কথায় আছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কিছু নেই। নিজেদের স্বার্থে অহরহ শত্রু পরিণত হচ্ছে মিত্রে, আবার মিত্র পরিণত হচ্ছে শত্রুতে। আজকে যাদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান, কিছুদিন পর তারাই হয়তো একে অপরের চক্ষুশূল হয়ে উঠতে পারে। এমনও হতে পারে আজকে যারা একে অপরের চক্ষুশূল, কিছুদিন পর তারাই পরিণত হয়েছে বৃহত্তম মিত্রে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই সূত্রটা প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন, ব্রিটিশ ও সোভিয়েত মিত্রশক্তি জার্মান, জাপানিজ ও ইতালীয় অক্ষ শক্তিকে পরাজিত করে। এ যুদ্ধে ব্যাটল অব বার্লিনের মাধ্যমে ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধে জার্মান নাৎসিরা সোভিয়েতদের কাছে পরাজিত হয়। হিটলারসহ উচ্চপদস্থ অনেক নাৎসি সোভিয়েত রেড আর্মির হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কায় আত্মহত্যা করে। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর আগেও সোভিয়েতরা জার্মানদের শত্রু ছিল না বরং মিত্র ছিল। সোভিয়েত ও স্ট্যালিনের উস্কানিতেই জার্মানরা ইউরোপে আগ্রাসন চালানোর সাহস পায়। কিন্তু একসময় উল্টে যায় দাবার গুটি, বদলে যায় ইউরোপের রাজনৈতিক সমীকরণ। একসময়ের মিত্র থেকে শত্রুতে পরিণত হয় জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। মেতে উঠে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে।
জার্মান-সোভিয়েত শত্রু-মিত্রের ইতিহাস খুবই মজার! তারা ঘন ঘন কখনো শত্রুতে আবার কখনো মিত্রতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কেন, কখন এবং কী?
১৯১৭ সালের নভেম্বরে বলশেভিকরা বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে নেয়। পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্টরা। সেইসঙ্গে ১৯২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ট্রান্সককেশাস, বেলারুশ ও ইউক্রেনকে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করে তৈরি হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ক্রমেই পৃথিবীব্যাপী কমিউনিস্ট মতবাদের বিস্তার ঘটতে থাকে। পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্টদের এমন বিস্তারে পুঁজিবাদী পশ্চিমা দেশগুলো আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজম স্পষ্টতই পশ্চিমা ক্যাপিটালিজমের শত্রুতে পরিণত হয়। ইউরোপে সোভিয়েত আগ্রাসন থামাতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে।
শিল্পোন্নত জার্মানি শিল্পের কাঁচামালের জন্য কিছু ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রথমদিকে জার্মান ভাইমার রিপাবলিক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক ছিল না। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকগুলো বাণিজ্যিক ও পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি হয়েছে। কিন্তু ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে উগ্র নাৎসিরা ক্ষমতায় চলে আসে। প্রবল জাতীয়তাবাদী নাৎসিরা এন্টি-সেমিটিক ও এন্টি-মার্ক্সিস্ট মতবাদ গ্রহণ করে থার্ড রাইখ গঠনের পরিকল্পনা করে। সেইসঙ্গে ইউরোপে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা!
ত্রিশের দশকের মাঝামাঝিতে এসে ইউরোপে শুরু হয় জোট গঠনের খেলা। এ সময় বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টদের বিস্তার রোধে ১৯৩৬ সালে জার্মানি ও জাপান এন্টি-কমিন্টার্ন চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ইতালিও এই চুক্তিতে যুক্ত হয়। এই তিন দেশ পরবর্তীতে অক্ষশক্তি গঠন করে। ইউরোপের অন্যান্য পরাশক্তিদের হটিয়ে তারা বিশ্বের অধিপতি হওয়ার পরিকল্পনা করে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একদিকে ইঙ্গ-ফরাসি (ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) বলয়ের শত্রু অন্যদিকে থার্ড রাইখেরও শত্রু। আবার থার্ড রাইখ ও পশ্চিম ইউরোপ একে অপরের বিরোধী ছিল। অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলে জাপানের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার দ্বন্দ্ব ছিল। এ অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে অত্যন্ত কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে হয়েছে। চরম কমিউনিজম বিরোধী হিটলার তার প্রতিটি বক্তব্যেই সোভিয়েত বিরোধী কথাবার্তা বলতেন। জার্মানি যেহেতু সোভিয়েত সীমান্তের কাছাকাছি ছিল তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানিকেই তাদের অস্তিত্বের জন্য বৃহত্তম হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। এজন্য সোভিয়েত প্রশাসন ইঙ্গ-ফরাসি বলয়ের সাথে চুক্তি করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
১৯৩৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্রান্সের সাথে পারষ্পরিক সহযোগিতা চুক্তি করতে সমর্থ হয় যদিও তা খুব একটা কার্যকর ছিল না। কিন্তু চরম কমিউনিস্ট বিরোধী ব্রিটিশ প্রশাসন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কোনো ধরনের চুক্তি করতে আগ্রহী ছিল না। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য চাইছিল জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন একে অপরকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্য ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে দমন করতে জার্মানিকে লেলিয়ে দেয়।
এ সময় জার্মানি ভার্সাই চুক্তির কিছু শর্ত ভঙ্গ করলেও ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য নীরব থাকে। এমনকি তারা অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নিলেও ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য কঠোর হয়নি। উপরন্তু এই দুটি দেশ ১৯৩৮ সালে জার্মানির সাথে মিউনিখ চুক্তি স্বাক্ষর করে। মিউনিখ চুক্তি জার্মানিকে বেপরোয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে আতঙ্কিত করে তোলে। এই চুক্তির ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবার নতুন কৌশল অবলম্বন করে। তারা দৌড়ঝাঁপ করেও ইঙ্গ-ফরাসি বলয়ের সাথে চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়ে জার্মানির সাথে চুক্তি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এদিকে হিটলার ইউরোপ জয়কে সহজ করতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ইঙ্গ-ফরাসি বলয় থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
১৯৩৯ সালের এপ্রিল থেকে দুই দেশের মধ্যে সম্ভাব্য গোপন আলোচনা শুরু হতে থাকে। মে মাসে এসে স্ট্যালিন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাক্সিম লিটভিনভকে সরিয়ে ব্যাচিস্লাভ মলোটভকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। লিটভিনভ ছিলেন ইহুদি বংশোদ্ভূত এবং তিনি পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী ছিলেন। লিটভিনভকে সরিয়ে স্ট্যালিন হিটলারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। একইসঙ্গে হিটলারও তার চিরাচরিত সোভিয়েত বিরোধী বক্তব্য দেওয়া থেকে সরে আসেন। আগস্টে এসে সোভিয়েত-জার্মান সামরিক ও বাণিজ্যিক চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা গতি লাভ করে।
১৯ আগস্ট জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একইসঙ্গে কূটনৈতিক ও সামরিক চুক্তির পথ উন্মুক্ত হয়। জার্মান ও সোভিয়েত কূটনীতিকরা সামরিক চুক্তির ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। একই সময়ে ইঙ্গ-ফরাসি জোটের সাথেও সোভিয়েত ইউনিয়নের চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছিল। ইঙ্গ-ফরাসি বলয় কিছুদিন আগেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তিতে অনাগ্রহী ছিল। কিন্তু মার্চে যখন জার্মানি মিউনিখ চুক্তি ভঙ্গ করে প্রাগ দখল করে নেয় এবং পোল্যান্ডকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির সাথে জার্মানির সম্পর্ক শীতল হতে থাকে তখন ইঙ্গ-ফরাসি জোট জার্মানিকে ঠেকাতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
ইঙ্গ-ফরাসি জোট উপলব্ধি করে, যুদ্ধের সম্ভাবনায় জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা আবশ্যক। একইসঙ্গে তারা উপলব্ধি করে, জার্মান-সোভিয়েত মিত্রতা ইঙ্গ-ফরাসি জোটের জন্য বৃহত্তম হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইঙ্গ-ফরাসি বলয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পুনরায় ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে।
সে সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন চুক্তির বিষয়ে আলোচনার জন্য মস্কোতে একটি মিশন পাঠান। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করতে থাকে। কিন্তু চুক্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের দোদুল্যমানতা ও পোল্যান্ড বিষয়ক মতবিরোধের ফলে আলোচনা সফলতার মুখ দেখেনি। একদিকে ইঙ্গ-ফরাসি জোট ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আলোচনা দীর্ঘায়িত হতে থাকে অন্যদিকে জার্মান-সোভিয়েত চুক্তির সম্ভাবনা শক্তিশালী হতে থাকে।
১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট এমন এক ঘটনা ঘটে যা বিশ্বকে বিশেষ করে ইঙ্গ-ফরাসি জোটকে তাক লাগিয়ে দেয়। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। পুরো পৃথিবী যে সোভিয়েত-জার্মান যুদ্ধের আশঙ্কা করছিল তারাই কিনা অনাক্রমণ চুক্তি করে বসে! সেদিন মস্কোতে সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের উপস্থিতিতে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যাচিস্লাভ মলোটভ ও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াছিম ভন রিবেনট্রপের মধ্যে দশ বছর মেয়াদি এক ঐতিহাসিক অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদিত হয়। একে মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি বলা হয়। এই চুক্তিকে অনেকসময় হিটলার-স্ট্যালিন চুক্তি নামেও অভিহিত করা হয়।
সেদিন মূলত দুটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একটি ছিল প্রকাশ্য, অন্যটি ছিল গোপন। গোপন চুক্তিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফাঁস হয়। জার্মান-সোভিয়েত গোপন চুক্তি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বাল্টিক অঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহের (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও ফিনল্যান্ড) ক্ষেত্রে কোনো রকমের আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের প্রশ্ন দেখা দিলে লিথুয়ানিয়ার উত্তর সীমা জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমারেখা বলে গণ্য হবে। একইভাবে পোল্যান্ডের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন দেখা দিলে নারু, ভিস্টুলা ও সান নদীর তীর জার্মান-সোভিয়েত সীমান্ত হিসেবে নির্ধারিত হবে।
সেইসঙ্গে দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপের বেসারবিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়ন দাবি করলে জার্মানি তা মেনে নেয়। পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বেসারবিয়া দখল করে নেয়। এই গোপন চুক্তি অনুযায়ীই জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করার নীল নকশা করে। এর মাধ্যমে পোল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চল জার্মানি ও পূর্বাঞ্চল সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করার পরিকল্পনা করা হয়। এভাবে প্রায় সমগ্র পূর্ব ইউরোপকেই দখল করার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সোভিয়েত-জার্মান গোপন চুক্তিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট হাজির করে।
চুক্তির প্রকাশ্য শর্তানুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি একে অপরকে আক্রমণ করবে না বলে অঙ্গীকার করে। সেইসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই দুই দেশের কোনো এক দেশ যদি তৃতীয় কোনো দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে অপর দেশটি তৃতীয় দেশটিকে কোনো প্রকার সাহায্য করবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি পারষ্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য বিনিময়েরও সিদ্ধান্ত নেয়।
জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এমন কোনো জোটে যোগদান করবে না বলে সিদ্ধান্ত হয় যা সরাসরি এই দুই দেশের কোনো একটির বিরুদ্ধে যায়। সেইসঙ্গে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, ভবিষ্যতে যদি দুই দেশের মধ্যে কোনো মতবিরোধ দেখা দেয় তবে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তা মিটিয়ে ফেলবে। চুক্তির মেয়াদ দশ বছর ধার্য করা হয় এবং চুক্তি শেষ হওয়ার এক বছর পূর্বে কোনো দেশ এর একে বাতিল না করলে মেয়াদ আরো পাঁচ বছর বাড়বে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
এই চুক্তি তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে দেয়। চুক্তির মাধ্যমে জার্মানি পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত বাধা অতিক্রম করে ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে। এক সপ্তাহ পরই ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি তার প্রতিবেশী পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ইঙ্গ-ফরাসি জোট পোল্যান্ডকে রক্ষা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল, ফলে যুক্তরাজ্য জার্মানিকে সৈন্য প্রত্যাহারের আলটিমেটাম দেয় কিন্তু জার্মানি তা অগ্রাহ্য করলে দুই দিন পর ৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরই সাথে শুরু হয়ে যায় আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের। ১৭ সেপ্টেম্বর জার্মান-সোভিয়েত গোপন চুক্তি অনুযায়ী, সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পোল্যান্ড আক্রমণ করে।
সেই গোপন চুক্তি অনুযায়ীই সোভিয়েত ইউনিয়ন বাল্টিক দেশগুলোকে (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া) ‘পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি’ করতে বাধ্য করে যা উক্ত দেশগুলোতে সোভিয়েত সৈন্যের অবস্থানের বৈধতা দেয়। দেশগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সোভিয়েত সৈন্য সমাবেশ করা হয়। ফিনল্যান্ড এমন চুক্তি করতে অস্বীকার করলে ১৯৩৯ সালের নভেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে। এরপর ১৯৪০ সালের জুনে বাল্টিক অঞ্চলের এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া এবং দক্ষিণ ইউরোপে রোমানীয় অঞ্চলে বেসারবিয়া, উত্তর বুকোভিনা এবং হার্টজাকে জোর করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সংযুক্ত করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে এমন আগ্রাসন চালালেও তারা জার্মানির সাথে অক্ষ শক্তিতে যোগদান করেনি যা স্ট্যালিনের দক্ষ পররাষ্ট্র নীতির পরিচয় বহন করে। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।
সোভিয়েত-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তিটি ছিল মূলত উভয় দেশের কূটনৈতিক চাল। জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন অনাক্রমণ চুক্তি করলেও একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ থেকে তারা সম্পূর্ণভাবে সরে আসেনি। দুই দেশ বরং সময়ের প্রয়োজনে বিদ্বেষকে গোপন রেখেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি পৃথক পৃথক স্বার্থেই এমন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশই তাদের সাম্রাজ্যবাদী বাসনা পূরণের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু আদর্শিক দিক থেকে দুই মেরুতে অবস্থান করা দুই দেশ কেন এমন চুক্তি করতে আগ্রহী ছিল?
হিটলার এমন চুক্তিতে আগ্রহী হওয়ার মূল কারণ ছিল, অন্তত একটি বড় শক্তিকে (সোভিয়েত ইউনিয়ন) জার্মানির বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত রাখা। জার্মানি ছিল ইঙ্গ-ফরাসি জোট ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝখানে। ফলে যুদ্ধ বেধে গেলে জার্মানিকে একইসঙ্গে দুই দিক থেকে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। হিটলার প্রথমেই পোল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা করেন এবং যেহেতু ইঙ্গ-ফরাসি বলয় পোল্যান্ডকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাই ইঙ্গ-ফরাসি জোটের সাথে জার্মানির যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল। এমতাবস্থায় হিটলার প্রথমে ইঙ্গ-ফরাসি জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মনোনিবেশ করার কথা ভাবেন।
ইঙ্গ-ফরাসি জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পূর্ণ মনোনিবেশ ও পূর্বাঞ্চলে সোভিয়েত আক্রমণের সম্ভাবনা নাকচ করতে এবং পশ্চিম ইউরোপকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্রতা বঞ্চিত করতেই হিটলার এই চুক্তিতে আগ্রহী হন। সেইসঙ্গে শিল্পোন্নত জার্মানির যুদ্ধ ও শিল্পোৎপাদনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের কাঁচামাল তাদের প্রয়োজন ছিল। ফলে যুদ্ধকালীন কাঁচামালের যোগানকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতেই এই চুক্তিতে জার্মানি আগ্রহ দেখায়।
এছাড়া হিটলার সাময়িকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সমঝোতা করে পশ্চিম ইউরোপকে দখল করার পর সর্বশক্তি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি কিছুদিনের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে মিত্রতা দেখিয়ে জার্মান বিরোধীতা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলেন।
স্ট্যালিনের এই চুক্তির প্রতি আগ্রহী হওয়ার মূল কারণ ছিল ইঙ্গ-ফরাসি জোট থেকে জার্মানিকে বিচ্ছিন্ন রাখা। পশ্চিম ইউরোপ ও জার্মানি উভয় দেশই কমিউনিজম তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রু ছিল। তাই এই দুই শক্তি একত্রিত হলে তা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এজন্য স্ট্যালিন এই দুই শক্তিকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। প্রথমদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম ইউরোপের সাথে চুক্তি করতে দৌড়ঝাঁপ করেও চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়। ইঙ্গ-ফরাসি জোট বারবার সোভিয়েত ইউনিয়নকে উপেক্ষা করেছে। সর্বশেষ মিউনিখ চুক্তি পশ্চিম ইউরোপের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের আস্থা চুরমার করে দেয়। পরবর্তীতে যখন ইঙ্গ-ফরাসি জোট সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তিতে আগ্রহী হয় তখন যথেষ্ট বিলম্ব হয়ে গেছে।
এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় সোভিয়েত ইউনিয়ন রক্ষণাত্মক অবস্থান নেয়। জার্মানি যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছাকাছি ছিল তাই জার্মানিকে বৃহত্তম হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে সম্ভাব্য জার্মান আক্রমণকে বিলম্বিত করতেই স্ট্যালিন এই চুক্তিতে আগ্রহী হন। স্ট্যালিন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, নাৎসিবাদের সাথে কমিউনিজমের সংঘাত অনিবার্য, তাই তিনি চুক্তির মাধ্যমে সাময়িকভাবে জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করে সময় নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া হিটলার পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। ১৯৩৯ সালের আগস্টে হিটলার এক টেলিগ্রাম বার্তার মাধ্যমে স্ট্যালিনকে জানান, জার্মানি ও সোভিয়েত স্বার্থের মধ্যে প্রকৃত কোনো সংঘাত নেই। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো নিয়ে হিটলারের মনোভাবের এমন পরিবর্তন সোভিয়েত ইউনিয়নকে জার্মানির সাথে চুক্তিতে আগ্রহী করে তোলে।
শুধুমাত্র কৌশলগত কারণেই দুই দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই চুক্তির ফলে জার্মানি তার পূর্ব সীমান্তে ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তার পশ্চিম সীমান্ত সাময়িকভাবে নিরাপদ রাখে। সোভিয়েত-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তিকে অনেক ঐতিহাসিক স্ট্যালিনের জন্য বড় বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কেননা, এই চুক্তির মাধ্যমে স্ট্যালিন কমিউনিজম বিরোধী পশ্চিমা জোটকে ভাঙতে সক্ষম হন এবং জার্মানিকে ইঙ্গ-ফরাসি জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঠেলে দেন। জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের এই চুক্তি যে সাময়িক সময়ের জন্য কূটনৈতিক চাল ছিল দুই বছর যেতে না যেতেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নাৎসি-সোভিয়েত রাজনৈতিক পরম্পরা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ে এবং উভয় দেশই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির বাইশ মাসের মাথায় ১৯৪১ সালের ২২ জুন, হিটলার তার জীবনের বৃহত্তম ভুলটি করে বসেন। সেদিন জার্মানরা অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন বারবারোসা’ পরিচালনা করে। এই আক্রমণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সোভিয়েত-জার্মান মিত্রতা শত্রুতায় পরিণত হয়। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্র শক্তিতে যোগদান করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত রেড আর্মির হাতে জার্মানির পতন ঘটে।
আবারো বলতে হয় শুরুর কথাটি- আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্থায়ী শত্রু বা স্থায়ী মিত্র বলে কিছু নেই।