সংখ্যাগুরুর স্বৈরশাসন ও চিন্তার ফুটন্ত পাত্র: জন স্টুয়ার্ট মিলের ব্যক্তিস্বাধীনতার চিন্তা

গণতন্ত্র, প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রিসের এথেন্সে সূচিত এই ব্যবস্থা মানব সভ্যতার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। শক্তিশালী শাসকগোষ্ঠীর একক ক্ষমতাভিত্তিক ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে জনগণের শক্তি প্রতিষ্ঠাই ছিল গণতন্ত্রের মূলকথা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের ভোটে রাষ্ট্রপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কিন্তু কোনো রাষ্ট্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ- যেকোনো পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে কোনো সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর তাদের মত সংখ্যালঘুর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর ভিত্তি করে অত্যাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে এর বেশ কিছু বাস্তব প্রমাণ রয়েছে।

জন স্টুয়ার্ট মিল; Image Source: Literary Hub

এ বিষয় নিয়েই ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল চিন্তা উদ্রেককারী আলোচনা করেছেন তার অন লিবার্টি বইটিতে।

ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ

স্টুয়ার্ট মিল উদারনীতি মতবাদের অন্যতম একটি দিক তুলে ধরেন। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকেই তিনি একটি সুস্থধারার সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর বলে অভিহিত করেন। ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ভারসাম্য রক্ষার বিষয়কে কেন্দ্র করেই এ আলোচনা করেন।
পূর্বে যখন রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল, তখনকার শাসকদের অত্যাচার, জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না, রাষ্ট্রব্যবস্থাই ছিলো শাসকের একক স্বার্থভিত্তিক।

ঊনিশ শতকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা জনপ্রিয় হওয়া শুরু হয়; ধারণা করা হয়, রাষ্ট্র পরিচালিত হবে নাগরিকের স্বার্থে। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে থাকায় জনসাধারণ-ই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রের স্বার্থ ও জনসাধারণের স্বার্থের সমতা বিধানের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাবা হতো, সরকারি হস্তক্ষেপ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জন্য ক্ষতিকর হবে না, তার দ্বারাই নির্বাচিত বিধায়।

সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরশাসন

উপরিউক্ত চিন্তার, হস্তক্ষেপের প্রভাব সম্পর্কে উদাসিনতার ও চিন্তামুক্ত থাকার ব্যাপারে মিল সতর্ক করেন। তিনি বলেন, নির্বাচিত সরকার শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিধায় একসময় এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী-ই সংখ্যালঘুদের অত্যাচার করার পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরশাসন এটাই বোঝায় যে, এমনকি নির্বাচিত সরকারের হস্তক্ষেপও ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব রাখতে পারে।

সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরশাসনের ব্যাপারে স্টুয়ার্ট মিল; source: pinterest/James(vanner1000)

এই অবস্থায় ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস, কর্মকাণ্ড, মতামত সামাজিকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সমাজের যাবতীয় কার্যাবলী যদি সামষ্টিক কোনো মতবাদের ভিত্তিতে পরিচালন হওয়া বাধ্যতায় রূপ নেয়, সেই মতবাদ ও কর্মকাণ্ড একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর-ই স্বার্থরক্ষা করে পরিচালিত হয়।

তখনকার সময়ে ব্রিটেন আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের পথে ছিল। মিল বলেন, জনগণ তখনো আসন্ন বিপদে সম্ভাবনা বোঝার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সরকারি নিয়ন্ত্রণের, ক্ষমতাসীনদের স্বৈরশাসনের ভয় তখনো মানুষের মনে এমন পর্যায়ে ছিলো যে, গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর স্বৈরাচারী আচরণের ধারণাই মানুষ বুঝতে পারেনি। সামষ্টিক মতামতের স্বৈরাচারী আচরণ তখনই একটু একটু করে প্রকাশিত হচ্ছিল এবং স্টুয়ার্ট মিল ভীতি প্রকাশ করে বলেন, ব্যক্তির উপর সমাজের কর্তৃত্ব খাটানোর ও নিয়ন্ত্রণের একটি সাধারণ প্রবণতা বেড়ে চলেছে।

সমর্থনযোগ্য হস্তক্ষেপ

এ প্রবণতা দূর করার জন্য একটি নৈতিক বাধার প্রয়োজন ছিল। জন স্টুয়ার্ট মিল ব্যক্তিস্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের যথাযথ সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালান। তিনি বলেন, রাষ্ট্র ও সমাজ তখন-ই ব্যক্তির কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে, যখন সে কাজ অন্য মানুষের ক্ষতির কারণ হয়। উক্ত কাজ যদি ব্যক্তির নিজের ক্ষতির কারণ হতে পারে, তখন সে কাজ না করার জন্য তাকে নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে, কিন্তু জোরপূর্বক বাধ্য করা যাবে না। তিনি বলেন,

“ব্যক্তি তার নিজের শরীর ও মনের ওপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।”

জন স্টুয়ার্ট মিলের উক্তি; Image Source: AZQuotes

ব্যক্তিস্বাধীনতার এই নীতি ব্যক্তির চিন্তা, মতামত প্রকাশ ও কাজের স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রসারিত। তিনি বলেন, এই নীতি মেনে চলা না হলে সম্পূর্ণ সমাজ ভুক্তভোগী হবে। কেননা, চিন্তার স্বাধীনতা ছাড়া নতুন জ্ঞান ও উদ্ভাবনের পথ রুদ্ধ হবে। মানুষের মন ভ্রমপ্রবণ; কোনো চিন্তা ও ধারণার সত্যতা যাচাই করা তখনই সম্ভব, যখন তাকে প্রকাশিত হতে দেওয়া হয় এবং নিরীক্ষা করা হয়। চিন্তা ও ধারণার কণ্ঠরোধ করা হলে সমাজ অনেক নায্য ধারণা হারাবে। এর পাশাপাশি কোনো অন্যায্য ধারণা ও চিন্তা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করবে, যা কিনা অন্য চিন্তার প্রকাশ হতে দিলে, তার অন্যায্যতা প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

সত্য-মিথ্যা, ন্যায্যতা-অন্যায্যতার পরোয়া না করে তথাকথিত সামাজিক মঙ্গলজনক আরোপিত চিন্তার ধারণাকে স্টুয়ার্ট মিল প্রত্যাখ্যান করেন। ভিন্ন মতাবলম্বীদের জনসম্মুখে হত্যা করার অসুস্থ সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে গেলেও, স্টুয়ার্ট মিল বিশ্বাস করতেন, প্রচলিত নিয়ম বিরোধী চিন্তা সমাজে সহ্য করা না হলে, কণ্ঠরোধ করা হলে- তা সমাজের মানুষের মানসিক বিকাশ রোধ করবে ও সামাজিক উন্নতিকে বিঘ্নিত করবে। 

চিন্তা ও ধারণার প্রাচুর্য ও চিন্তার ফুটন্ত পাত্র (কলড্রন) তত্ত্ব

সমাজে প্রচলিত নিয়ম-নীতি, ধারণা সত্য ও মঙ্গলজনক হলেও, সে সমাজেও চিন্তা ও ধারণার প্রাচুর্য বজায় রাখা জরুরি বলে মনে করতেন স্টুয়ার্ট মিল। কোনো অর্বাচীন ও মঙ্গলজনক চিন্তা ও ধারণার জীবনীশক্তি ও ক্ষমতা বজায় রাখার জন্যই চিন্তা ও ধারণার প্রাচুর্য বজায় থাকা প্রয়োজন বলে মনে করতেন তিনি। কেননা, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ম-নীতিকে কখনোই গণিতের মতো শতভাগ সত্য প্রমাণ করার উপায় নেই। একারণেই সমাজে প্রচলিত চিন্তার পাশাপাশি নতুন চিন্তার বিকাশ ঘটতে দেওয়া, প্রতিনিয়ত নিরীক্ষা চালানো জরুরি। বিরোধী মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা, পরস্পরবিরোধী চিন্তার অধিকারীরা একে অপরের চিন্তা শোনাই চিন্তার নিরীক্ষণের সর্বোত্তম উপায়।

আলোচনা ও যুক্তিতর্ক ছাড়া জনসাধারণ এমনকি ন্যায্য কোনো ধারণা ও নীতিরও মর্ম উপলব্ধি করতে পারবে না। ফলস্বরূপ, সে মতবাদ হারিয়ে যাবে। মানুষ অনুধাবণের শক্তি হারিয়ে ফেলে তোতাপাখির মতো মুখস্ত বুলি আওড়ে যাবে। চিন্তা ও মতের ফুটন্ত পাত্র বা কলড্রনের তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রত্যেক চিন্তা ও মতের প্রতিনিয়ত একটির অপরটির সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবস্থা থাকতে হবে। ফুটন্ত পাত্রের পানির বাষ্পে পরিণত হওয়ার মতোই, একসময় এই প্রক্রিয়ায় মিথ্যা, ভঙ্গুর চিন্তা, নীতি বিলীন হয়ে যায়। সত্য, অর্বাচীন ও অক্ষতিকর চিন্তা, মতবাদ রয়ে যায়, এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

ফুটন্ত কলড্রন তত্ত্ব; source: The Politics book

স্টুয়ার্ট মিলের ব্যক্তি স্বাধীনতার ৩টি মূল নীতি

১) চিন্তা ও ধারণার স্বাধীনতা- মতামত প্রকাশের ও অনুভূতির সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। তা কথা ও লেখার মাধ্যমে প্রচার করার পূর্ণ স্বাধীনতা।

২) নিজস্ব রুচি অনুযায়ী কাজের স্বাধীনতা- নিজের জীবন নিজের পছন্দসই যাপনের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা, যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির কাজ অন্য কারো ক্ষতি না করে।
৩) সমন্বিত হওয়ার স্বাধীনতা- একাধিক ব্যক্তির কোনো উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা, যা কোনো মানুষের ক্ষতি করে না, এবং যে প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তিকে জোরপূর্বক সংঘবদ্ধ করা হয় না।

স্টুয়ার্ট মিল তার উদারনীতির নীতি ব্যক্তির কাজের ক্ষেত্রেও প্রায়োগিক বলেছেন। তবে, তিনিও আরও বলেছেন, কাজের স্বাধীনতার ক্ষেত্র, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র থেকে কিছুটা সীমাবদ্ধ হবে। কারণ, কথার থেকে কোনো কাজের অপরের ক্ষতিসাধনের সম্ভাবনা বেশি থাকে। মিল বিশ্বাস করতেন, মানুষ যখন সংক্রিয়ভাবে কোনো প্রথা, রীতি অনুসরণ করে যায়, হঠকারিভাবে কোনো মতবাদ ধারণ করে, মানুষের জীবন ধারণের প্রক্রিয়া ও নৈতিক চিন্তার শক্তি দুর্বল হয়ে যায়।

বিংশ শতাব্দীতে জন স্টুয়ার্ট মিলের এই ধারণা ও তত্ত্বের বাস্তবিক প্রমাণ পাওয়া যায়। নারীরা দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর ভোটাধিকার পায়। পূর্বে নারীদের ভোটাধিকারের বিষয়টি অকল্পনীয় ছিলো। দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রতিবাদ, চিন্তার প্রকাশের পর এই বিষয়টি সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

নারীর ভোটাধিকার আন্দোলন; Image Source: Daffofil International University

সারা বিশ্বে উদার গণতন্ত্রের ধারণার ক্রমবিকাশে জন স্টুয়ার্ট মিলের এ তত্ত্ব গভীর প্রভাব রেখেছে। এ তত্ত্ব ও ধারণাই বাস্তবসম্মত উদারনীতি তত্ত্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক ব্যবহৃত যুক্তিতর্ক।

জন স্টুয়ার্ট মিল এর বই সমূহ দেখতে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে- 

https://cutt.ly/DflQL7M

This article is in Bengali language. It is about John Stuart Mill's individual liberty and Idea's Bubbling Cauldron theory.

Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image: Literary Hub

Related Articles

Exit mobile version