প্রায় দেড় বছর আগে নির্বাচনকে এগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। বলা হচ্ছিল, ক্রমেই ঘনীভূত হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং সিরিয়া সমস্যা বা কুর্দিশ বিপ্লবীদের মোকাবেলার প্রশ্নে তিনি এবার কোণঠাসা হবেনই হবেন। কিন্তু গত ২৪ জুন সে সমস্ত হিসেব উল্টে দিয়ে ফের ক্ষমতার ব্যালট জিতলেন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এবং শুধু তা-ই নয়, তার এই নতুন মেয়াদে তুরস্কের রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হতে চলেছে আরও কার্যনির্বাহী ক্ষমতা, যার অর্থ তুরস্কের এই ৬৪ বছর বয়সী রাষ্ট্রনেতা অদূর ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। বিরোধীরা আতঙ্কিত হয়ে বলছেন, এক প্রবল একনায়কতন্ত্র এবারে গিলে খাবে তুরস্কের গণতন্ত্রকে।
এরদোয়ানের প্রাপ্ত ভোট যথেষ্ঠ একচেটিয়া (৫২.৫৯ শতাংশ) হলেও তার জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) প্রাপ্ত ভোট এবং আসনের সংখ্যা এবারে কমেছে এবং তাকে ভরসা করতে হবে তার পিপলস এলায়েন্স-এর জোটসঙ্গী ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি বা এমএইচপির উপরে। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রের জোটধর্মের রীতিনীতির জন্য বিশেষ প্রভাব এরদোয়ানের ব্যক্তিগত শাসনের উপরে পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ, ২০১৭-র গণভোটের মাধ্যমে এখন তুরস্কের রাষ্ট্রপতির হাতেই একচেটিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিবর্গের গুরুত্ব হ্রাস পেতে চলেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এরদোয়ানরা জেতেন কীভাবে?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সামনে এমন নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এরদোয়ান ব্যক্তিগত পরীক্ষায় এত ভালোভাবে পাশ করলেন কীভাবে? তুরস্কের লিরার মূল্য যেখানে হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ; এরদোয়ানের শাসন প্রায়ই ‘অগণতান্ত্রিক’ বলে আখ্যা পেয়েছে; একদা উদারবাদী দেশ হিসেবে পরিচিত তুরস্কে বাকস্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে- সেখানে এরদোয়ানের এই জয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
যদিও এবারের নির্বাচনে তুরস্কের কিছু বিরোধীপক্ষ অপেক্ষাকৃত ভালো ফল করেছে, কিন্তু সার্বিকভাবে তারা এরদোয়ানকে পরাস্ত করতে পারেনি। এর জন্যে এরদোয়ানের সুচিন্তিত নির্বাচনী কৌশল এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগানোর সুবিধা বা বিরোধীপক্ষের ছন্নছাড়া অবস্থা তো ছিলই, আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রনেতা হিসেবে এরদোয়ানের গ্রহণযোগ্যতা।
হ্যাঁ, এটিই সবচেয়ে বড় কারণ। আজকের পৃথিবীতে নানা দেশেই- তা সে গণতান্ত্রিক হোক বা আধা-গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক- এই প্রবণতাটি বেশ প্রকট এবং তুরস্ক তার অন্যথা নয়। এ বছরের শুরুতেই আমরা দেখেছি চীনে সেখানকার রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংকে জীবনভরের রাষ্ট্রপতি করে দেওয়া হয়েছে। তারপর রাশিয়াতেও ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি তার চতুর্থ মেয়াদটি জিতলেন। এছাড়া ফিলিপাইনে রড্রিগো দুতার্তে, ভারতে নরেন্দ্র মোদী, হাঙ্গেরিতে ভিক্টর অর্বান এমনকি গণতন্ত্রের পীঠস্থান হিসাবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ডোনাল্ড ট্রাম্প একইরকম প্রবণতার সাক্ষী। এই সমস্ত দেশগুলোর প্রতিটির ইতিহাস-রাজনীতি আলাদা, তবুও তাদের রাজনৈতিক গতিধারা মোটামুটি একই খাতে বইছে কেন?
যুগটা আরও শক্তিশালী রাষ্ট্রের; আর তা নাগরিকের চাহিদা মেনেই
এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রশক্তি চলছে এক বড় নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে। বিশ্বায়নের এই দুনিয়ায় অর্থনৈতিক ডামাডোলের চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই, পাশাপাশি সন্ত্রাস বা শরণার্থী সমস্যা নিয়েও নিরাপত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্রকে এখন বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ঐতিহ্যগতভাবে রাষ্ট্রকে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতো, সেসবের পাশাপাশি এখন উঠে এসেছে আরও নতুন সমস্যা, আর এই সমস্যার মোকাবেলায় রাষ্ট্রকে আরও কঠিন এবং কঠোর হতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই।
কারণ, রাষ্ট্র যদি সন্ত্রাস বা অর্থনৈতিক মন্দার মতো চ্যালেঞ্জগুলোর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের প্রজাদের রক্ষা না করতে পারে, তবে তার নিজের ভিতটাই নড়ে যেতে পারে গণআক্রোশের সামনে। তাই আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বায়িত দুনিয়ায় রাষ্ট্রের ভূমিকা বদলে গিয়েছে ভাবা হলেও, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, তা আরও শক্ত ভূমিকা পালন করছে বা বলা চলে তার এক ধরনের চরম রূপ আমরা লক্ষ্য করছি।
শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রয়োজন শক্তিশালী মুখ এবং মতাদর্শ
এখন রাষ্ট্রের এই চরম রূপকে কার্যকরী করতে হলে দুটি জিনিসের প্রয়োজন। এক, একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব আর দুই একটি, তেমনই শক্তিশালী মতাদর্শ। এরদোয়ান, পুতিন, শি, মোদী, দুতার্তে এবং ট্রাম্প প্রমুখরা সেই শক্তিশালী নেতৃত্ব। এই নেতারা যে ভক্তিভরে রাজধর্ম পালন করছেন প্রতি মুহূর্তে তা কিন্তু নয়; অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে সুশাসনের নামে তারা মানবাধিকারকে খণ্ডন করছেন, কিন্তু তবুও তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে না বিশেষ।
এর কারণ, এই নেতারা নানা রকম ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’-এর কৌশলে তাদের নিজ নিজ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে তাদের পাশে পেয়ে গেছেন এবং হাজার কারণ থাকা সত্ত্বেও এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের সহজে কাছছাড়া করতে রাজি নয়।
জনপ্রিয় এই নেতারা প্রয়োগ করছেন জাতীয়তাবাদী আফিম
কেন রাজি নয়? এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে মতাদর্শের প্রশ্নটি। এই নেতারা জানেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আনুগত্য দীর্ঘ সময়ের জন্যে জিইয়ে রাখতে গেলে প্রয়োজন এক বিশেষ আফিম, আর তার নাম হলো ‘জাতীয়তাবাদ’ যা কখনও-সখনও অতি-জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আজকের দিনে মতাদর্শের কথা উঠলে সাম্য বা সমাজবাদের প্রসঙ্গ আসে না; জনপ্রিয়তাবাদী বা পপুলিস্ট নেতারা, যারা এখন পৃথিবীর সর্বপ্রান্তেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের কাছে অত কঠিন বিষয়বস্তু অধরা। তার বদলে তারা আশ্রয় নেন সস্তা, অগভীর, নেতিবাচক কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রচণ্ড লাভজনক মতাদর্শ ‘জাতীয়তাবাদ’কে।
এ এক এমন জাদুছড়ি, যা কখনোই ব্যবহারকারীকে নিরাশ করবে না কারণ, মানুষের কাছে দেশ-জাতি-জমি ইত্যাদির আবেদন চিরকালীন। গরিব-ধনী-ধর্মীয়-অধর্মীয়-উচ্চজাত-নিম্নজাত-সাদা-কালো নির্বিশেষে সবার কাছেই বিক্রি করা যায় জাতীয়তাবাদের মোড়ানো যেকোনো পণ্য। কোনো বিরোধীরও ক্ষমতা নেই এই ব্রহ্মাস্ত্রের মোকাবেলা করার, কারণ, এখন জাতীয়তাবাদী-বিরোধী অবস্থান নেওয়া মানেই দেশদ্রোহী প্রতিপন্ন হওয়া। কে আর সেই ঝুঁকি নিতে যায়?
আর এই অমরত্বের ঔষধ পান করে এই জনপ্রিয়তাবাদী নেতারা চালিয়ে যান তাদের রাজপাট। এমন নয় যে এই নেতাদের কেউ কোনোকালে ভালো কিছু করেননি, কিন্তু তারা আসল কাজটি- অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী জিগির তোলা- এত সুচারুভাবে করে ফেলেন যে, তাদের ক্ষমতা থেকে সরানো হয়ে ওঠে এক অতীব দুরূহ কাজ।
‘সোনালী অতীতের’ আবেদন আরও কার্যকরী করে জাতীয়তাবাদী জিগিরকে
এরদোয়ান, মোদী, শি, পুতিন, ট্রাম্পরা তাদের এই ‘ভান্টেজ পয়েন্ট’ বা অনুকূল অবস্থানকে আরও পোক্ত করেন ইতিহাসের আশ্রয় নিয়ে। বিশ্বায়নের যুগে নানাদিক থেকে প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যখন রাষ্ট্র ও তার সদস্য নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তখন এই নেতৃত্ব স্মরণ করে ‘সোনালী অতীত’কে- অর্থাৎ বিগত যে সময়ে তাদের দেশ ‘অনেক বেশি ভালো ছিল’ তাকে। জনমানসে এক অনুরূপ ছাপ ফেলার ব্যাপারে এই কৌশলটির কোনো বিকল্প নেই।
দিন দিন মানুষের আর্থ-সামাজিক অস্তিত্ব যখন আরও কাঠিন্যের সম্মুখীন হতে থাকে এবং নেতৃত্ব বোঝে যে, এই সমস্যার থেকে সহজে নিস্তার পাওয়ার পথ বের করা স্বয়ং তাদের পক্ষেও দুষ্কর, তখনই তারা শরণাপন্ন হয় সেই ‘সোনালী অতীতের’।
এতে একদিকে যেমন জনগণের নজর আজকের বাস্তবিক সমস্যা থেকে ঘুরিয়ে দেওয়া যেতে পারে, তেমনই তাদের সামনে প্রতিপন্ন করা যেতে পারে নিজেদের শিকড়ের প্রতি প্রেম। এরদোয়ানের অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি ভক্তিপ্রদর্শন বা মোদীর বিজেপির হিন্দুধর্মের সোনালী দিনগুলিতে ফিরে যাওয়ার সাধনা বা ট্রাম্পের ‘আমেরিকাকে ফের মহান’ বানানোর শপথ বা পুতিন এবং শি-র নিজ নিজ স্বদেশকে জগৎ সভায় শ্রেষ্ট আসনে ফের প্রতিষ্ঠিত করার ভীষণ ব্রত- এসবই সেই একই ফর্মুলায় তৈরি চিন্তাভাবনা।
অনন্যোপায় নাগরিকের কাছে শক্তিশালী রাষ্ট্রই ভরসা
সাধারণ মানুষের কাছে এই শপথগুলো মন্ত্রের মতো কাজ করে, কারণ, বিশ্বায়ন, সন্ত্রাস বা শরণার্থী ইত্যাদি নানা কারণে বিপর্যস্ত তাদের কাছে রাষ্ট্রই শেষ ভরসা এবং তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে সেই রাষ্ট্র দেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখার কাজে ব্রতী হলে নাগরিকদের আর কী চাই? পপুলিস্ট নেতৃত্বও এই খেলা ধরে ফেলে আজ রাষ্ট্রের হাত আরও শক্ত করার একটি ছুতো পেয়ে গিয়েছে, যাতে তাদের নিজেদের অন্তহীন ক্ষমতায়নের খেলায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। এক কথায়, এ এক ছিমছাম রাজনৈতিক চাহিদা-সরবরাহের চিত্রনাট্য, যা মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে দিনের পর দিন। সাধারণ মানুষ, তা তারা গণতন্ত্রের নাগরিক হলেও, কোনো বিকল্পকে সুযোগ দিয়ে অনিশ্চয়তা চায় না। কারণ তারা মনে করে, এই একনায়কের ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই তারা এক সুদৃঢ় নেতৃত্বকে পাশে পাবে আর দেশ ও সমাজ সুরক্ষিত থাকবে।
এরদোয়ান বা শি জিনপিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায়নের ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ উঠছে বা উঠবে, সেগুলো অচিরেই তাদের বিরোধীদের মতোই সংখ্যাগরিষ্ঠের জয়ধ্বনির আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে। ‘বৃহত্তর স্বার্থের’ কথা বলে চুপ করিয়ে দেওয়া হবে মানব স্বার্থকে। সন্ত্রাস বা শরণার্থী সমস্যাকে রাষ্ট্র বিপদ হিসেবে দেখলেও আদতে সেই বিপদগুলো রাষ্ট্রের হাতকেই শক্তিশালী করছে, জনপ্রিয়তাবাদী নেতৃত্বের মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে এটাই দস্তুর। আর আপাতত চোখ বুজে এই প্রবণতাকেই লক্ষ্য করে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
Featured Image Source: Foreign Policy