ভারতে এখন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এক নামকরণের রাজনীতিতে মেতেছে। এতদিন রাস্তাঘাট-রেলস্টেশনের নবনামকরণের পদক্ষেপ দেখা গেলেও, বর্তমানে আস্ত শহরকে নতুন নাম দিচ্ছে গেরুয়াবাহিনী। বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে যেমন এলাহাবাদের নতুন নাম হয়েছে ‘প্রয়াগরাজ’ আর ফৈজাবাদের নাম হয়েছে ‘অযোধ্যা’। এছাড়াও চেষ্টা করা হচ্ছে আগ্রার নাম অগ্রবন বা অগ্রবাল করার।
পাশাপাশি অন্যান্য নানা রাজ্যেও, এমনকি যেখানে বিজেপি ক্ষমতার ধারেকাছেও নেই (যেমন তেলাঙ্গানা) সেখানেও পদ্মবাহিনী সোৎসাহে উদ্যোগী বড় শহরের নতুন নাম দিতে! যেমন, এক বিজেপি বিধায়ক জানিয়েছেন ক্ষমতায় এলে রাজ্যের রাজধানী হায়দরাবাদের নাম দেওয়া হবে ভাগ্যনগর। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পরিচালিত একটি ছোট বিদ্যালয়ের নামের পাশে ইসলামপুর বদলে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ঈশ্বরপুর’, যা দেখে চোখ কপালে উঠেছে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে স্থানীয় সাধারণ মানুষেরও। গুজরাটের বড় শহর আহমেদাবাদের নাম বদলে কর্ণাবতী করারও আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিজেপি। আধিকারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, গত এক বছরে ভারত সরকার ২৫টি ছোট শহর ও গ্রামের নতুন নামকরণের প্রস্তাবনায় সিলমোহর দিয়েছে।
নাম বদলের এত তাড়া কেন?
প্রশ্ন উঠতে পারে, হঠাৎ এই নাম পরিবর্তনের হিড়িক কেন?
আসলে হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এই নামকরণের রাজনীতি তাদের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের প্রসারের এক নম্র প্রকল্প। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যে জায়গাগুলোর নাম পরিবর্তনের জন্য গেরুয়া দল উঠেপড়ে লেগেছে, তাদের বেশিরভাগেরই নামের মধ্যে ‘ইসলামি’ ছোঁয়া রয়েছে আর এটাই হিন্দুত্ববাদীদের আপত্তির কারণ। সরাসরি গা-জোয়ারি লড়ে দেশজুড়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ প্রতিষ্ঠা করা সহজ কাজ নয়, কারণ আপত্তি উঠবে বিভিন্ন মহল থেকে। অতএব, গোমাংস নিষিদ্ধ করার মতো নাম পরিবর্তনও এই রাজনৈতিক প্রকল্পের বাস্তবায়নে একটি উপযোগী পদক্ষেপ। আর সেটাই যোগী আদিত্যনাথরা করছেন জান লড়িয়ে দিয়ে। আর এতে পরোক্ষে সায় রয়েছে সর্বোচ্চ নেতৃত্বেরও, কারণ তারা এই প্রবণতা বন্ধ করার জন্য কোনো মন্তব্য করেননি এখনও পর্যন্ত।
বিজেপির সমর্থকদের কাছে এই রাজনীতি যে আকর্ষণীয়, তা একটি শিশুও বোঝে। এর মধ্যে দিয়ে যেমন ইতিহাসের বিরুদ্ধে একধরনের প্রতিশোধ নেওয়ার সাফল্য আছে, তেমনি এই সমস্ত বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যস্ত রাখতে পারলে তাদের নজর বড় সমস্যা থেকে ঘুরিয়েও রাখা যায়। ভারতের বিভিন্ন শহর, মফস্বল, গ্রামের নাম হিন্দু-কেন্দ্রিক করলে এদেশের মুসলমান ইতিহাসকে চিরতরে মুছে দেওয়া যাবে বলে বিজেপির অন্ধভক্তদের অনুমান। আর তাতেই হিন্দুদের শৌর্য আরও উজ্বল হবে বলে তাদের ধারণা। তবে আরও একটি কারণও বোধহয় রয়েছে এবং তা সম্পূর্ণভাবেই সংঘ পরিবারের অভ্যন্তরীণ।
কিন্তু বিজেপির এই রাজনৈতিক প্রকল্পের কয়েকটি এমন দিকও রয়েছে, যা আসলে তাদেরই স্বার্থের পরিপন্থী এবং ভণ্ডুল করতে পারে তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে।
ভারতের মানুষ বিজেপিকে মন্দির-মসজিদ বানানোর জন্যে নির্বাচিত করেনি
ক্ষমতার মোহে বুঁদ হয়ে থাকলেও বিজেপিকে এই সত্য বুঝতেই হবে যে তাদেরকে আজ ভারতের মানুষ ভোট দিয়েছে মন্দির-মসজিদ বানানোর জন্য নয়, উন্নয়নের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করার জন্য। নরেন্দ্র মোদীর গ্রহণযোগ্যতা একজন সুপ্রশাসক হিসেবে, যিনি উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে এসেছেন, দেশকে শুধু ধর্মপালনের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে বিজেপি যেটা করছে তা হলো, মন্দির-হিন্দুত্ববাদ এবং জাতীয়তাবাদের সঙ্গে কোনোভাবে উন্নয়নকে জড়িয়ে দিয়ে বৈতরণী পার করার চেষ্টা। রামের বিরাট মূর্তি তৈরি করার ঘোষণা, তার পিতা দশরথের নামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের বিশালাকার মূর্তি বানিয়ে তার মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকে দৃঢ় করার প্রয়াস ইত্যাদি আদতে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে উন্নয়নকে এক করে দেখে সাধারণ মানুষকে অবিরাম প্রলুব্ধ করার পরিকল্পনা।
প্রশ্ন হলো: বিজেপির এই মরিয়া রাজনীতি কতজন মানুষ গ্রহণ করবেন? ২০১৪ সালে পরিস্থিতি এক রকম ছিল। ২০১৯-এ প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়ার মুখোমুখি হয়ে মোদী কি এই মরিয়া হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে রণনীতি করার ঝুঁকি নেবেন? আর তাছাড়া, অতীতে নাম বদলে এবং মূর্তি বসিয়ে বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতীও এই একই ধরনের আইডেন্টিটি পলিটিক্স খেলার চেষ্টা করেছিলেন। ২০০৭ সালে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে বড় জয় পেয়ে তিনি আজকের বিজেপির মতোই একমুখী রাজনীতিতে মেতেছিলেন কিন্তু ২০১২ সালের নির্বাচনে তার এই আইডেন্টিটি পলিটিক্স কোনো উপকারেই আসেনি এবং ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। বিজেপির কি কিছু শেখা উচিত মায়াবতীর অভিজ্ঞতা থেকে এবং বোঝা উচিত যে, সাধারণ মানুষ নির্বোধ নয়?
মানুষের নামে চালালেও সংঘ পরিবার ভালোই বুঝছে যে সমর্থকদের আর বেশিদিন ভুলিয়ে রাখা যাবে না
দ্বিতীয়ত, এই মূর্তি তৈরি বা নাম বদলের রাজনীতির হিড়িক বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের মধ্যেই তৈরি হয়েছে এক অস্থিরতা এবং সেই ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুন যাতে বড় আকার ধারণ না করে, তার জন্যে এক ধরনের আপোষের কৌশল নেওয়া হচ্ছে। অযোধ্যায় রাম মন্দিরের স্বপ্ন আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা, তা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে, কারণ এর মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে আইনের প্রশ্ন।
যদি আইনসভায় বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও বিজেপি রাম মন্দিরের বাস্তবায়ন না করতে পারে, তাহলে কীভাবে আর তা হতে পারে? কট্টর দলীয় ও সংঘ সমর্থকদের চাপ যে ক্রমেই বাড়ছে, তা বুঝছেন শীর্ষ নেতারা। এই নামকরণের হিড়িক যদি সেই পরিস্থিতিকে লঘু করার জন্য করা হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চর্যের বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু এ পথে বিপদও রয়েছে যথেষ্ট। দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটার নয়, রামের মূর্তি বসিয়ে বা কোনো জায়গার নাম অযোধ্যা করলেই গেরুয়া সমর্থকরা যে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে- তেমনটা মনে করার কারণ নেই। আর তাই এত কিছু করেও শেষ পর্যন্ত যদি সংঘ পরিবারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীরও আয়ত্বের বাইরে চলে যায়, তবে তাতে বিজেপির মুখ তো পুড়বেই, উপরন্তু রাজনৈতিকভাবেও দলটি বেশ বেকায়দায় পড়বে।
দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে, স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীই এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। যদি তিনি সোজাসুজি নিজের দলের নেতা এবং সমর্থকদের এমন কট্টর অবস্থান নিতে না করেন, তবে এই প্রবণতা বন্ধ করবে কার সাধ্য? কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা মাথায় রেখে তিনি এবং দলের কাণ্ডারীরা যে চট করে কিছু বলবেন, সে আশাও বিশেষ নেই। ভারতে মধ্যপন্থী রাজনীতির যেভাবে ক্ষয় ঘটেছে, তাতে বিজেপির মধ্যেও মধ্যপন্থী অবস্থান নেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা বিশেষ কেউ দেখবে বলে মনে হয় না। আর তাতেই পোয়াবারো কট্টর হিন্দুবাদীদের।