২০২১ সালের ২৪ এপ্রিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি জোসেফ বাইডেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তদানীন্তন ওসমানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম এশীয় রাষ্ট্র আর্মেনিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী আর্মেনীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সামরিক ও কৌশলগত মিত্র ইউরেশীয় রাষ্ট্র তুরস্ক এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত তুর্কি–মার্কিন সম্পর্কে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের মাত্রাকে আরো বৃদ্ধি করবে। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রক্ষা করার স্বার্থে বরাবরই আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। তাহলে এখন কেন যুক্তরাষ্ট্র এটিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করল?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলা ভাষায় বহু ক্ষেত্রেই ‘হত্যাকাণ্ড’ ও ‘গণহত্যা’ শব্দদ্বয়কে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ইংরেজি শব্দ ‘Genocide’ (জেনোসাইড) এবং ‘Massacre’ (ম্যাসাকার) উভয়কেই বাংলায় ‘গণহত্যা’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়। কিন্তু জেনোসাইড এবং ম্যাসাকার সমার্থক শব্দ নয়। যখন বহু সংখ্যক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়, সেই ঘটনাকে ‘ম্যাসাকার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, যখন কোনো জাতিগত, নৃগোষ্ঠীগত, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সম্প্রদায়কে পুরোপুরি নির্মূল করার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করা হয়, সেটিকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। সাধারণভাবে, জেনোসাইডের ব্যাপকতা ম্যাসাকারের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এই লেখায় জেনোসাইডের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘গণহত্যা’ শব্দটি এবং ম্যাসাকারের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘হত্যাকাণ্ড’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ‘কমিটি অফ ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রোগ্রেস’ দলীয় সরকার রাষ্ট্রটিতে বসবাসকারী সকল আর্মেনীয়কে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত করে এবং তাদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। এই হত্যাযজ্ঞে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের হিসেব অনুযায়ী, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে অন্তত ৮ থেকে ১৫ লক্ষ আর্মেনীয় নিহত হয়। জেনোসাইড বা গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী এটিকে একটি গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইতিহাসে এটি ‘আর্মেনীয় গণহত্যা’ (Armenian Genocide) হিসেবে পরিচিত।
অবশ্য তুরস্ক এই ঘটনাটিকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকার করে না। আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের বহু বছর পর পর্যন্ত তুর্কি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকে তুরস্কের ইতিহাসে আর্মেনীয়দের অস্তিত্বের কথাই স্বীকার করা হতো না। অবশ্য পরবর্তীতে তুর্কিরা স্বীকার করে নেয় যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ওসমানীয় সরকারের হাতে কিছু আর্মেনীয় নিহত হয়েছিল। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকার করতে তারা নারাজ। তাদের দাবি অনুযায়ী, এত বিরাট সংখ্যক আর্মেনীয় এই হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়নি এবং আর্মেনীয়দের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র প্রেক্ষাপটে এই হত্যাকাণ্ড ন্যায্য ছিল। একইসাথে তারা তুর্কিদের বিরুদ্ধে পাল্টা হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করার দায়ে আর্মেনীয়দের অভিযুক্ত করে।
তুরস্কের জনসাধারণের মধ্যে আর্মেনীয়বিদ্বেষী মনোভাব প্রবল এবং অনেক ক্ষেত্রে তুরস্কে কাউকে ‘আর্মেনীয়’ হিসেবে অভিহিত করাকে চরম অপমানজনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তুর্কি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কুর্দিপন্থী ‘এইচডিপি’ বাদে অন্য সকল দল আর্মেনীয় গণহত্যাকে অস্বীকার করে। তুর্কি আইন অনুযায়ী, আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা ‘তুর্কিত্ব’কে (Turkishness) অপমান করার শামিল, এবং এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আর্মেনীয় গণহত্যাকে মিথ্যা হিসেবে প্রমাণ করার জন্য তুর্কি সরকার ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে এবং তুর্কি সরকারি সমর্থনপুষ্ট পণ্ডিতরাও এই গণহত্যাকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য বিস্তৃত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
এমতাবস্থায় কোনো রাষ্ট্র আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে সেই রাষ্ট্র তুরস্কের ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়। এ ধরনের পদক্ষেপকে তুর্কি সরকার তুরস্কের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ হিসেবে বিবেচনা করে। এজন্য বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এখন পর্যন্ত মোট ৩০টি রাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে হাজার হাজার আর্মেনীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করে এবং সেসময় থেকেই ওসমানীয় সাম্রাজ্যে বসবাসকারী আর্মেনীয়দের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরোক্ষ সংযোগ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই মার্কিন মিশনারিরা ওসমানীয় আর্মেনীয়দের মধ্যে সক্রিয় ছিল, এবং এর ফলে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পর তারা খুব কাছে থেকে এই ঘটনাগুলো অবলোকন করে। তদুপরি, মার্কিন ত্রাণকর্মীরা আর্মেনীয় শরণার্থীদের সহায়তা প্রদান করে। আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নতার নীতি গ্রহণ করে এবং এর ফলে আর্মেনীয় ইস্যু তাদের নিকট গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো ও সেন্টো সামরিক জোটে যোগদান করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্রে পরিণত হয়। মার্কিনিরা তুরস্ককে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য সোভিয়েত সম্প্রসারণের পথে একটি সুদৃঢ় প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করত। ফলে স্বভাবতই সেসময় মার্কিনিরা আর্মেনীয় গণহত্যার প্রসঙ্গে উল্লেখ করা থেকে বিরত ছিল।
১৯৮১ সালের ২২ এপ্রিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান প্রথম মার্কিন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে ওসমানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক পরিচালিত হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেন। ঐদিন প্রদত্ত এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে তিনি মন্তব্য করেন যে, আর্মেনীয় গণহত্যার মতো হলোকাস্টের শিক্ষা কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু রিগ্যান আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে মার্কিন সরকার এই শব্দটির ব্যবহার থেকে বিরত থাকে।
২০০০ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী জর্জ বুশ আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর মার্কিন আইনসভা ‘কংগ্রেসে’র নিম্নকক্ষ ‘হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসে’র পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক স্থায়ী কমিটি ‘ইউনাইটেড স্টেটস হাউজ কমিটি অন ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ ২৭–২১ ভোটে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে, যেটিতে আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ এই প্রস্তাবটি সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানান। তার যুক্তি ছিল যে, এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে ন্যাটোর অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তুরস্কের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে এবং এর ফলে চলমান ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ (War on Terror) ব্যাহত হবে।
অবশ্য হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি জানান যে, রাষ্ট্রপতির বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রস্তাবটির ওপরে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে তুর্কি সরকার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান তুর্কি লবি এই প্রস্তাবটি যাতে অনুমোদন না পায়, সেজন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। তুর্কি সরকার কর্তৃক নিযুক্ত প্রাক্তন মার্কিন আইনসভা সদস্য রিচার্ড গেফার্ড এবং রবার্ট লিভিংস্টোন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের প্রচেষ্টার ফলে প্রস্তাবটির বেশ কয়েকজন পৃষ্ঠপোষক প্রস্তাবটি থেকে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। অবশেষে ২৫ অক্টোবর প্রস্তাবটির সমর্থকরা এটিকে প্রত্যাহার করে নেন।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী বারাক ওবামা নির্বাচিত হলে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন এবং মার্কিন–আর্মেনীয় সম্পর্ককে জোরদার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল আসন্ন নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী আর্মেনীয়দের ভোট লাভ করা। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর ওবামা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। তার ৮ বছরের শাসনকালে তিনি আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি এবং এমনকি এক্ষেত্রে গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার করতেও অস্বীকৃতি জানান।
২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্য অ্যাডাম শিফ এবং গাস বিলিয়ার্কিস অন্যান্য রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে মিলে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করবে, এটি অস্বীকার করাকে নিরুৎসাহিত করবে এবং জনসাধারণকে এ বিষয়ে শিক্ষিত করবে। ৯ এপ্রিল সিনেটর রবার্ট মেনেন্দেজ, রাফায়েল ক্রুজ এবং চার্লস শুমারসহ আরো ১৩ জন সিনেটর মার্কিন সিনেটে অনুরূপ একটি প্রস্তাব পেশ করেন। ২৯ অক্টোবর হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস সদস্যরা ৪০৫–১১ ভোটে আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। ১২ ডিসেম্বর সিনেট সদস্যরাও সর্বসম্মতিক্রমে অনুরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
কিন্তু তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এই প্রস্তাবগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (United States Department of State) মুখপাত্র মর্গান ওর্টেগাস জানান, এ বিষয়ে মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত রয়েছে।
২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় যে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি জোসেফ বাইডেন আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে যাচ্ছেন। পরবর্তী দিন অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল মার্কিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং ‘আর্মেনীয় গণহত্যা স্মরণ দিবস’ উপলক্ষে প্রদত্ত একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বাইডেন ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসন কর্তৃক আর্মেনীয় হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান তুর্কি–মার্কিন সম্পর্কে একটি নতুন সমীকরণের সৃষ্টি করেছে। মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্তের পশ্চাতে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা চিহ্নিত করেছেন।
প্রথমত, আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানের পশ্চাতে রাষ্ট্রপতি বাইডেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থের ভূমিকা রয়েছে। ২০২০ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিসেবে বাইডেন আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইতোপূর্বে জর্জ বুশ ও বারাক ওবামা অনুরূপ প্রতিশ্রুতি দিলেও সেগুলো রক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু বাইডেন এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী আর্মেনীয়দের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন এবং ভবিষ্যতে পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই সমর্থন তাকে আংশিকভাবে হলেও সহায়তা করবে।
উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত ১৫ লক্ষ আর্মেনীয় বা আর্মেনীয়–বংশোদ্ভূত নাগরিকের বসবাস এবং এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবাসী আর্মেনীয় সম্প্রদায়। মার্কিন আর্মেনীয় সম্প্রদায়টি বেশ সুসংগঠিত এবং যুক্তরাষ্ট্রে আর্মেনীয় লবির উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। এজন্য তাদের সমর্থনের যথেষ্ট রাজনৈতিক মূল্য রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসন ক্ষমতা লাভের পর থেকেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি মানবাধিকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে এবং এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে ‘মানবাধিকারের রক্ষক’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের যে ভাবমূর্তি ছিল, সেটিকে পুনঃনির্মাণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি তাদের ঘোষিত মানবাধিকারপন্থী অবস্থান থেকে বহুলাংশে দূরে সরে এসেছিল এবং এর পরিবর্তে একটি স্পষ্ট বিনিময়ভিত্তিক ও স্বার্থভিত্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল। বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসন এই অবস্থান থেকে সরে আসছে এবং এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদের ‘মানবাধিকারপন্থী’ ভাবমূর্তি জোরদার করার চেষ্টা করছে।
অবশ্য এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মানবাধিকারপন্থী’ অবস্থান তাদের স্বার্থ উদ্ধারেরই একটি হাতিয়ার মাত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ ধরনের ঘোষিত অবস্থান বহির্বিশ্বে মার্কিন কার্যক্রমকে একধরনের বৈধতা প্রদান করে। বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর ইয়েমেনে চলমান সৌদি–নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে এবং চীন কর্তৃক ‘জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে’র বসবাসকারী বৃহত্তর তুর্কি জাতিভুক্ত জনসাধারণের ওপর পরিচালিত নিষ্পেষণকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানও অনুরূপ একটি পদক্ষেপ, যেটি বহির্বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মানবাধিকারের রক্ষক’ ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে।
তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি শক্তিশালী আর্মেনীয় লবি রয়েছে এবং আর্মেনিয়া ও আর্মেনীয়দের স্বার্থ রক্ষার জন্য এটি অত্যন্ত সক্রিয়। ১৯৯০–এর দশকে আর্মেনীয় লবির প্রভাবে মার্কিন সরকার প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আর্মেনিয়াকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছিল যে, আর্মেনিয়া সেসময় ‘ককেশাসের ইসরায়েল’ (Israel of the Caucasus) হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিল। মার্কিন সরকার যাতে আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান করে, এজন্য সেখানকার আর্মেনীয় লবি বরাবরই প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে।
ইতোপূর্বে তুর্কি লবির প্রভাবে তাদের এই প্রচেষ্টা বেশ কয়েকবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তুর্কি–মার্কিন ভূরাজনৈতিক মতপার্থক্যের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রে তুর্কি লবির প্রভাব অন্তত আংশিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে আর্মেনীয় লবি পুনরায় মার্কিন নীতিতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে। বাইডেন কর্তৃক আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানের পশ্চাতে যে আর্মেনীয় লবির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
চতুর্থত, বাইডেন কর্তৃক আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসনের রাশিয়া ও ট্রান্সককেশিয়া সংক্রান্ত নীতির পরোক্ষ বহিঃপ্রকাশ। আর্মেনিয়া ট্রান্সককেশিয়া অঞ্চলে রাশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক মিত্র এবং রুশ–নেতৃত্বাধীন ‘সিএসটিও’ সামরিক জোট ও ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নে’র সদস্য। রুশ–মার্কিন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদঞ্চলে রুশ প্রভাব সীমিত করতে আগ্রহী। দক্ষিণ ককেশাসের তিনটি রাষ্ট্রের মধ্যে জর্জিয়া বর্তমানে তীব্র রুশবিরোধী ও পশ্চিমাপন্থী এবং আজারবাইজান নিরপেক্ষ। বর্তমানে একমাত্র আর্মেনিয়াই এ অঞ্চলে রুশ বলয়ের অন্তর্ভুক্ত এবং আর্মেনিয়া যদি রুশ বলয় থেকে বেরিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে এতদঞ্চলে রুশ প্রভাব ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে।
২০১৮ সালে একটি মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন–সমর্থিত বিপ্লব/অভ্যুত্থানে আর্মেনিয়ার রুশপন্থী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং নিকোল পাশিনিয়ানের নেতৃত্বাধীন একটি পশ্চিমাপন্থী সরকার আর্মেনিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এর ফলে আর্মেনিয়ায় রুশ প্রভাব হ্রাস পায়। আর্মেনীয় প্রচারমাধ্যমে ব্যাপক রুশবিরোধী প্রচারণা চলতে থাকে, পশ্চিমাপন্থী আর্মেনীয়রা আর্মেনিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানায় এবং সিএসটিও থেকে আর্মেনিয়াকে বের করে আনার দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু আর্মেনীয়দের ভাষ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পশ্চিমাপন্থী নীতির ‘পুরস্কার’ দেয়নি। ২০২০ সালে সংঘটিত আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আজারবাইজানের নিকট আর্মেনিয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত আর্তসাখ রাষ্ট্রের বিরাট ভূখণ্ড আজারবাইজানের হস্তগত হয়। কিন্তু এই যুদ্ধের সময় মার্কিনিরা আর্মেনিয়াকে কোনো প্রকার সহায়তা প্রদান করেনি এবং কার্যত এই যুদ্ধের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহই দেখায়নি।
এর ফলে আর্মেনিয়া পুনরায় রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয় এবং আর্মেনিয়ায় রুশ প্রভাব পুনরায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। মার্কিনিরা এটা হতে দিতে নারাজ, কিন্তু আর্মেনিয়ার ওপর প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য তাদেরকে অন্তত কোনো একটা পদক্ষেপ নিতে হতো। আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান এরকমই একটি পদক্ষেপ। আর্মেনীয় জনসাধারণের নিকট আর্মেনীয় গণহত্যার বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সুতরাং এই গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান আর্মেনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন পুনরায় বৃদ্ধি করবে এবং দেশটিতে আসন্ন নির্বাচনে পশ্চিমাপন্থীরা একটি অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।
সর্বোপরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান ক্রমবর্ধমান তুর্কি–মার্কিন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ এবং তুরস্ক কর্তৃক কৌশলগত সার্বভৌমত্ব অর্জনের প্রচেষ্টার প্রতি মার্কিনিদের প্রত্যুত্তর। বর্তমান তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান ক্ষমতা লাভের পর প্রথম পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী সম্পর্কে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৬ সালে তুরস্কে সংঘটিত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য তুরস্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা হয়। ২০১৫ সালে সিরিয়ায় তুরস্ক কর্তৃক একটি রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করার পর রাশিয়া তুরস্কের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করে এবং ২০২০ সালে সিরিয়ার ইদলিবে একটি রুশ বিমান হামলায় ৫০–১০০ জন তুর্কি সৈন্য নিহত হয়। উভয় ক্ষেত্রেই মার্কিনিরা তুরস্ককে সুদৃঢ়ভাবে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকে, যেটি তুর্কিরা নেতিবাচকভাবে দেখেছে। তদুপরি, সিরীয় কুর্দি মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘ওয়াইপিজি’র প্রতি মার্কিন সমর্থনকেও তুরস্ক নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করেছে। সিরিয়া, লিবিয়া, পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও ট্রান্সককেশাসে তুর্কিদের গৃহীত নীতি যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দনীয় নয়। তদুপরি, তুরস্ক কর্তৃক রাশিয়া, চীন ও ইরানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান গ্রহণকেও যুক্তরাষ্ট্র নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। তুরস্ক কর্তৃক রুশ–নির্মিত ‘এস–৪০০ ত্রিউম্ফ’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের প্রেক্ষাপটে মার্কিনিরা ‘এফ–৩৫’ স্টেলথ বিমান নির্মাণের অত্যন্ত লাভজনক প্রকল্প থেকে তুরস্ককে অপসারণ করেছে এবং তুর্কি ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ আন্ডারসেক্রেটারিয়েটের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
শুধু তাই নয়, এরদোয়ানের ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা এবং তুর্কি সরকার কর্তৃক সাংবাদিক, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপরে দমনপীড়ন চালানোকেও যুক্তরাষ্ট্র নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। তাছাড়া সম্প্রতি বাইডেন রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘খুনি’ হিসেবে অভিহিত করার পর এরদোয়ান বাইডেনের সমালোচনা করেছেন এবং এটিকেও মার্কিনিরা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।
উল্লেখ্য, নির্বাচিত হওয়ার পূর্বে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন এরদোয়ানকে ‘স্বৈরশাসক’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ক্ষমতা লাভের পর বাইডেন–হ্যারিস প্রশাসন লিবিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এবং উত্তর সিরিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে, যেটি তুর্কিদের শত্রু সিরীয় কুর্দিদের জন্য লাভজনক। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন সরাসরি মন্তব্য করেছেন যে, তুরস্ক ঠিক মিত্ররাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে না। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান এই প্রক্রিয়ারই যৌক্তিক পরিবর্ধন।
অবশ্য এই পদক্ষেপটি মূলত প্রতীকী এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর কোনো ফলাফল পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে একটি সতর্কবার্তা প্রদান করছে যে, তুরস্ক যদি মার্কিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে চায়, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে বহুক্ষেত্রে চাপে ফেলতে সক্ষম, এবং তুরস্ক যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকতে হবে। এটি অনেকটা প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের সেই বিখ্যাত উক্তিটিরই প্রতিফলন, ‘হয় তোমরা আমাদের সাথে, নয়ত আমাদের বিরুদ্ধে’ (You are either with us, or against us)।
সামগ্রিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান যতটা না মানবাধিকার সংক্রান্ত, তারচেয়ে অনেক বেশি করে ভূরাজনীতি এবং মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর্মেনীয় গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে দেখিয়ে দিয়েছে, প্রয়োজনের তারা তুরস্কের সকল স্পর্শকাতরতা ও সংবেদনশীলতাকে উপেক্ষা করতে প্রস্তুত। একই সঙ্গে এই পদক্ষেপ সাম্প্রতিক যুদ্ধে আর্মেনিয়ার প্রতি মার্কিন নির্লিপ্ততার জন্য আর্মেনিয়ার প্রতি একটি ‘ক্ষতিপূরণ’ স্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের পর এখন তুর্কি এবং আর্মেনীয় ভূরাজনীতি কোনদিকে মোড় নেয়, সেটি দেখার বিষয়।