সুপারপাওয়ার বা পরাশক্তি! বর্তমান বিশ্বে এই পরাশক্তির অলিখিত তকমাটা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। বিশ্বে ক্ষমতায়নের বিস্তারে মূল ভূমিকা সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবের। যেমন- বিশ্বব্যাপী আমেরিকার সর্বগ্রাসী প্রভাবে মূল ভিত্তি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের দীর্ঘস্থায়ী সামরিক ও কূটনৈতিক মিত্রতা। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটির শক্তিশালী অবস্থান তৈরি হয়েছে সময়ের ব্যবধানে।
সুপারপাওয়ারের দৌড়ে আমেরিকার সাথে এখন রাশিয়ার বিস্তর দূরত্ব; কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া, সমাজতন্ত্রের দুর্বল অবস্থান, অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও সামরিক প্রভাবে পিছিয়ে থাকা ইত্যাদি। বিগত দশকে চীনের বিশাল কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনা দেখে সহজেই অনুমেয়, এই মঞ্চে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে নতুন শক্তির। গোটা পৃথিবী জুড়ে চীন গত এক দশকে তৈরি করেছে তাদের বাণিজ্যের বিশাল নেটওয়ার্ক, যেখানে তারা গুরুত্ব দিয়েছে বিনিয়োগ ও অবকাঠামো খাতে। অনুদান, লোন ও বিনিয়োগের পেছনে তারা খরচ করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। উদ্দেশ্য, অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ। যদিও, সমীকরণ এত সহজ নয়। চীনের পরিকল্পনায় সম্ভাবনার পাশাপাশি ঝুঁকিও রয়েছে।
এখন পরাশক্তি হয়ে উঠতে কী দরকার? এককথায়, বন্ধু বা মিত্র। এই মিত্রতা হতে পারে সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক। আমেরিকার শক্তিশালী সামরিক মিত্র যেমন ন্যাটো। মুক্ত বাজার অর্থনীতির বাজারে চীনের পরিকল্পনা এই অর্থনীতিকে ঘিরেই। টাকায় টাকা আনে, তেমনই আর কী। তবে বিশ্ব রাজনীতির জটিল সমীকরণে টাকা শুধু টাকাই আনে না, সেই সাথে যোগ হয় আরও অতিরিক্ত সুবিধা। আর এই সুবিধার জন্যই চীন গত এক দশকে বিপুল অর্থ খরচ করেছে ১১২টি দেশের প্রায় ৬০০টি প্রকল্পে, বলতে গেলে পরাশক্তি হওয়ার দৌড়ে চীনের মূল ও সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার শুরু এখান থেকেই। এখন কীভাবে সুবিধা আদায় করে নেবে দেশটি?
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, চীন যে ১১২টি দেশের সাথে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত হয়েছে, বেশিরভাগই অবকাঠামোকেন্দ্রিক। পাওয়ার প্ল্যান্ট, স্থল বন্দর, সমুদ্র বন্দরসহ অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো সংক্রান্ত প্রজেক্টে দেশটি হয় বিনিয়োগ করেছে, না হয় অনুদান কিংবা লোন দিয়েছে। দেশটি শুধু বিনিয়োগ করেই বসে থাকেনি। অবকাঠামো নির্মাণসহ প্রযুক্তি ও প্রকৌশলে আছে তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। কারণ, এতদিনে তারা নিজেদের মাটিতে কাজ করে সঞ্চয় করেছে অভিজ্ঞতা এবং তৈরি করেছে দক্ষ মানবসম্পদ, যা এখন তারা কাজে লাগানো শুরু করছে দেশের বাইরেও। একদিকে তারা যেমন বিনিয়োগ করছে, তেমনি তারা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তাদের লোকদের কাজ করার সুযোগের পাশাপাশি তৈরি করে দিচ্ছে বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনা। যেখানেই তাদের অর্থে কাজ হচ্ছে, প্রায় সব জায়গায় কাজ করছে তাদের শ্রম শক্তি এবং সেখানেই গিয়ে হাজির হচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো। এমন না যে, চাইলেই অন্য দেশের কোম্পানিও সেখানে প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ পাচ্ছে। নির্দিষ্ট চুক্তি ও শর্তের আওতাতেই এসব কিছু হচ্ছে। সেক্ষেত্রে অবশ্য স্থানীয় কর্মসংস্থান হচ্ছে বা তৈরি হবে, এই সম্ভাবনা যতটা প্রচার হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ততটা বাস্তবে রূপ পায় না এই অভিযোগ রয়েছে।
কমপক্ষে ১৯৯টি পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পে চীনাদের অর্থায়ন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নিউক্লিয়ার, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরির প্ল্যান্টের বিপুল কর্মযজ্ঞ। এসব প্ল্যান্ট ও অবকাঠামো তৈরিতে কাজ করছে চীনা কোম্পানিগুলো এবং প্রয়োজনীয় উপকরণের বড় একটি অংশের বাজার দখল করেছে নিয়েছে তারাই। সহজলভ্য মানবসম্পদের পাশাপাশি, দক্ষ শ্রমশক্তি ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় বহির্বিশ্বে দেশটির জনপ্রিয়তাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কম্বোডিয়ার ৭টি বাঁধের সবগুলোই নিজেদের অর্থে তৈরি করে দিয়েছে চীন। কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট যেখানে বিশ্বব্যাপী ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে পরিবেশের বিপুল দূষণের জন্য, সেখানে চীনের ভূমিকা দেখলে মনে হবে তারা যেন নতুন করে এর জনপ্রিয়তা তৈরিতে কাজ করছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির জন্য চীন দিয়েছে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরকম আরও প্রায় ৬৩টি প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন রয়েছে। চীনের অর্থায়নে এসব পাওয়ার প্ল্যান্ট গোটা স্পেনের চেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণ করছে।
বিভিন্ন দেশে ৪১টি পাইপলাইন, তেল ও গ্যাসের আরও অন্যান্য অবকাঠামোতেও দেশটির বিপুল অর্থায়ন রয়েছে। মাত্রই আলোচিত সুবিধা তো রয়েছেই, তাছাড়া বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ এসব সম্পদ সংক্রান্ত বাণিজ্যে চীন তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিতে পারছে।
ব্রিজ, রাস্তা ও রেলওয়েসহ পরিবহন খাতের ২০৩টি প্রকল্পের সাথে জড়িত দেশটি। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বড় যে সুবিধা পাচ্ছে বেইজিং তা হলো, বিশাল দেশটির বিভিন্ন বন্দর দিয়ে বিশ্বজুড়ে তাদের পণ্য পরিবহনের সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যাওয়া। স্থল বন্দরের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সমুদ্র বন্দর। এখানেও পিছিয়ে নেই দেশটি। পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও শ্রীলংকার সমুদ্র বন্দরগুলো বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত সমুদ্র পথগুলোর মধ্যে অন্যতম পথগুলোর সাথে যুক্ত। মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও বাণিজ্যের জন্য এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশগুলোর বন্দরে তাই চীনা সরকারের বিপুল অর্থায়ন রয়েছে।
চীনের অর্থায়নে চলা প্রকল্পগুলোর বড় অংশই তাদের বেল্ট এন্ড রোড উদ্যোগের অন্তুর্ভুক্ত, যা মূলত দেশটির প্রতিবেশীদের ঘিরে পরিকল্পনা করা। বিভিন্ন দেশে দেশটির মোটা অংকের অর্থ ঢালা মোটেই তাদের বদান্যতা নয়। লোনের টাকা শোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে পাকিস্তান, সেখানে চীন নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য ব্যবহার করছে ঋণের ফাঁদে ফেলার কূটনীতি। বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প নিয়ে তাই নতুন করে ভাবতে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির। এই ঋণের ফাঁদে ফেলে সুবিধা আদায়ের বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে শ্রীলংকা।
এই ব্যাপারে পরে আসা যাক। দেখা যায়, প্রকল্পের মাঝপথে যদি কোনো দেশ অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে, তখন হয়তো ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠিন শর্তারোপ করা হয়। এসব কারণে দেশটি হয় ঋণ সমস্যায় আরও বেশি জর্জরিত হয়ে পড়ে, কিংবা প্রকল্পের কাজ মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায় টাকার অভাবে। চীনের এ ধরনের কূটনীতি সমালোচিত হলেও বিশ্বের পরাশক্তির হওয়ার দৌড়ে ভালো-মন্দের পরোয়া তারা করছে না।
এই যে এত প্রকল্পে অর্থ খরচ, কী লাভ হচ্ছে এতে? উত্তর যদি এখনও পরিষ্কার না হয়, তাহলে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হিসেবে রয়েছে শ্রীলংকা এবং এখানে চীনের অস্ত্র ছিল ঋণ ফাঁদ।
হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর নিয়ে শ্রীলংকার উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের জন্য দেশটি যখনই চীনের কাছে গিয়েছে, খালি হাতে ফেরেনি। ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বন্দরটি কাজও করেছে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং নামে দেশটির সরকারি মালিকানার একটি প্রতিষ্ঠান। কাজ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল, ব্যস্ত সমুদ্রপথের সাথে যুক্ত হওয়ার সত্ত্বেও বন্দরটি খুব বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে না। নিশ্চিত লোকসানের পথে বন্দরটি। যেখানে লাভ-লোকসানের সম্ভাব্যতা যাচাই করে এই বন্দরে বিনিয়োগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল শ্রীলংকার মিত্রদেশ ভারত, সেখানে এগিয়ে এসেছিল চীন। একদিকে লোকসানে ব্যর্থ সমুদ্র বন্দর, অন্যদিকে বিরাট ঋণের বোঝায় বিপর্যস্ত শ্রীলংকাকে ক্রমাগত চাপে রাখতে থাকে চীন। শেষ পর্যন্ত ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটি দেশটির কাছে ইজারা দিতে বাধ্য করে শ্রীলংকাকে। বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর বেইজিং যেসব সুবিধা পাচ্ছে, তা হলো- ভারত থেকে মাত্র ১০০ মাইল দূরের কৌশলগত অঞ্চলে নিজেদের শক্ত উপস্থিতি এবং গুরুত্বপূর্ণ এই নৌ-পথে বাণিজ্যিক ও সরব সামরিক উপস্থিতির সহজ সুযোগ। শুধুমাত্র এই একটি কৌশলে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন সামরিক উপস্থিতির ‘বৈধ’ সুযোগ তৈরি করে নিয়েছে, যা ভারতকে চাপে রাখতে তারা কাজে লাগাতে পারবে।
এক দশক ধরে চীন আফ্রিকায় সক্রিয় ছিল মূলত বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে, কিন্তু সম্প্রতি তারা ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ খ্যাত ছোট আফ্রিকান দেশ জিবুতিতে তাদের প্রথম সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। জিবুতি হলো এই মহাদেশের অন্যতম প্রবেশপথ এবং বিশ্বের ২০টি সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি। ঠিক সেখানেই চীনের এই অবস্থান এখন আমেরিকার জন্যও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে ভবিষ্যতে আফ্রিকায় আরও কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে দেশটি।
চীনের জন্য মহাদেশটি সহজ লক্ষ্য ছিল, কারণ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার কারণে পশ্চিমাদের পাশাপাশি আমেরিকাও এখানে অর্থ খরচের ব্যাপারে গা বাঁচিয়ে চলে। আর এই সুযোগ লুফে নিয়ে আফ্রিকায় নিজেদের কৌশলগত অবস্থান ধীরে ধীরে জোরালো করছে এশিয়ার দেশটি। বাণিজ্যিক সহযোগিতার পাশাপাশি চীনের সামরিক উপস্থিতি প্রমাণ করে, পরাশক্তি হওয়ার দৌড়ে চীনারা বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটির অর্থায়নে আফ্রিকার বিভিন্ন প্রকল্প, স্বার্থ ও তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তার অজুহাতে চীন সেখানে সামরিক কূটনীতি আরও বেগবান করছে, যা প্রভাব ফেলছে অস্ত্র ব্যবসাসহ আঞ্চলিক রাজনীতিতে।
নিয়ন্ত্রণের সমীকরণে শুধু বন্দরে অবস্থান নিয়ে বা সমুদ্রে যুদ্ধজাহাজ নিয়ে মহড়াই সবকিছু নয়। এখানে বড় আরেকটি ট্রাম্প কার্ড হলো অস্ত্র ব্যবসা। এখানেও চীন পিছিয়ে নেই। ভবিষ্যৎ বিশ্ববাণিজ্যে যারা আমেরিকাকে পেছনে ফেলতে চায়, তারা আফ্রিকায় অস্ত্র ব্যবসায় এর মধ্যেই ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। যুদ্ধ বিগ্রহের মহাদেশে আমেরিকা ও রাশিয়ার অস্ত্র ব্যবসার হার যখন নিম্নমুখী, তখন ২০১৩-২০১৭ সালে চীনের অস্ত্রের বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৫%!
চীন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের লক্ষ্যের দিকে, যার শুরু অবকাঠামোর নির্মাণের অর্থায়ন দিয়ে এবং শেষপর্যন্ত তারাও আমেরিকার মতো বিদেশে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি জোরালো করা শুরু করেছে বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থানে। কারণ, বাণিজ্যের নিয়মতান্ত্রিক সুবিধা আদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থানের বিকল্প নেই।