সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক মহলে একটা বিতর্ক চলছে ইতালিয়ান দার্শনিক জর্জিও আগামবেন ও ফরাসি দার্শনিক জাঁ-লুক ন্যান্সির পরস্পরবিরোধী দুটি আর্টিকেল নিয়ে। আগামবেন ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইতালীয় প্রকাশনা কুয়োলাইবেটে ‘দ্য ইনভেনশন অভ অ্যান এপিডেমিক’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।
আমরা সাধারণত জানি, রাষ্ট্র তার চরম সংকটময় মুহূর্তে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু আগামবেন দেখিয়েছেন, জরুরি অবস্থা এখন আর ‘স্টেট অভ এক্সসেপশন’ তথা নিয়মের ‘ব্যতিক্রম’ নয়, সদা সর্বদা জরুরি অবস্থাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে শাসকশ্রেণী এখন যেভাবে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ ও সার্বক্ষনিক নজরদারি করছে ঠিক তেমনি ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা ছাড়াই প্রতিনিয়ত শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে একই কাজ করে।
“Governments are nothing more than grim executioners, and taking it out on them seems more like a diversionary manoeuvre than a political reflection.”
অর্থাৎ,
“সরকার শুধুমাত্র বাস্তবায়নকারী ছাড়া আর কিছুই নয়, এবং তাদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়ার অর্থ রাজনৈতিক কৌশলের চাইতেও বিভিন্ন কৌশলের দিকে নির্দেশ করে।”
অপরদিকে ফরাসি দার্শনিক জাঁ-লুক ন্যান্সি ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইতালীয় জার্নাল অ্যান্টিনমিতে ‘ভাইরাল এক্সেপশন’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন জর্জিও আগামবেনকে সমালোচনা করে। তিনি বলেন,
“জর্জিও আগামবেন আমার পুরোনো বন্ধু। তাকে এটা বুঝতে হবে, সাধারণ ফ্লু আর করোনাভাইরাস- দুটো এক নয়। সাধারণ ফ্লুর ভ্যাকসিন আছে এবং তাতে অল্প সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারায়। কিন্তু, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে রয়েছে উচ্চ মৃত্যুহার। জর্জিও বলছেন, এই সংকটময় মুহূর্তে সরকার নাকি অজুহাত তৈরি করে নিজে টিকে থাকার ফায়দা আঁকছে এবং ‘নিয়মের ব্যতিক্রম’ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু, তিনি এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোও এই মহামারি মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে এবং গোটা সভ্যতাই এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। সভ্যতার এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের ভুল জায়গায় (সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর উপর) দৃষ্টিপাত করা উচিত হবে না।”
‘স্টেট অভ এক্সপেশন’ শিরোনামে জর্জিও আগামবেন ২০০৭ সালের দিকে একটি বইও লিখেছেন। মোটাদাগে এই প্রত্যয়টি দিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন, আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষের কিছু অধিকার থাকে, যা রাষ্ট্র আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়েও খর্ব করতে পারে না। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে সরকার সাংবিধানিকভাবেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, যেখানে এসব অধিকার বাতিল করা হয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেখা যায়, সরকার সবসময়ই একধরনের অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি রাখে এবং মানুষের অধিকার খর্ব করে এবং প্রচার করা হয় যে, মানুষের ভালোর জন্যই এ কাজ করা হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, এর মাধ্যমে সরকার নাগরিকদের ব্যক্তিজীবনে হস্তক্ষেপ করে, তার বিরোধী মতাবলম্বীদের দমন করে, তাদের অধিকার কেড়ে নেয়। করোনা মহামারির সময়েও আমরা একই বিষয় দেখতে পাচ্ছি, যেখানে এমনকি আমাদের চলাফেরাকেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, কীভাবে আমরা আমাদের সামাজিক জীবন কাটাব তা-ও বলে দিচ্ছে ‘উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’। এমনকি আনুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থা না থাকলেও বা তার ঘোষণা উঠে গেলেও আমাদের জীবন সেরকম এক ব্যতিক্রমী অবস্থার মধ্যে দিয়েই নিয়তই যাচ্ছে।
আগামবেনের আরো একটি বিখ্যাত ধারণা রয়েছে যা ‘নেকেড লাইফ’ বা ‘নগ্ন জীবন’ হিসেবে পরিচিত। এই ধারণাটি তার ‘হোমো সাকের’ বইয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। যেখানে মানুষের জীবন অনেকটা বিকিয়ে দেবার মতোই, সরাসরি হত্যা করা না হলেও তাকে অধিকারহীন এবং নিতান্ত জৈবিক সত্ত্বার জীবনযাপন করতে হচ্ছে, যেখানে শুধু বেঁচে থাকাটাই আসল। এই নগ্ন জীবন আসলে রোমান হোমো সাকেরেরই একটি সেক্যুলার আদল। ড্যানিশ লেখক লারস ওটস্মান একে একধরনের জৈবিক রাজনীতি বা বায়োপলিটিক্স বলেও আখ্যা দিচ্ছেন। এখানে আগামবেন বলতে চাচ্ছেন, করোনা মহামারির কারণে ইতালিতে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মানুষের জীবন এমন অবস্থাতেই রূপান্তরিত হয়েছে।
বিগত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সারা বিশ্ব জুড়ে কোয়ারেন্টিন, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন এবং সরকারি মনিটরিং- এই পলিসিগুলো বিদ্যমান, এবং এসব কতদিন পর্যন্ত চলতে থাকবে, আমরা কেউই বলতে পারছি না। এই দীর্ঘ সময় ধরে এসব বিদ্যমান থাকলে জনগণের মধ্যে একটা মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আসতে পারে, যা মানুষকে সরকার কর্তৃক প্রণীত যেকোনো আইন বা পলিসিকে গ্রহণ করতে সহজলভ্য করে তুলতে পারে। এমনকি যা করোনাউত্তর পরিস্থিতিতে নাগরিক ও তাদের স্বাধীনতার উপর সরকারের অস্বাভাবিক ক্ষমতা চর্চার পাটাতন তৈরি করতেও পারে।
ফলে রাষ্ট্রে একধরনের সামরিকায়ন ঘটেছে এবং সামরিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য সংকট মোকাবেলায় সরকার ও গণমাধ্যমগুলো যা করছে, তা অনেক বেশি অতিরঞ্জিত। মহামারির নামে, জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষার বাহানা দিয়ে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার ও কৌশলগুলো আরও নিখুঁত হবে এখন। সেজন্যই আতঙ্ক বা প্যানিক তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তিকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলার মধ্যে দিয়ে এমন একটি অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে সেটা আর ব্যক্তির পর্যায়ে না থেকে সামষ্টিক বা সামাজিক আতঙ্কে পরিণত হয়। আর সে আতঙ্কের ওপর বসে পুলিশ, মিলিটারি, বিচার বিভাগ ও দমন-পীড়ন ব্যবস্থাও আরও জোরদার হবে। আধুনিক কালের শাসনের ধরনই হচ্ছে মানুষকে নগ্ন জীবনে পর্যবসিত করা।
সারা বিশ্ব যখন মিল্টন ফ্রিডম্যানের মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও জন মেইনার্ড কেইনেসের সংশোধনবাদী বা হস্তক্ষেপবাদী অর্থনীতির যোজন দ্যোতনার মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে, ঋণায়নের সুসময়ে, প্রযুক্তিগত সফলতার ধারাবাহিকতায়, এমনকি বিজ্ঞান যখন গ্রহান্তরের কথাও ভাবছে, তখনই এই নভেল করোনাভাইরাস এসে প্রশ্ন তুলেছে নব্য উদারবাদ নিয়ে, স্বাস্থ্যখাতের সফলতা নিয়ে, বাজার ব্যবস্থায় অ্যাডাম স্মিথের অদৃশ্য হাত নিয়ে এবং দেখিয়ে দিয়েছে, নিউক্লিয়ার অস্ত্র নয়, বরং জীবাণুই হবে আগামী বিশ্বের অদৃশ্য শত্রু।
এখন একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, আগামবেন যেহেতু বলছেন বর্তমানে স্বাস্থ্য সংকট সামাল দিতে সরকার স্থানীয়রা নাকি বাড়াবাড়ি করছেন কোয়ারেন্টিন, লকডাউন, নজরদারি এসব নিয়ে, তাহলে আমরা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আর কী-ই বা করতে পারি? আমরা কি মহামারি নিয়ন্ত্রণ করব না?
দার্শনিক হিসাবে জর্জিও আগামবেনের কাজ চিকিৎসাস্বাস্থ্যের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা নয়, বরং এই করোনাউত্তর সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে যে পরিবর্তনটা আসবে, তা দেখিয়ে দেওয়া। করোনাউত্তর সময়ে সারা বিশ্ব যে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়বে, তা সমসাময়িক অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করেই নিচ্ছেন। এ অর্থমন্দায় শাসকশ্রেণীকে আন্দোলন, বিপ্লব, বিদ্রোহের যে উৎপাদন হবে, সেগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। জনগণও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করবে।
তাই ভবিষ্যতে বিশ্বের মানবসম্প্রদায় নগ্ন জীবনধারী হয়ে একটা বৈষম্যমূলক-একচেটিয়া-নিপীড়নমূলক-আরোপিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রে বেঁচে থাকতে চায় কি না, তা হবে একটি সঙ্গত ও সময়োপযোগী রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্ন।