও অগভীর বঙ্কিমপ্রীতি দেখাতে হবে পাল্টা, এই নীতি ভ্রান্ত। ইন্টেলেকচুয়ালদের মন জয় করার জন্য মনীষীদের জয়গান গাইবার প্রয়োজন পড়ে না। পড়ে যোগ্য এবং প্রাসঙ্গিক চিন্তাভাবনা করার।
দ্বিতীয়ত, যদি বিজেপি মনে করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চূড়ান্ত সংখ্যালঘু তোষণ করছেন, তবে তাকে কোণঠাসা করার জন্যে বঙ্কিমের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের বিস্তার ঘটাতে হবে, এমন দিব্যি কেউ দেয়নি। বরং, ধর্মীয় লড়াইয়ের পথে না গিয়ে যদি বিজেপি চেষ্টা করত বিদ্রোহী কবি নজরুলের দেওয়া শিক্ষার বিস্তারের বা রবীন্দ্রনাথের আদর্শের ব্যাপ্তির উপরে, তাহলে বাঙালি মনন খুশি হয়ে গ্রহণ করত বিজেপির রাজনৈতিক-সমাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে।
কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে কই? আর যদ্দিন না হচ্ছে, তদ্দিন রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিম-বিবেকানন্দ নিয়ে বিজেপির এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা চলতেই থাকবে। বিজেপি বাঙালিকে হয়তো খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু বাঙালিয়ানাকে? না, এখনও না।
Featured Image Source: Telegraph India