মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর একটি কাজাখস্তান। এই অঞ্চলের জিডিপির ৬০ শতাংশের যোগান দেয় তেলসমৃদ্ধ এই দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কাজাখস্তানের যাত্রা শুরু। দীর্ঘ তিন দশক দেশটি শাসন করেন নুর-সুলতান নজরবায়েভ। বছর তিনেক আগে আন্দোলনের মাধ্যমে ইতি ঘটে নজরবায়েভের সরাসরি শাসনের, ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তার অনুগত কাসিম-জোমার্ট তোকায়েভের কাছে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তোকায়েভকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়েছে নজরবায়েভের ছায়ার মধ্যে থেকে। নজরবায়েভের হাতে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যানশিপের সূত্রে। তোকায়েভ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই শুরু হয় করোনা মহামারি। বিভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ থাকার ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল সীমিত। রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তোকায়েভকে মোকাবেলা করতে হয়েছে কম। তোকায়েভের প্রেসিডেন্সিতে জনগণের দিক থেকে প্রথম রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হলো এই বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। দেশব্যাপী আন্দোলনে ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দেওয়া এই আন্দোলনকে দমন করতে প্রেসিডেন্ট তোকায়েভকে আনতে হয়েছে বিদেশী সেনা, ব্যবহার করতে হয়েছে সহিংস পদ্ধতি।
কাজাখস্তানে কেন আন্দোলন?
জানুয়ারির শুরুতে তোকায়েভ সরকার তেলের দামের উপর সর্বোচ্চ সীমা প্রত্যাহার করে নেয়। পরদিনই তেলের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। কাজাখস্তান মধ্য এশিয়ার তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি, রাষ্ট্রীয়ভাবে যেটি দীর্ঘ সময় ধরে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন মূল্যের চেয়েও কম দামে তেল বিক্রি করে কাজাখদের কাছে। করোনার কারণে কাজাখস্তানের অর্থনীতির উপর চাপ বেড়েছে, ফলে তেলের দামে উপর ভর্তুকি দেওয়া রাষ্ট্রের দিক থেকে একটি বোঝাস্বরূপ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিশাল প্রতিরক্ষা আর আমলাতান্ত্রিক ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি তেলের ভর্তুকি দেওয়ার সক্ষমতা রাষ্ট্রের জন্য সীমিত হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই তেলের দাম বৃদ্ধি করতে হয় সরকারকে।
রান্নাবান্না থেকে শুরু করে গাড়ি চালানো, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্মে কাজাখরা তেলের উপর নির্ভরশীল, নির্ভরশীল এই হাইড্রোকার্বনের বিভিন্ন উপজাতের উপরও। লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির মূল্যবৃদ্ধির অর্থ, যাপিত জীবনের ব্যয়ভার হঠাৎ করে অনেক বেশি বেড়ে যাওয়া, জীবনধারণের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাওয়া। হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া এই জীবনযাপনের ব্যয় বহন করার সামর্থ্য অধিকাংশ কাজাখের নেই। করোনার কারণে নতুন করে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিনিয়ত ধুঁকতে থাকা কাজাখ অর্থনীতি করোনার কারণে খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে, মানুষের সামষ্টিক সীমাবদ্ধতার জায়গা থেকেই আন্দোলন শুরু হয়, যেটি পরবর্তী দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, রূপ নেয় সহিংস আন্দোলনে।
করোনা মহামারির কারণে একটা দীর্ঘ সময় ধরে লোকসান গুনতে হয়েছে তেলের ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানগুলোরও। মহামারির সময়ে মানুষের চলাচল সীমিত ছিল, যানবাহন চলেছে কম, মানুষের আয় সীমিত হয়ে যাওয়ায় ভোগব্যয়ও কমেছে। ফলে, সরকার যখন তেলের সর্বোচ্চ মূল্যের সীমা তুলে দিল, ব্যবসায়ীরা সুযোগটি নিল মহামারিতে হওয়া লোকসান পুষিয়ে নিতে। সামগ্রিকভাবে, তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে এই গোষ্ঠীটির প্রভাবই হয়তো সবচেয়ে বেশি ছিল, সরকারের উপর চাপপ্রয়োগকারী গোষ্ঠী হিসেবে এদের ভূমিকাই বেশি হওয়ার কথা।
যেভাবে ছড়িয়ে পড়লো আন্দোলন
জানুয়ারির ২ তারিখ এলপিজির মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে আগের মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। পরদিনই কাজাখস্তানের বিভিন্ন শহরে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ করে। রাজনৈতিকভাবে তাদের দাবি ছিল পরিষ্কার- তেলের দাম কমাতে হবে, কারণ কাজাখস্তানের তুলনামূলক অন্যান্য খাতগুলো এই খাতের উপর নির্ভরশীল। এই দিনই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে নুর-সুলতান, আলমাটি আর মাঙ্গিস্টাওয়ের মতো শহরগুলোতে। এই দিনে পুলিশের সাথে সহিংস কোনো সংঘাতের ঘটনা না ঘটলেও গ্রেপ্তার হয় তিন কাজাখ নাগরিক।
জানুয়ারির ৪ তারিখেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, যার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে পুরাতন রাজধানী আলমাটির আলমাটি স্কয়ার। কাজাখস্তানের সবচেয়ে বড় শহর এই আলমাটি, সবচেয়ে বেশি মানুষের বসবাসও এই শহরেই। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ এ দিন টিয়ার গ্যাস ছোড়ে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে, ব্যবহার করে স্টান গ্রেনেড। আন্দোলনকারীদের শান্ত করতে সরকার ঘোষণা দেয়- তেলের মূল্যের উপর কিছু সীমাবদ্ধতা আবারো আরোপ করা হবে।
পরদিন আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন সরকারি ভবনে আক্রমণ করে, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ ঘটে জনগণের ক্ষোভের। আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আলমাটি শহরের মেয়রের কার্যালয়ে, আগুন দেওয়া হয় আলমাটির সিটি সেন্টারেও। প্রাথমিকভাবে এই কাজ বিক্ষোভকারীরাই করেছে বলে সন্দেহ করলেও বিভিন্ন বিশ্লেষকরা এই ঘটনাকে দেখছেন কাজাখ অভিজাতদের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে নতুন সমীকরণ তৈরির চেষ্টা হিসেবেও। কাজাখস্তানে যেসব অভিজাত পরিবার আর গোষ্ঠী রয়েছে, এরা সাধারণত খেলার ক্লাবের পরিচয়ের আড়ালে নিজেদের অনুগত মিলিট্যান্ট গোষ্ঠী তৈরি করে। আগুন লাগানোর কাজ এই মিলিট্যান্ট গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজাখ সরকার দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করে।
জানুয়ারির ৬ তারিখ প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ এক ভাষণে আলমাটির অবস্থার জন্য আন্দোলনকারীদের দায়ী করেন, দাবি করেন- আন্দোলনকারীরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী। একই দিনে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, কাজাখস্তানের পরিস্থিতি সামাল দিতে শান্তিরক্ষী বাহিনী যাবে, যার নেতৃত্বে থাকবে রাশিয়ার সৈন্যরা।
জানুয়ারির ৭ তারিখ থেকে পরিস্থিতি আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকে, প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ নির্দেশ দেন আন্দোলনাকারীদের “দেখামাত্র গুলি করার”। এই পর্যন্ত ১৩ জন নিরাপত্তারক্ষীর পাশাপাশি ২৬ জন আন্দোলনকারীর রক্তে রঞ্জিত হয় কাজাখস্তানের রাজপথ, আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ।
জানুয়ারির ৮ তারিখেই আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায়, আন্দোলনকারীর সংখ্যাও কমে যায় ব্যাপকভাবে। একই দিনে সাবেক কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স চিফ ও এন্টি-টেরর এজেন্সি চিফ কারিম মাসিমভকে গ্রেপ্তার করা হয় সরকার উৎখাতের চেষ্টার অভিযোগে।
জানুয়ারির ৯ তারিখেও আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল আলমাটি স্কয়ার ছিল নীরব। তাদের উপস্থিতি ছিল না অন্যান্য শহর আর শহরতলীতেও, আইনশৃংখলা বাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া ফাঁকা হয়ে যায় রাজপথও। সমাপ্তি ঘটে আরেকটি আন্দোলনের।
আন্দোলনকারীদের দাবি
আন্দোলনকারীরা মূলত পাঁচটি দাবি নিয়ে রাজপথে নামে:
১. সরকারের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট নুর-সুলতান নজরবায়েভের প্রভাব কমিয়ে আনা, সরকারের মধ্যে প্রকৃত পরিবর্তন আনা।
২. প্রাদেশিক পরিষদের গভর্নরদের প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে নিয়োগের বদলে এদের জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
৩. ১৯৯৩ সালের সংবিধান ফিরিয়ে আনা, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে সুস্পষ্ট করা।
৪. রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিয়ন্ত্রণ ও নির্যাতন বন্ধ করে উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৫. নতুন সরকারে স্বার্থের দ্বন্দ্বে পতিত হবে না, এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া।
কেন ব্যর্থ হলো এই আন্দোলন
গত কয়েক বছরের মধ্যে কাজাখস্তানে সবচেয়ে বড় আন্দোলন ছিল গত সপ্তাহের আন্দোলন। তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে এই আন্দোলন শুরু হলেও পরবর্তীতে তেলের দাম কমলেও স্তিমিত হয়নি এই আন্দোলন। বরং, আন্দোলনকারীরা হাজির হন পাঁচ দফা দাবি নিয়ে, প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ বাধ্য হন তার সরকারকে বরখাস্ত করতে। এরপরও, এই আন্দোলন কাঙ্ক্ষিত কাঠামোগত পরিবর্তনগুলো আনতে পারেনি।
প্রথমত, কাঠামোগত পরিবর্তন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রতিনিয়ত আন্দোলন করে যেতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে একটি আন্দোলন চালিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন হয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের, যারা সব জায়গায় গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখবে। জানুয়ারির শুরুতে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না, ছিল না কেন্দ্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামোও। এই শূন্যতা শুরুতেই আন্দোলনের সফলতার ক্ষেত্রে একটি বাধা তৈরি করেছে।
দ্বিতীয়ত, আন্দোলন দমনে তোকায়েভের সরকারকে বাইরে থেকে আনা শান্তিরক্ষীদের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। কাজাখস্তানের সামরিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্য রয়েছে এক লাখ, বার্ষিক বাজেট চার বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। রয়েছে পুলিশ, পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট আর আধা-সামরিক বাহিনীও। আন্দোলন দমনে প্রেসিডেন্ট তোকায়েভ এদের উপর নির্ভর না করে রাশিয়ান নেতৃত্বাধীন সেনা আনার অর্থ হলো, সামরিক আর বেসামরিক আমলাতন্ত্র অনেকগুলো স্বার্থগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই, যাদের উপর প্রেসিডেন্ট তোকায়েভের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই।
এই ধরনের আমলাতন্ত্র যেসব রাষ্ট্রে থাকে, তারা সাধারণত রাজনৈতিক অধিকারগুলো বিকাশের পক্ষে কাজ করেন না। বুদ্ধিবৃত্তিক জগত থেকেও সমর্থন পাওয়া আন্দোলনকারীদের জন্য দুরূহ ব্যাপার হয়ে যায়। ফলে, আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি আটকে যায়। কাজাখস্তানের ক্ষেত্রেও সেটিই হয়েছে। সরকার আর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ছিল, সেটির প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদে এটি আবেদন তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তৃতীয়ত, আয়তনের দিক থেকে কাজাখস্তান পৃথিবীর নবম বৃহৎ দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৮৮ লাখ। মোট সম্পদের অধিকাংশই অল্প কয়েকজন অভিজাতের হাতে কুক্ষিগত, রয়েছে উচ্চ শ্রেণিবৈষম্য। কাজাখস্তানে যেসব অভিজাত রয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই নিজস্ব মিলিট্যান্ট বাহিনী থাকে। জানুয়ারির শুরুতে হওয়া আন্দোলনে এদের অংশগ্রহণ আর ভূমিকা বিভিন্ন বিশ্লেষকের আতশি কাচের নিচে এসেছে। আন্দোলনের ব্যর্থতার পেছনে এদেরও ভূমিকা রয়েছে, ভূমিকা থাকতে পারে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠার প্রবণতার মধ্যেও।
কাজাখস্তানের সামনে যা আছে
পৃথিবীতে কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে থাকে কেবল দুটি জিনিস নিশ্চিত করতে পারলেই। একটি হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার, অন্যটি হচ্ছে অর্থনৈতিক ন্যায্যতা। সাবেক প্রেসিডেন্ট নুর-সুলতান নজরবায়েভ প্রথমদিকে সেটি নিশ্চিত করেই নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন। অর্থনৈতিক সাফল্যের বিনিময়ে জনগণ প্রেসিডেন্ট নুর-সুলতানকে সমর্থন দিয়েছিল। গত দশকে এই সামাজিক চুক্তি ভেঙে পড়েছে, ক্ষমতারও ঘটেছে পরিবর্তন। সামনের দিনগুলোতে যে এই প্রক্রিয়ার রেশ থাকবে। রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে কাজাখরা পুনরায় এমন আন্দোলনে জড়ালে মোটেই অবাক হবার কিছু থাকবে না।