মানুষ যতটা সামাজিক জীব, তার চেয়েও অনেক বেশি রাজনৈতিক জীব। ফলে সভ্যতার যাত্রা শুরুর সাথে সাথেই তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র নামের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। হবসের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে অরাজক অবস্থা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্র।
এরপর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। রাষ্ট্র-কাঠামোতে শুরুর দিকে প্রাধান্য ছিলো নগররাষ্ট্রের। এরপর রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে সাম্রাজ্যবাদের ধারণা পোক্ত হয়, দেখা মেলে রোমান সাম্রাজ্য, মোঘল সাম্রাজ্য, মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্য, ওসমানী সাম্রাজ্যের মতো বড় বড় সাম্রাজ্যের।
আধুনিক যুগে এসে এই জায়গাটি দখল করেছে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা, জন্ম হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক রাষ্ট্রের। কাতালোনিয়া, কাশ্মীর কিংবা স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতার যে দাবি উঠছে, তা জাতিরাষ্ট্রের ধারণার ওপর ভিত্তি করেই।
ইতিহাসে রাষ্ট্রের সুদীর্ঘ পথচলায় হাজারও শাসক এসেছে, প্রশাসক এসেছে, নতুন নতুন সরকার ব্যবস্থার সাথে নাগরিকদের পরিচয় ঘটিয়েছে। মোটা দাগে শাসন ব্যবস্থার ছয়টি রূপ রাষ্ট্র-কাঠামোতে দেখা যায়। শাসনব্যবস্থার আদর্শ তিনটি রূপ হচ্ছে রাজতন্ত্র (একের শাসন, সকলের মঙ্গলের জন্য), অভিজাততন্ত্র (কয়েকজনের শাসন, সকলের মঙ্গলের জন্য) ও পলিটি (নাগরিকদের অধিকাংশের শাসন, সকলের মঙ্গলের জন্য)।
উত্থান-পতন মানব ইতিহাসেরই অংশ, তাই শাসনব্যবস্থার এই বিশুদ্ধ রূপগুলোরও পতন ঘটেছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে রাজতন্ত্র বিচ্যুত হয়েছে স্বৈরতন্ত্রে, অভিজাততন্ত্রের বিচ্যুতি ঘটে হয়েছে কতিপয়তন্ত্র আর পলিটির বিচ্যুতি ঘটে উত্থান ঘটেছে গণতন্ত্রের।
স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় আসা
শাসনব্যবস্থা যখন চূড়ান্ত এককেন্দ্রিক হয়ে যায়, একক ব্যক্তি বা গ্রুপের প্রভাব অসীম পর্যায়ে চলে যায়, কাঠামোর সকল সিদ্ধান্ত নেয় ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে, তখনই স্বৈরতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে শাসনকাঠামোতে বারে বারে এই স্বৈরতন্ত্রের দেখা মিলেছে।
আধুনিককালে এসেও শাসনব্যবস্থায় স্বৈরতন্ত্রের বিভিন্ন রূপের দেখা মিলছে। মিশরে গণতন্ত্রের আদলে দীর্ঘদিন ধরে চলছে সামরিক শাসন, চীনে রয়েছে এক দলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, রাশিয়ার পুতিন প্রতিষ্ঠা করেছেন অবতারবাদ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখনও রয়ে গেছে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র। আবার কিছু কিছু দেশে মিলছে কয়েকটির সম্মিলিত রূপ। তাত্ত্বিকভাবে এই সবগুলোই স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে পড়ে।
বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা স্বৈরতন্ত্র বোঝার জন্য ফ্রিডম হাউজ, ৪র্থ পলিটি, ডেমোক্রেসি-ডিক্টেটরশিপ ইনডেক্সেরমতো সূচকগুলো ব্যবহার করেন।
স্বৈরশাসকদের টিকে থাকা
সময়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন ঘটেছে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা পরিবর্তন হয়েছে, রাষ্ট্র নিয়ে মানুষের চিন্তারও পরিবর্তন হয়েছে। ফলে সময়ের সাথে সাথে স্বৈরশাসকের টিকে থাকার জন্যও প্রয়োজন হয়েছে নতুন নতুন রাজনৈতিক কৌশলের। গণতন্ত্রের এই যুগের স্বৈরশাসকেরাও টিকে থাকছেন দশকের পর দশক ধরে, যুগের পর যুগ ধরে শাসন করছেন দেশ। তাদের টিকে থাকার কৌশলগুলো নিয়েই এই লেখা।
নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জকারীদের সরিয়ে দেওয়া
এই যুগে সামরিক বাহিনী থেকে স্বৈরশাসকের উত্থান ঘটছে, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র আছে অনেক দেশে, কেউ কেউ গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় এসে বেছে নিচ্ছেন স্বৈরতন্ত্রের পথ। ক্ষমতায় এসে তারা প্রথমেই নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো সবাইকে কাঠামো থেকে সরিয়ে দেন; যারা স্বাধীনচেতা, তাদেরকে নির্মূল করে ফেলেন।
মধ্যপ্রাচ্যে হোসনি মোবারক, মুয়াম্মার গাদ্দাফির মতো স্বৈরশাসকেরা এই পথেই হেঁটেছেন ক্ষমতায় আসার পরে। স্বাধীনচেতা, গণতন্ত্রকামীদের উপর চালিয়েছেন ব্যাপক দমন-পীড়ন।
গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা
নাগরিকদের কার্যক্রম আর সরকারের প্রতি মনোভাবে বড় প্রভাব রাখে টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্রের মতো গণমাধ্যমগুলো। স্বৈরশাসকেরা টিকে থাকার জন্য তাই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন গণমাধ্যমগুলো, অন্তহীন হয়রানি করেন স্বাধীনচেতা সংবাদকর্মীদের। এর একটা প্রতিফলন পাওয়া যায় Press Freedom Index এর মাধ্যমে, ২০১৯ সালে Reports Without Boarders এর ১৮০টি দেশের উপর পরিচালিত সমীক্ষায় ।
স্বাধীনতার পর থেকে একদলীয় শাসনে থাকা তুর্কমেনিস্থানের অবস্থান সবার নিচে, ১৮০ তম স্থানে; একদলীয় শাসনে থাকা উত্তর কোরিয়ার অবস্থান ১৭৯ তম, এরপর আছে দুই যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ার্কির দেশ ইরিত্রিয়া, ১৭৭ অবস্থানে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত চীন। ইনডেক্সে নিচের দিকের অবস্থানে আছে সুদান, সিরিয়া, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোই।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত অর্থনৈতিকভাবে বিপুল উন্নয়ন করেছে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে কুয়েত, ব্রুনাইয়ের মতো দেশগুলোও। মাথাপিছু আয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে এসেছে কাতার। শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের সর্বোচ্চ সুবিধা পেয়েছে এই দেশগুলো, বিপরীত পৃষ্ঠ দেখেছে রাজতন্ত্রের বিচ্যুত রূপ স্বৈরতন্ত্রে শাসিত হওয়া দেশগুলো।
স্বৈরশাসকেরা সাধারণত ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণকে দরিদ্র রাখার পলিসি নেন, নিয়ন্ত্রণ করেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর একটা সার্বিক চিত্র পাওয়া যাবে হেরিটেজের বিশ্ব অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক-২০১৯ এর মাধ্যমে।
স্বাধীনতার পর থেকে উন পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা উত্তর কোরিয়া অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে আছে সবার পেছনে, ১৮০ তম স্থানে; নিকোলাস মাদুরোর স্বৈরশাসনে থাকা ভেনিজুয়েলার অবস্থান ১৭৯ তম। যথারীতি নিচে দিকের অবস্থানগুলোতে আছে স্বৈরশাসকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইরিত্রিয়া, সুদান, তুর্কমেনিস্থান, মিসরের মতো দেশগুলো।
শাস্তি-পুরস্কার নীতি
একটা সময় জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দমন-পীড়ন একনায়কদের বহুল ব্যবহৃত পথ ছিলো। সাম্প্রতিক সময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা হাঁটছেন ভিন্ন পথে। শাসকের পক্ষে থাকলে দিচ্ছেন পুরস্কার, বিভিন্ন জায়গায় দিচ্ছেন অতিরিক্ত সুবিধা। ফলে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হচ্ছে, যারা একনায়কের সমর্থক হয়ে উঠছেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিচ্ছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। বর্তমান সময়ের শাসকদের মধ্যে এই পদ্ধতিটি বহুল ব্যবহৃত।
যুদ্ধে জড়ানো বা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করা
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধিতা দমনে একনায়কেরা প্রায়ই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন বা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেন। এতে স্বৈরশাসকের সুবিধা হয় দু’টি। প্রথমত, জনগণকে তার একক নেতৃত্বের মধ্যে নিয়ে আসতে পারেন; দ্বিতীয়ত, জরুরি অবস্থার দোহাই দিয়ে দিয়ে ব্যাপক দমন পীড়ন চালাতে পারেন বিরোধীদের উপর। ডেমোক্র্যাটিক পিস থিওরি অনুযায়ী, প্রকৃতিগতভাবেই যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখান , তার কারণও এগুলো ।
উগান্ডার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। এই সামরিক শাসক ক্ষমতায় এসে একের পর এক ব্যর্থতার পরিচয় দেন, হত্যা করেন প্রায় পাঁচ লাখ নাগরিককে। এরপরও শাসনকে নির্বিঘ্ন না হওয়ায় তিনি বেছে নেন যুদ্ধের পথ, জড়িয়ে পড়েন তানজানিয়ার সাথে যুদ্ধে।
নাগরিকদের উপর নজরদারি
শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য নজরদারি আর বিভিন্ন স্তরে গোয়েন্দা নিয়োগ প্রাচীনকাল থেকেই চলছে। এর উল্লেখ রয়েছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও। বর্তমান সময়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়েছে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে প্রতিটি স্থানে সার্ভিলেন্স ক্যামেরা ব্যবহৃত হয় নাগরিকদের উপর নজরদারির কাজে, স্বৈরশাসক ব্যবহার করেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থানের পরে এই মাধ্যমেও দেশগুলোর চলছে ব্যাপক নজরদারি। ফলে জনগণের মধ্যে একটা সেলফ সেন্সরিংয়ের ব্যাপার চলে আসছে, দমন হচ্ছে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি।
নিজেকে বিকল্পহীন প্রমাণ করা
স্বৈরশাসকেরা জনগণকে তুষ্ট করতে নানা উদ্যোগ নেন, ধর্মকে ব্যবহার করেন, জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেন। অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন আর লোকদেখানো প্রকল্প দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেন জাতীয় নায়ক হিসেবে। নিজেকে নিয়ে যান অবতারের পর্যায়ে, জনগণের মধ্যে তৈরি করেন ভয়। জনগণের মধ্যে তৈরি হয় স্বৈরশাসকের বিকল্পহীন ভাবমূর্তি ।
রাশিয়ায় পুতিন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন লৌহমানব হিসেবে, সকল বিরোধীদের দমন করে তার অবস্থানকে নিয়ে গেছেন বিকল্পহীন অবস্থায়।
জনগণকে ধোঁকা দিয়ে , দারিদ্র্যতার জালে বন্দী করে , মতপ্রকাশের সুযোগকে স্তব্ধ করে দিয়ে যুগে যুগে এভাবেই টিকে থাকেন স্বৈরশাসকেরা।