প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ ডকুমেন্টস, ২.৯৪ টেরাবাইট ডেটা ও ১৪টি উৎস থেকে প্রকাশিত প্যান্ডোরা পেপারস এখন সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ১১৭টি দেশের ৬০০’র বেশি সাংবাদিকদের প্রচেষ্টায় বেরিয়ে এসেছে বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালীদের গুপ্ত সম্পদ, কর ফাঁকি, এবং অর্থ পাচারের খবর। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি.সি. ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান International Consortium of Investigative Journalists (ICIJ) উপাত্তগুলো সংগ্রহ করে। সংগৃহীত উপাত্ত ১৪০টির মতো সংবাদ সংস্থার সাথে তারা যাচাই করে, যা এযাবত কালের সবচেয়ে বড় ইনভেস্টিগেশন। যুক্তরাজ্যে BBC Panorama ও The Guardian এ তদন্তের নেতৃত্ব দেয়।
কী কী বের হয়ে আসলো প্যান্ডোরা পেপার্সে
অতীতের পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সের মতো প্যান্ডোরা পেপার্সও ছিল বিশ্বনেতাদের দুর্নীতির উপাখ্যানে ভরপুর।রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন থেকে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ ও তার পরিবারের গোপন অর্থ, কিংবা জর্ডানের বাদশার মালিব্যুতে গোপন সম্পদ থেকে শুরু করে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের গোপন অফশোর (Offshore) কোম্পানির খবর— এসবই ছিল প্যান্ডোরা পেপারসে।
প্যান্ডোরা পেপার্সের মতে,
-
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ ও তার পরিবারের প্রায় ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ডের মতো সম্পদের বিনিয়োগ রয়েছে যুক্তরাজ্যে। আলিয়েভ প্রায় ৩১ মিলিয়ন পাউন্ড মুনাফা করেন তার লন্ডনের সম্পত্তি ক্রাউন এস্টেট (ব্রিটেনের রানীর সম্পত্তি সাম্রাজ্য) বিক্রি করে।
-
জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহর প্রায় ৭০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পদ রয়েছে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে বিভিন্ন অফসোর কোম্পানির নাম করে ‘ট্যাক্স হ্যাভেন’ বা কর স্বর্গ বানিয়েছেন। সেখানে তার ১৫টি বাড়ি আছে। এছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার মালিবুতে এবং যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে তিনটি সমুদ্র তীরবর্তী ম্যানশন রয়েছে তার, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড।
-
কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা ও তার পরিবারের ছয় সদস্যের ১১টি গোপন অফসোর কোম্পানির হিসাব, যাতে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডলারের মতো সম্পদ রয়েছে।
-
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার মন্ত্রীপরিষদের অফসোর কোম্পানি ও ট্রাস্টের মাধ্যমের গড়ে তোলা সম্পদ যার বাজার মূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলার।
-
২০১৯ নির্বাচনের পূর্বে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেন্সকি তার সম্পদ গোপন অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে পাচার করেছেন বিদেশে।
-
ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট গিয়েরমো লাসসো পানামার এক ফাউন্ডেশন থেকে তার সম্পদ সরিয়ে নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ডাকোটা রাজ্যের এক স্ট্রাস্টে। উল্লেখ্য, সেই পানামিয়ান ফাউন্ডেশন তার মাসিক অর্থ প্রদান করত তার পরিবারের সদস্যদের।
-
রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম সরাসরি প্যান্ডোরা পেপার্সে না আসলেও ২০০৩ সালে মোনাকোতে এক রাশিয়ান নারীর সমুদ্রতীরবর্তী ম্যানশন, ও সেই নারীর সাথে পুতিনের এক গোপন সন্তানের অভিযোগ উঠে এসেছে। যদিও ক্রেমলিন কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
-
কাতারের রাজপরিবার লন্ডনের বিলাসবহুল ম্যানশনের জন্য ১৮.৫ মিলিয়ন পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়েছে।
-
অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা ফ্রান্সে চেকিয়া প্রেসিডেন্টের বিলাসবহুল দুটি ভিলা, যার বাজারমূল্য ১২ মিলিয়ন পাউন্ড।
৬০ লক্ষেরও বেশি ডকুমেন্ট, প্রায় ৩০ লক্ষ ছবি, ও ১০ লক্ষাধিক ই-মেইল সম্বলিত প্যান্ডোরা পেপার্স এযাবতকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফাঁস হওয়া নথি, এবং ডেটা স্টোরেজ অর্থাৎ তথ্যগত আকার হিসেবে সর্বোচ্চ।
অফশোর কোম্পানি
অফশোর কোম্পানি বলতে নিজ দেশের অর্থ ভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করে কর ফাঁকি দেয়াকে বোঝানো হয়। তবে আইনগতভাবে তা সবসময় বেআইনী না-ও হতে পারে। নিজদেশের অধিক কর হার, কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে অনেক কোম্পানি দেশের বাইরে স্থানান্তরিত হতে পারে। বড় বড় জাহাজ কোম্পানির ক্ষেত্রে তা দেখা যায়। কিন্তু গোপন অর্থ পাচার করার জন্যও তা ব্যবহার হয়। বিশেষ করে অর্থ পাচার ও বিপুল অর্থের কর ফাঁকি দেয়ার এক আদর্শ উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অফশোর কোম্পানিগুলো।
বিভিন্ন জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মূল বিনিয়োগকারীর নাম গোপন, ও তার বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকে মুনাফা আয় অফশোর কোম্পানিগুলোর টেক্সবুক স্টাইল। বিভিন্ন দেশে মানুষের অর্থ ও সম্পদ রাখতে চাওয়ার বৈধ কারণও রয়েছে, যেমন- অপরাধমূলক হামলা থেকে সুরক্ষা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল অবস্থায় সম্পদ সুরক্ষিত রাখতে চাওয়া ইত্যাদি। এসব কারণে ধনী ও সম্পদশালী ব্যক্তিরা অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ ও সম্পদ পরিচালনাকে যথার্থ মনে করেন।
ঠিক কী পরিমাণ অর্থ অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে লুকিয়ে রাখা আছে তা বলা বাস্তবিকপক্ষে অসম্ভব। তবে ICIJ এর মতে, এর পরিমাণ আনুমানিক ৫.৬ ট্রিলিয়ন থেকে ৩২ ট্রিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এর মতে, ট্যাক্স হ্যাভেন ব্যবহারের জন্য প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোকে ৮০০ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ কর বঞ্চিত হতে হয়। ট্যাক্স হ্যাভেনের কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই। তবে সুপরিচিত কিছু গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ, সিঙ্গাপুর, ও সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলো।
অতীতে প্রকাশিত পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স বহু বিতর্কের জন্ম দিলেও এবারের প্যান্ডোরা পেপার্স তথ্য-উপাত্ত ও অভিযুক্তদের বিভিন্নতার দিক দিয়ে বিশাল। ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়ার আশংকা রয়েছে। অভিযুক্ত রাষ্ট্রনেতাদের রাজনৈতিক প্রভাব কতটুকু বজায় থাকবে তা-ও দেখার বিষয়। প্যান্ডোরা পেপার্সের গ্রহণযোগ্যতা পরিমাপে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বৈশ্বিক রাজনীতির হিসাবনিকাশ বদলে দেয়ার ক্ষমতা প্যান্ডোরা পেপার্সের আছে কিনা তা যথেষ্ট পর্যালোচনার বিষয়। এ ধরনের গুরুতর প্রতিবেদন প্রকাশ আগামী দিনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কেমন প্রভাব ফেলে তা-ও দেখার ব্যাপার।
অতীতের পানামা পেপার্স, ও প্যারাডাইস পেপার্সের চেয়ে এবারের প্যান্ডোরা পেপার্স তথ্য-উপাত্তের দিক দিয়ে যেমন বিপুল, তেমনি অভিযোগের প্রমাণাদির বিষয়ে আরো বেশি স্পষ্ট। প্যান্ডোরা পেপার্স প্রকাশিত হবার পর থেকেই অভিযুক্তরা অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অফশোর কোম্পানির মাধ্যমের বিপুল কর ফাঁকির অভিযোগে ভরপুর প্যান্ডোরা পেপার্সের বিশ্বাযোগ্যতা ঠিক কতটুকু টিকে থাকবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে ব্যাপক চাপের মুখে যে পড়তে চলেছেন অভিযুক্তরা তা বলাই যায়।