প্রায় ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে আমেরিকা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারসহ আরও দুটি সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ হামলার জন্য আল কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করে। সে সময় আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ করছিল তালেবান। ওসামা বিন লাদেনকে তারা নিরাপত্তা দিয়েছিল বলে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়। পরবর্তী সময়ে সেই অভিযোগের সত্যতাও প্রমাণিত হয়। তারা বিন লাদেনকে মার্কিন বাহিনীর হাতে হস্তান্তরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
পরাশক্তির কাছে ধরা না দেবার ফল কোনোদিন সুখকর হয় না, যার ফলস্বরূপ আমেরিকা আফগানিস্তানে বিমান হামলা শুরু করে। মার্কিন মিত্র দেশগুলো এতে যোগ দেয়। দ্রুতই তালেবানদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে অবস্থান করছে। ন্যাটোর অন্যান্য দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে প্রায় ১০ হাজার সৈন্য এখনো আফগানিস্তানে অবস্থান করছে।
পর্বতঘেরা আফগানিস্তানের শতকরা ১০০ ভাগ মুসলিম সম্প্রদায় তাদের নিজেদের প্রয়োজনে জ্বলে উঠেছে বারবার। ইতিহাস জানান দেয়, দেশটি বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু কোনোদিন মাথা নত করেনি। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ অব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আফগানিস্তানে অভিযান চালালেও ব্যর্থ হন। এরপর আরবীয় বণিক সম্প্রদায় থেকে শুরু করে মাহমুদ গজনী, চেঙ্গিস খান, বাবর, সবাই কোনো না কোনো সময়ে এ অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য স্থাপন করেছেন। এমনকি ডাকাত বাচ্চা সাকাত্তের কাবুল রাজপ্রাসাদ দখলের কাহিনীও সকলের অজানা নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নও এসেছিল এই ভূমিতে। এরই ধারাবাহিকতায় আফগান মাটিতে নতুন ভূমিকায় আবির্ভূত হয় আমেরিকা ও ন্যাটো জোট। কিন্তু পরিশেষে তারাও তল্পিতল্পা গুছিয়ে আফগান মাটি ছেড়ে দেবার ঘোষণা দেয়।
কিন্তু যুগে যুগে বিশ্বশক্তি কেন আফগানিস্তানকে দখলে নিতে চেয়েছে? কেন আফগানিস্তান হয়ে উঠেছে সকলের আরাধ্য বস্তু? কারণটা হলো, এই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক অবস্থান। প্রাচীন চর্যাপদে বলা আছে, “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”। কথাটি আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে আফগানিস্তান শুধু এশিয়ারই নয়; ইউরোপ, আমেরিকা, তথা গোটা বিশ্বের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। আফগানিস্তানের উত্তরে উত্তর-পূর্ব চীন, পশ্চিমে ইরান এবং পূর্ব-দক্ষিণে পাকিস্তান অবস্থিত।
আফগানিস্তান থেকে একদিকে চীন, অন্যদিকে রাশিয়াকে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আফগানিস্তানের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারলে পরাশক্তিগুলোর নিজেদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি সহজ হয়। দেশটিতে বহু জাতির বাস রয়েছে। এদের মাঝে আছে ওয়াহাবি, পশতুন, শিয়া, হামারি, উজবেক, তাজিক, কিরঘিজ প্রভৃতি। সব গোষ্ঠীই কমবেশি সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া, খনিজ সম্পদে ভরপুর এই দেশ কোনো শক্তিই পুরোপুরি দখল করতে সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমেরিকাও প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ঘোষণা এসেছিল, ১লা মের ভেতর আমেরিকা তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ মেয়াদ আবার সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করেছেন। হয়তো দেশটির বিবাদমান পক্ষগুলোকে সমঝোতার জন্য আরও সময় দিলেন তিনি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতার দায় নিতে অনিচ্ছুক। মার্কিনীরা চলে যাওয়ার পর দেশটির গতিধারা কী হবে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় তাদের কর্মপদ্ধতি কীরকম হবে; এসবের কোনো নির্দেশনা নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান মাটি ছেড়ে দেওয়ার সময় আমেরিকা-পাকিস্তান যে ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। গোড়ার দিকে যেভাবে আফগান সমস্যা সমাধানে তারা ইচ্ছুক ছিল, শান্তি প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ছিলে, পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে তারা এখন সেটা অসম্ভব মনে করছে। ফলে ক্রমেই তালেবান তার পূর্ব অবস্থানে ফিরে যেতে শুরু করেছে। তারা সরকারি বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে।
বর্তমানে তালেবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের অনেক শহর-বন্দর নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। তালেবান নিজেদের শুধু একটা বিদ্রোহী গোষ্ঠী বলে মনে করে না, নিজেদের তারা ভাবে সরকারের দায়িত্ব নেবার অপেক্ষারত একটি দল। তারা নিজেদের ‘ইসলামিক আমিরাত অভ আফগানিস্তান’ বলে উল্লেখ করে। আফগানিস্তানের প্রধান সড়কগুলোয় বিক্ষিপ্ত চৌকিতে তালেবান সদস্যরা তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। তালেবান সদস্যরা গাড়ি থামায়, যাত্রীদের প্রশ্ন করে এবং বুঝিয়ে দেয়, এ এলাকায় কর্তৃত্ব তাদেরই। বড় বড় শহরগুলোর মূল বাজারে সরকারি বাহিনীর আধিপত্য চোখে পড়ে, কিন্তু তারা তাদের আস্তানা থেকে বের হতে পারে না।
আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অংশের চিত্র একই। সরকার শহর এবং বড় বড় শহরতলীগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু তাদের চারপাশ ঘিরে রয়েছে তালেবান যোদ্ধারা। আশপাশের বিস্তীর্ণ গ্রাম জুড়ে রয়েছে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ। আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে তালেবান গোষ্ঠী আমেরিকান জোটের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু সরকারি বাহিনীর সাথে তারা কোনোরূপ চুক্তি করেনি। তাই আমেরিকা যে আফগান মাটি থেকে পলায়ন করছে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
দীর্ঘ ১৮ বছর ৯ মাস পর আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে সরে এসেছিল। কিন্তু ইতিহাসের চরম শিক্ষা এই যে, কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে আফগানিস্তান যুদ্ধের অনেক কিছুরই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমেরিকার পাঁচ প্রেসিডেন্টের কার্যকাল ধরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। আফগানিস্তানেও একই ঘটনা ঘটেছে। জর্জ ডব্লিউ বুশের দুই মেয়াদ, বারাক ওবামার দুই মেয়াদ, এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের শেষের দিকে সেনাপ্রত্যাহারের ঘোষণা।
আমেরিকা ভিয়েতনামে আগ্রাসন চালিয়ে নগুয়েন ভন থিওর মুৎসুদ্ধি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, ঠিক যেমন আফগানিস্তানের হামিদ কারজাই সরকার। ভিয়েতনামে আমেরিকার নিক্ষিপ্ত নাপাম বোমার মাধ্যমে সাধারণ শিশুরাও মারা যাচ্ছিল। আফগানিস্তানে নাপাম বোমার ব্যবহার হয়নি, তবে ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান যুদ্ধ অঞ্চলে প্রায় ২,৪১,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ৭১,০০০ এর বেশি হলো বেসামরিক মানুষ। আমেরিকা বিংশ শতাব্দীতে এসে আবার আফগানিস্তানে ব্যর্থ হলো।
আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যেসব দেশ অতীতে আঘাত হেনেছে, তারা সবাই পরাজিত হয়েছে। ব্রিটিশ একজন ভাইসরয় বলেছিলেন, আফগানিস্তান হচ্ছে ‘বিষাক্ত পানীয়’। সাবেক সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ আফগানিস্তানকে ‘রক্তাক্ত ক্ষত’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। পরাশক্তিগুলোর আফগান ভূখণ্ডের কাছে এরকম নাস্তানাবুদ হওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই এর ভূপ্রকৃতি ও স্থানীয় মানুষের দুঃসাহসিকতাকে দায়ী করে থাকেন। দেশটির অধিকাংশ পর্বতই ১,২২০ মিটারের বেশি উঁচু। ১৯৪২ সালে কয়েক হাজার ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্য আফগানিস্তানের গহীন পাহাড়ি এলাকায় দিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় আফগান যোদ্ধারা তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে, অর্থাৎ এদেশে সকল আক্রমণকারীকেই চরম শিক্ষা পেতে হয়েছে।
আফগানিস্তানের তালেবানরা মনে করে, আমেরিকার সাথে যুদ্ধে তাদেরই জয় হয়েছে। এখন তারা একটি আধুনিক ‘ছায়া’ সরকারের কাঠামো গড়ে তুলেছে। তারা যেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, সেসব এলাকায় বিভিন্ন দৈনন্দিন সেবার দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বনেতাদের অনেকেই মনে করেন, আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার এই পলায়ন তালেবানকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। ২০০১ সাল-পরবর্তী যুদ্ধে তালেবানকে দমানো যায়নি। তালেবান যোদ্ধাদের ভাষায়,
“আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং শত্রুকে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত তরঙ্গের পর তরঙ্গ আকারে এগিয়ে যাই।”
সত্যিই তালেবান এখন আবারও পুরো আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের প্রধান নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে। সামনের দিনগুলোতে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে- তা অনেকটাই অনিশ্চিত ও অস্বচ্ছ। তবে এটাও ঠিক যে, ২০০১ সালের পর কে ভেবেছিল যে এ যুদ্ধ বিশ বছরেও শেষ হবে না?
শান্তি প্রতিষ্ঠায় তালেবান ব্যর্থ হলে প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান তাদের দায় এড়াতে পারবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন থেকে ২০০১ সালে মার্কিন হামলা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের নামের পাশে সর্বদাই পাকিস্তানের নাম চলে আসে। আফগানিস্তানের প্রতিবেশী ইরানের মাথাব্যথা ‘হাজারা’ গোষ্ঠীকে নিয়ে। অন্য তিন প্রতিবেশী উজবেকিস্তান, তাজাকিস্তান, ও কিরগিজস্তানের সাথে তালেবানের সম্পর্ক এখনো ততটা ভালো হয়নি। রাশিয়া এবং চীনও তালেবানদের পূর্বের রূপে দেখতে চায় না।
সর্বোপরি, দীর্ঘ ২০ বছরের আফগান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। এরপর কী হবে? তালেবানরা ক্ষমতায় আসবে, নাকি পশ্চিমা অস্ত্রে সজ্জিত সরকারি বাহিনী বিদ্রোহ দমন করবে? তবে এটা নিশ্চিত যে, বর্তমান সরকার তার নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না, কারণ আফগানিস্তানেবহু জাতি এবং বহু সশস্ত্র পক্ষ রয়েছে। ক্ষমতার হিস্যা সবাই চাচ্ছে। সবচেয়ে অশনি সংকেত হচ্ছে ছায়াযুদ্ধের আগমনী বার্তা। দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বিভিন্ন বিশ্বশক্তির ক্রীড়নকে পরিনত হতে পারে আফগানিস্তান। তবে আফগানিস্তান যে শান্ত হয়ে যাবে, এটা বিশ্বাস করার মতো মানুষ দেশে ও বহির্বিশ্বে খুবই বিরল। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে পেছনে ফেলে আফগানরা আবার কীভাবে উঠে দাঁড়াবে সেটাই হচ্ছে এখন বড় প্রশ্ন।