মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ আর ম্যাকমাস্টার সম্প্রতি ‘দ্য আটলান্টিক’ এর ওয়েবসাইটে চীনা আধিপত্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য মোকাবেলার উপায় নিয়ে লিখেছেন। চীনের ইতিহাসের বিভিন্ন দিকও উঠে এসেছে এই লেখায়। লেখাটি মূলত তার নতুন বই ‘ব্যাটলগ্রাউন্ডস : দ্য ফাইট টু ডিফেন্ড দ্য ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ থেকে নেয়া হয়েছে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করা হলো। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন তিনি যেহেতু আমেরিকান, তার বক্তব্য আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তুলে ধরেছেন। তাই তার বক্তব্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাঠকদের কাছে বায়াসড মনে হতে পারে।
১. নিষিদ্ধ নগরী
২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান এয়ার ফোর্স ওয়ান বেইজিংয়ে অবতরণ করে। এর মাধ্যমে চীনের প্রেসিডেন্ট ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান শি জিনপিংয়ের আমন্ত্রণে মার্কিন প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় সফরের সূচনা হয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে আমার কাজ করার প্রথম দিন থেকেই চীন ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার উত্তরসূরির জন্য তাৎক্ষণিক সবচেয়ে বড় সঙ্কট হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক বোমা কর্মসূচিকে। তবে বিশ্ব সম্পর্কে চীনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হওয়ার কারণে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ধরন ও ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে দেং জিয়াওপিংয়ের শাসনামলে চীনের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক নিয়ে ইতিবাচক ধারণা করা হয়। চীনকে বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। মনে করা হয় তারা নিয়ম মেনে চলবে, বাজার খুলে দেবে এবং অর্থনীতিকে বেসরকারীকরণ করবে। সমৃদ্ধিশালী দেশ হওয়ার সাথে সাথে চীন সরকার জনগণের অধিকারকে সম্মান দেখাবে এবং রাজনৈতিকভাবে উদারতার পরিচয় দেবে। কিন্তু এসব ধারণা এখন ভুল প্রমাণিত হচ্ছে।
চীন এখন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দেশটির নেতারা একটি একনায়কতান্ত্রিক বদ্ধ শাসনব্যবস্থার মডেল তৈরি করেছে, যা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা ও মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে প্রচার করছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি শুধু দেশটির অভ্যন্তরেই ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী একনায়কতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করছে না। এই মডেলটি তারা বাইরের দেশগুলোতেও প্রচার করছে। ফলে নতুন বিশ্বব্যবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, যা বিশ্বকে আরও পরাধীন ও নিরাপত্তাহীন করে তুলছে। দক্ষিণ চীন সাগরে মানবসৃষ্ট দ্বীপগুলোতে চীন সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে। তাইওয়ানের নিকটে এবং পূর্ব চীন সাগরেও সামরিক আগ্রাসন বজায় রাখছে তারা। এসব কর্মকাণ্ড চীনের প্রভাব বিস্তারের ব্যাকুলতাকেই নির্দেশ করে। তবে সামরিকায়নের পাশাপাশি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অর্থনৈতিক কৌশলও যুক্তরাষ্ট্র ও এর সমমনা দেশগুলোর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস গবেষক ও চীন বিষয়ক গবেষণার আমেরিকান পথিকৃৎ জন কিং ফেয়ারব্যাংক ১৯৪৮ সালে চীনা নেতাদের কর্মকাণ্ডের সাথে ইতিহাসের সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তার মতে চীনা নেতাদের নীতিমালা ও কর্মপন্থা বোঝার জন্য ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং এটিই অপরিহার্য। আমাদের রাষ্ট্রীয় সফরেও চীনা নেতাদের মধ্যে ইতিহাস প্রবণতা দেখতে পাই। শি জিনপিং এবং তার উপদেষ্টারা তাদের অবস্থান বোঝানোর জন্য ইতিহাসের ওপর খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। একইসাথে অন্যান্য প্রসঙ্গগুলো এড়িয়ে গিয়েছেন।
আমেরিকান প্রতিনিধিদল তাদের প্রথম ইতিহাস শিক্ষা লাভ করে ‘নিষিদ্ধ নগরীতে’ ভ্রমণ করে, যা ছিল চীনা সম্রাটদের পাঁচ শতকের রাজপ্রাসাদ। আমেরিকান প্রতিনিধিদলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যারা ছিলেন, তারা হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফার্স্ট লেডি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন এবং চীনে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত টেরি ব্রেনস্টেড। আমাদের সঙ্গ দেন সস্ত্রীক শি জিনপিং এবং কয়েকজন অভিজ্ঞ চীনা নেতা।
আমাদের রাষ্ট্রীয় সফরের তিন সপ্তাহ আগে ১৯ তম জাতীয় কংগ্রেসে শি একটি বক্তৃতা দেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি নির্দয়ভাবে চীনা জাতির পুনরজ্জীবন অন্বেষণ করার কথা বলছিল। শি পুনরজ্জীবন দিয়ে নির্দেশ করেছিলেন সমৃদ্ধি, সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয় গৌরবের সমষ্টিকে। এটিই তাদের ‘চায়না ড্রিম’। সফরের সময় আনুষ্ঠানিক বক্তব্য, ঘরোয়া আলোচনা, আনুষ্ঠানিক টেলিভিশন সম্প্রচারসহ সফরের ধরন সব জায়গায় ‘চায়না ড্রিম’ই প্রতিফলিত হচ্ছিল। বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছানোর আরও নিকটবর্তী হওয়া ও মানবসম্প্রদায়ের প্রতি আরও বেশি অবদান রাখার উদ্দেশ্য বোঝানোর জন্য শি জিনপিংয়ের কাছে উপযুক্ত পটভূমি ছিল নিষিদ্ধ নগরী ।
নিষিদ্ধ নগরী গড়ে তোলা হয় মিং রাজবংশের সময়ে। তারা ১৩৬৮ সাল থেকে ১৬৪৪ সাল পর্যন্ত চীন শাসন করে। এই সময়কালে অর্থনৈতিক শক্তি, আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক অর্জনের জন্য চীনের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
এই রাজবংশের সময়েই মিং নৌবহরের প্রধান সেনাপতি ঝেং হি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের চারদিকে সাত সমুদ্র ভ্রমণ করে আসেন। এটি ছিল ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারেরও অর্ধ শত বছর আগের কথা। ঝেং হি তার জাহাজগুলোতে করে বিশ্বের পরিচিত সকল স্থান থেকেই মূল্যবান সম্পদ লুট করে নিয়ে এসেছিলেন। মূল্যবান জিনিসপত্রে বোঝাই করা জাহাজগুলো ছিল কাঠের তৈরি সবচেয়ে বড় জাহাজ। কিন্তু ঝেং হিয়ের সাফল্যের পরও সম্রাট মনে করলেন চীনকে দেয়ার মতো বহির্বিশ্বের কাছে কিছু নেই। তিনি সম্পদ বোঝাই জাহাজগুলোকে ফুটো করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন এবং চীনা বন্দরগুলো বন্ধ করে দিলেন।
পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে চীনের অনেকখানি বিচ্যুতি ঘটে। এই সময়ে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর এবং পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। এগুলো শি এবং অন্যান্য চীনা নেতাদের নিজেদের চোখেই দেখা।
২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের সমাপনী অনুষ্ঠানে আধুনিক প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে চীনের ৫,০০০ বছরের ইতিহাসকে তুলে ধরা হয়। নিষিদ্ধ নগরীতে আমাদের ভ্রমণকেও একইরকম মনে হচ্ছিল। তারা যেন এটাই বোঝাতে চাচ্ছিল চীনা রাজবংশরা অনেক আগে থেকেই পৃথিবীতে আধিপত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ভবনগুলোর শিল্প ও স্থাপত্যের ধরন যেন কনফুসীয় মতবাদকে মনে করিয়ে দেয়, “শ্রেণিবিভক্তি এবং সম্প্রীতি একইসাথে অবস্থান করে এবং তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল”। নিষিদ্ধ নগরীর সবচেয়ে বড় ভবন ছিল হল অব সুপ্রিম হারমনি। এখানেই সম্রাট তার বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। মহাসিংহাসনে ড্রাগন খোদাই করা এবং এর চারপাশে ছয়টি সোনার স্তম্ভ দেয়া। এগুলো যেন সম্রাটের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রকেই নির্দেশ করে!
আমাদের ভ্রমণের সময় নিষিদ্ধ নগরীর যে ছবিগুলো চীনের গণমাধ্যম ও বহির্বিশ্বে প্রচার করা হয়, তা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আত্মবিশ্বাসকেই নির্দেশ করছিল। তবে গভীরভাবে লক্ষ করলে এখানে নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপারও চলে আসে, ইতিহাসের যে শিক্ষাটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ নগরীর নকশাতেই বাইরের আত্মবিশ্বাস এবং ভেতরের আশঙ্কাকে প্রতিফলিত করে। নগরীর মাঝখানে তিনটি গ্রেট হল শুধু সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য নির্মাণ করা হয়নি। এগুলো নগরীর দেয়ালের বাইরের এবং ভেতরের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যও নির্মিত হয়েছিল।
২২০ খ্রিস্টাব্দে হ্যান রাজবংশের পতন হলে এরপরের শাসনামলগুলোতে কেবল অর্ধেক সময়েই প্রদেশগুলোতে কেন্দ্রিয় শাসনের শক্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল। চীন তখন বিদেশিদের আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলায় জর্জরিত ছিল। ইওংল সম্রাট ঝু দি মঙ্গোলদের আক্রমণের চেয়ে ঘরের শত্রু বিভীষণদের নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলেন। তিনিই নিষিদ্ধ নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিপক্ষদের চিহ্নিত ও নির্মূল করতে তিনি গুপ্তচরদের নিয়োগ দিতে থাকেন। পণ্ডিতবর্গ ও আমলারা যেন প্রতিপক্ষ শিবিরে না যেতে পারে সেজন্য তিনি শুধু বিশ্বাসঘাতকদেরই শাস্তি দিতেন না, তাদের পরিবারকেও একই ফল ভোগ করাতেন। কয়েক শতক পর চীনা কমিউনিস্ট পার্টিও এই কৌশল প্রয়োগ করেছে। নিষিদ্ধ নগরীর কেন্দ্রে সিংহাসনে যে সম্রাটরা বসতেন, তারাও শি জিনিপিংয়ের মতো একনায়কতান্ত্রিক ঘরানার শাসন করে গিয়েছেন, যা ছিল দুর্নীতি ও অভ্যন্তরীণ হুমকির জন্য আদর্শ।
আমাদের গাইড দেখান নিষিদ্ধ নগরীর যে স্থান থেকে সর্বশেষ সম্রাট পুয়িকে সিংহাসন থেকে অপসারণ করা হয়। ১৯১১ সালে প্রজাতন্ত্র বিপ্লবের সময় পাঁচ বছর বয়সী সম্রাট পুয়িকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এটি ছিল চীনের ‘অপমানজনক শতাব্দী’র মাঝামাঝি সময়। শি অপমানজনক শতাব্দী নিয়ে সেই সফরের সাত মাস আগে মার-আ-লাগো রিসোর্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ব্যাখ্যা দেন। এই সময়টা চীনের জন্য ছিল বেদনার। তখন চীন অভ্যন্তরীণভাবে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়, বেশ কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত হয়, বিদেশি শক্তির কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয় এবং নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হয়। এর শুরুটা হয়েছিল ১৮৪২ সালে প্রথম আফিম যুদ্ধে গ্রেট ব্রিটেনের কাছে চীনের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনী ও চীনের কাছে জাপানের পরাজয় এবং ১৯৪৯ সালে চীনা গৃহযুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির জয়ের মাধ্যমে এই যুগ শেষ হয়।
রাষ্ট্রীয় সফরে আমাদের সর্বশেষ আলোচনা হয় গ্রেট হল অব পিপলে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সাথে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নিয়ে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমেরিকান দলের কারও যদি সন্দেহ থেকে থাকত, তবে তা দূর হয়ে গিয়েছিল লিয়ের বক্তব্যের মাধ্যমে। তিনি শুরুতেই এটা বুঝিয়ে দেন যে, চীন এখন শিল্প ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে ইতোমধ্য উন্নত দেশে পরিণত হয়ে গেছে। তাদের এখন আর যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন নেই। তিনি চীনের অন্যায্য বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো নিয়ে সতর্ক করে দেন। তিনি ইঙ্গিত দেন ভবিষ্যতের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির শৈল্পিক ও নিত্য ব্যবহার্য পণ্য উৎপাদন করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সেখানে কেবল ভূমিকা হতে পারে এসব পণ্য উৎপাদনে চীনকে কাঁচামাল, কৃষিপণ্য আর জ্বালানিশক্তির যোগান দেয়া।
চীন ত্যাগ করার পর আমার উপলব্ধি আরও জোরালো হলো যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে নাটকীয় পরিবর্তন আসলেও তা অনেক বিলম্বিত হয়ে গেছে। নিষিদ্ধ নগরী নির্দেশ করছিল চীনের জাতীয় নবজাগরণ এবং বিশ্বের কাছে গর্বিত মধ্য রাজত্ব হিসেবে ফিরে আসাকে। কিন্তু আমি চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি ভয়ও দেখতে পাই। একারণে কমিউনিস্ট পার্টি সীমান্তের ভেতরের পাশাপাশি বাইরেও চীনের প্রভাব বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে। অপমানজনক শতাব্দীর সময় হারানো গৌরবও ফিরে পেতে চায় তারা। উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে ভয়কে আলাদা করা সম্ভব নয়। তাই কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেটা দেশের ভেতর এবং বাইরে উভয় স্থানেই।
চীনের অর্থনীতি একসময় ধীর গতির হয়ে পড়বে, জনগণ বৃদ্ধ হয়ে যাবে, অন্য দেশগুলোও বুঝতে পারবে তাদের খরচেই চীন নিজেদের নবজাগরণের জন্য কাজ করছে। করোনাভাইরাসের মতো মহামারিও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে আমেরিকাকে হটিয়ে ‘চায়না ড্রিম’ অর্জনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করে কমিউনিস্ট পার্টি কী পরিমাণ দুর্বল হয়ে পড়ছে। চীনা নেতারা জানেন ন্যায্য পন্থায় তাদের শক্তিশালী হয়ে বিশ্ব ব্যবস্থা নিজেদের অনুকূলে আনার সুযোগ কম। কমিউনিস্ট পার্টির তাই আন্তর্জাতিক আইন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ম মানার কোনো ইচ্ছা নেই। চীনের কৌশল হচ্ছে দেশের ভেতরে এবং বাইরে বল প্রয়োগ করে অন্যদের সাথে নিজেদের সংযোজিত করা। একইসাথে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য গোপন রাখা। সরকার ব্যবস্থা, শিল্প, শিক্ষা এবং সামরিক খাতে কমিউনিস্ট পার্টির সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই কৌশলকে শক্তিশালী ও বিপজ্জনক করে তুলছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য আমেরিকান আদর্শ ও নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
২. তিনটি কাঁটা
চীন নিজেদের কৌশল নিয়েছে সহ-যোজন, বলপ্রয়োগ এবং গোপনীয়তার মাধ্যমে। চীনের একনায়কতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ সর্বস্তরে বিদ্যমান। চীনের অভ্যন্তরে বাক স্বাধীনতা বা ভিন্নমত প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সহনশীলতা নেই বললেই চলে। তীব্বতের বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রতি তাদের দমনমূলক নীতি অজানা কিছু নয়। ক্যাথলিক গীর্জা এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করা শি এবং তার পার্টির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। প্রোটেস্ট্যান্ট গীর্জাগুলোর বৈচিত্র্য ও বিকেন্দ্রীকরণের কারণে এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে পার্টির পক্ষ থেকে বেশ কিছু গীর্জার চূড়ায় থাকা ক্রস চিহ্ন সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু গীর্জা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য।
বেইজিং এর নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে হংকংয়ে গতবছর বিক্ষোভ শুরু হয়, যা ২০২০ সালে এসেও চলতে থাকে। চীনা নেতারা এর জন্য বিদেশি নাগরিকদের দোষ দিয়েছেন, যা তারা সবসময়ই করে থাকেন। চীনের উত্তর-পশ্চিমে জিনজিয়াং প্রদেশে স্থানীয় উইঘুর সম্প্রদায় মূলত ইসলাম ধর্ম চর্চা করে। কমিউনিস্ট পার্টি অন্তত দশ লক্ষ উইঘুর মুসলিমকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়েছে।
পার্টি নেতারা নজিরবিহীনভাবে নজরদারি ব্যবস্থা জোরদার করছেন। চীনের ১৪০ কোটি জনগণের জন্য টেলিভিশন ও অন্যান্য মাধ্যমে পার্টির প্রোপাগান্ডা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাগরিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা, নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা ও আইনের নীতিমালা সম্পর্কে পশ্চিমা উদারনীতি বিষয়ক শিক্ষা দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নবযুগে চীনের সমাজতন্ত্র নিয়ে শি জিনপিং এর দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করা স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
শি জিনপিং এর দর্শন সম্পর্কিত বানানো অ্যাপ চীনে খুব জনপ্রিয়। অ্যাপটি ব্যবহারের জন্য চীনাদের ফোন নাম্বার ও প্রকৃত নাম দিয়ে লগইন করতে হয়। অ্যাপ ব্যবহারকারীরা আর্টিকেল পড়ে, মন্তব্য করে এবং নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা দিয়ে পয়েন্ট অর্জন করতে পারে। নাগরিকদের অনলাইন অ্যাক্টিভিটি এবং অন্যান্য বিষয় দেখে যাচাই করা হয় তারা পার্টির প্রতি কতটুক অনুরাগী। এভাবে প্রতিটি নাগরিকের জন্য ‘সোশাল ক্রেডিট স্কোর’ ঠিক করা হয়। এই স্কোরের মাধ্যমেই নাগরিকরা ঋণ সুবিধা, সরকারি চাকরি, পরিবহণ সুবিধা ও অন্যান্য সুযোগ কতটা পাবেন তা নির্ধারিত হয়।
কমিউনিস্ট পার্টি চীনের অভ্যন্তরে যে পরিমাণ নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা জাহির করে, সে তুলনায় একইসাথে বাইরের রাষ্ট্রগুলোতেও তাদের চলমান আধিপত্য সম্পর্কে বেশি জানা যায় না। এখানে আবার চলে আসে একইসাথে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও শঙ্কার কথা। চীনা সম্রাটরা দুর্বল রাজ্যগুলোর ওপর ছড়ি ঘুরাতেন। তারা রাজ্যগুলোকে যুদ্ধবিহীন জীবনযাপন ও বাণিজ্যের সুযোগ দিতেন। বিনিময়ে তাদেরকে চীনের কাছে নতি স্বীকার করতে হতো। বর্তমান চীনা নেতারাও গরিব রাষ্ট্রগুলোর ওপর আধিপত্যবাদি ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে সম্রাটদের আধুনিক সংস্করণে পরিণত হচ্ছেন। নেতারা তাদের কার্যক্রমের জন্য মোটেও লজ্জিত নন।
২০১০ সালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশিয়ানের এক সভায় অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর উদ্দেশ্য বলেই ফেলেন, “চীন একটি বড় দেশ, আর তোমরা হলে ছোট ছোট দেশ”। চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুসংগঠিত তিনটি নীতির মাধ্যমে তাদের শাখা খোলার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এগুলোকে নামও দেয়া হয়েছে, “মেড ইন চায়না ২০২৫”, “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” এবং “সামরিক-বেসামরিক যৌথ কার্যক্রম”। এগুলোই হচ্ছে চীনের তিন কাঁটা।
“মেড ইন চায়না ২০২৫” নকশা করা হয়েছে চীনকে বৃহৎ স্বাধীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষমতাধর দেশে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি চীনের অভ্যন্তরে টেক জায়ান্ট কোম্পানি তৈরি করছে। তারা বিদেশি কোম্পানিগুলো থেকে মেধা-স্বত্ব চুরি করছে। বল প্রয়োগের মাধ্যমেও প্রযুক্তিগত বিদ্যা নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের কাছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে চীনের স্থানীয় কোম্পানিদের সাথে যৌথভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য করা হয়। অন্যথায় তারা চীনে তাদের পণ্য বিক্রি করার অনুমতি পায় না। এসব চীনা কোম্পানির সাথে কমিউনিস্ট পার্টির আঁতাত থাকে। তারা নিয়মিতভাবেই বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মেধা-স্বত্ব ও ম্যানুফ্যাকচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য সরকারের কাছে পাচার করে।
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, ইউরাশিয়া ও আশেপাশের অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়নে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনকে বাণিজ্যিক রাস্তা ও যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা। এই প্রকল্পের শুরুতে বেশিরভাগ দেশই উচ্ছ্বসিত ছিল অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগ দেখে। কিন্তু ধীরে ধীরে অনেক দেশই বুঝতে পারছে এর জন্য তাদেরকে চীনের কাছে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে চীনের একটি প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়। বেইজিং প্রথমে গরিব দেশগুলোকে বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পের জন্য চীনা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রস্তাব দেয়। যখন এই দেশগুলো ঋণে জর্জরিত হয়ে যায়, তখন কমিউনিস্ট পার্টি দেশগুলোর নেতাদের চীনা পররাষ্ট্র নীতির অ্যাজেন্ডায় কাজ করতে বাধ্য করে। এই অ্যাজেন্ডার লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রভাবশালী বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য কমিয়ে আনা। যদিও চীনা নেতারা এসব চুক্তির মাধ্যমে উভয় পক্ষেরই জয়ের কথা বলেন, প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগ সময়ে সেখানে এক পক্ষেরই জয় হয়।
উন্নয়নশীল ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ একটি নিষ্ঠুর ‘ঋণ ফাঁদ’। যখন দেশগুলো ঋণ শোধ করতে পারে না, তখন চীন ঋণের বিনিময়ে সেই দেশগুলোর সমুদ্র বন্দর, বিমান বন্দর, বাঁধ, শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদির ওপর সমান নিয়ন্ত্রণ অধিকার নিয়ে নেয়। ২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সাথে জড়িত ২৩টি দেশে ঋণ সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাকিস্তান, জিবুতি, মালদ্বীপ, লাওস, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনেগ্রো, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান- এই আটটি দেশ ইতোমধ্যে ঋণ নিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থায় চলে গেছে।
দেশগুলোর আপেক্ষিক শক্তি অথবা দুর্বলতা অনুযায়ী চীনের কার্যকৌশল বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। যখন বড় অঙ্কের ঋণ নেয়া হয়, ঋণ গ্রহীতা দেশগুলোর দুর্নীতিতে জর্জরিত দুর্বল রাজনৈতিক সংগঠনগুলো চীনা কৌশলের সামনে আরও বেশি দুর্বল করে ফেলে।
শ্রীলংকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে দীর্ঘদিন দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি শ্রীলংকাকে ঋণে ভারাক্রান্ত করে ফেলেন, যা তার দেশের পক্ষে শোধ করা সম্ভব ছিল না। তিনি হাম্বানটোটায় একটি সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের কাছ থেকে উচ্চ সুদের ঋণ নিয়েছিলেন, যার আপাত কোনো প্রয়োজন ছিল না। শুরুতে চীনের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়, এই বন্দর সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে না। তবে ২০১৪ সালে শ্রীলংকায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে সফরের দিনই একটি চীনা সাবমেরিন জাহাজ এই বন্দরে চলে আসে। হাম্বানটোটা বন্দরের ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে ২০১৭ সালে শ্রীলংকা ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটি চীনা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাসম্পন্ন কোম্পানির কাছে ইজারা দিতে বাধ্য হয়।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নতুন অগ্রদূত হচ্ছে তাদের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যাংকার এবং ব্যাগভর্তি ক্যাশ নিয়ে আসা পার্টি সদস্যরা। ঋণ গ্রহীতা দেশগুলোর দুর্নীতি উপনিবেশ ব্যবস্থার মতো নিয়ন্ত্রণ এনে দিচ্ছে চীনকে, যা ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথগুলোকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
চীনের তিনটি কাঁটার মধ্যে সবচেয়ে সর্বগ্রাসী ব্যবস্থা হচ্ছে সামরিক-বেসামরিক যৌথ কার্যক্রম। ২০১৪ সালে এবং পুনরায় ২০১৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা দেয়, সকল চীনা কোম্পানিকে অবশ্যই সরকারের গোয়েন্দা কার্যক্রমে সহায়তা করতে হবে। চীনা কোম্পানিরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং পিপলস লিবারেশন আর্মিকে সাথে নিয়ে কাজ করে। সামরিক-বেসামরিক যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে উৎসাহ দেয়া হয় আধুনিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কিনে নেয়ার জন্য। ফলে প্রযুক্তিকে শুধু অর্থনৈতিক খাতেই নয়, সামরিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রমেও ব্যবহার করা যায়।
এই প্রক্রিয়ায় চুরি করা প্রযুক্তির মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে মহাকাশে, সাইবার স্পেসে, জীববিজ্ঞান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জ্বালানি ক্ষেত্রে আরও গতিশীল করা হয়। নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় শিল্প গুপ্তচরবৃত্তি ও ডিজিটাল চুরির সাথে জড়িত। পাশাপাশি পার্টির পক্ষ থেকে চীনা ছাত্র ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের কাজের ভার দেয়া হয় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাদের গবেষণাগার থেকে প্রযুক্তি পাচার করার জন্য।
চীনা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় এপিটি১০ নামে একটি হ্যাকিং গ্রুপকে ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিষয়ক কোম্পানি, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক পণ্য, স্বাস্থ্য খাতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয়। নাসা এবং প্রতিরক্ষা খাতের গবেষণাগারগুলোও বাদ রাখেনি তারা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তাদের হ্যাকাররা এক লাখেরও বেশি আমেরিকান নৌবাহিনীর সদস্যদের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে চুরি করে।
চীনের সেনাবাহিনী চুরি করা প্রযুক্তির মাধ্যমে আমেরিকান প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোকে বাজার থেকে বের করে দেয়। চীনা ড্রোন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান দা-জিয়াং ইনোভেশন (ডিজেআই) ২০১৭ সালে বিশ্ব বাজারের ৭০ শতাংশ দখল করে রেখেছিল। এর পেছনের কারণ ছিল তাদের সস্তা মূল্য। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কাছেও তাদের ড্রোন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে এই কোম্পানিকে নিষিদ্ধ করা হয়।
চীনা গুপ্তচরবৃত্তি এত সফল হওয়ার কারণ কমিউনিস্ট পার্টি অন্যদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তথ্য আদায় করে নিতে পারে। এখানে আমজনতা থেকে কোম্পানি ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকেও সহায়তা পায় তারা। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মুক্তবাজার অর্থনীতির কোম্পানিরা অনেক সময় প্রযুক্তি পাচারের ঘটনা ঘটলেও তা চেপে যায়। কারণ তখন চীনের বাজার হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে, ক্রেতাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে কিংবা রাষ্ট্রের তদন্তের সম্মুখীন হতে পারে।
কোম্পানিগুলোকে দমননীতির মাধ্যমেও বাধ্য করা হয় পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী চলতে। পার্টির আগ্রাসী ও দমনমূলক কর্মকাণ্ডের কোনোরূপ সমালোচনা করতে দেয়া হয় না। ২০১৮ সালে আমেরিকান বহুজাতিক হোটেল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ম্যারিয়টের এক কর্মী কোম্পানির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে তিব্বত ঘরানার একটি টুইটে ‘লাইক’ দেন। একারণে চীনে ম্যারিয়টের ওয়েবসাইট ও অ্যাপ এক সপ্তাহ ব্লকড থাকে। ওই কর্মীকে চীন সরকারের চাপে চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করা হয়। গত অক্টোবরে হিউস্টোন রকেটস বাস্কেটবল দলের জেনারেল ম্যানেজার ড্যারিল মুরে হংকংয়ের বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে টুইট করেন। ফলে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব টিভি চ্যানেলগুলোতে হিউস্টোন রকেটসের ম্যাচ সম্প্রচার করা নিষিদ্ধ করা হয়।
৩. কৌশলগত সহানুভূতি
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক হ্যান্স মরগেনথু অনেক আগেই বলে গিয়েছিলেন, আমেরিকানরা বিশ্বকে শুধু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখে। তারা মনে করে ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা মতোই হবে। অথবা অন্যরা আমাদের মতোই চিন্তা করবে এমন ধারণা তাদের। এটা কৌশলগত আত্মমুগ্ধতা ছাড়া কিছুই না।
কিন্তু বিশ্বকে দেখার আরেকটি উপায় আছে। সেটা হচ্ছে কৌশলগত সহানুভূতিশীলতা। ইতিহাসবিদ জ্যাকারি শোরের মতে, কৌশলগত সহানুভূতি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একে অন্যকে কীভাবে দেখে তা বোঝা। তারা আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে তা অনুধাবন করা। ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার আলোকে চীনকে কৌশলগত সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখলে ভিন্ন ধারণা পাওয়া যায়।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের অর্থনীতি বা সরকার ব্যবস্থাকে উদারপন্থী করবে না। তারা সর্বজনীন গৃহীত আন্তর্জাতিক আইনও মেনে চলবে না। বরং তারা এসব আইন বিলুপ্ত করে চীনপন্থী আইন প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে। চীন অন্যায্য বাণিজ্য চর্চা ও শিল্প গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক আগ্রাসন বজায় রাখবে। চীন তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করবে।
চীনের আগ্রাসন নীতি মোকাবেলায় যেকোনো কৌশলই নেয়ার আগে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বহিঃশক্তি পরিবর্তিত চীনের বিপক্ষে কতটা কার্যকর হবে সেটা বিবেচনা করতে হবে। তবে সামরিক শক্তি ও বাণিজ্য নীতি ছাড়াও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র আছে।
চীন যে ‘পশ্চিমা উদারপন্থী’ নীতিকে দুর্বলতা মনে করে এটা প্রকৃতপক্ষে অনেক শক্তিশালী। তথ্য এবং চিন্তাধারার অবাধ বিনিময় ব্যবস্থা উদ্ভাবনী শক্তি ও সমৃদ্ধির পেছনে জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। এটা দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতারও সুযোগ করে দেয়। চীন এই কারণে তাইওয়ান নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকে। কারণ দেশটা ছোট হলেও সফল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সেখানে চীনের একনায়কতান্ত্রিক চর্চার বদলে রয়েছে মুক্ত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা।
বলিষ্ঠ আইনের পাশাপাশি বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিভিন্ন দেশে চীনের লুণ্ঠনমূলক বাণিজ্য চর্চা ফাঁস করে দিয়েছে। এতে চীন যে ভরসাযোগ্য ব্যবসায়িক পার্টনার নয়, তা প্রমাণ হয়ে গেছে। মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়। তিয়েনআনমেন চত্বরে গণহত্যার পর যেসব চাইনিজ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রে থেকে গেছেন, তারা সিলিকন ভ্যালির উদ্ভাবনী উদ্ভাবনী চর্চায় সামনের সারিতে থেকে কাজ করেছেন।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে আমাদের প্রতিরক্ষামূলক যে ব্যবস্থাগুলো নিতে পারি তা নিম্নরূপ :
- যেসব দেশ আইনের শাসন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাগার, কোম্পানি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে চীনকে সাহায্য করছে। এতে চীন তাদের জনগণের ওপর দমনমূলক কার্যক্রম এবং সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে পারছে। দ্বিপাক্ষিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানদের উচিত সেসব দেশের প্রতিষ্ঠানের সাথে পার্টনারশিপ করা, যারা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে, নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা পরিচালনা করে এবং আইনের শাসন মেনে চলে। যেসব দেশের মনোভাব এর বিপরীত, তাদের সাথে কাজ করা উচিত নয়। অনেক যৌথ প্রতিষ্ঠান চীনকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক প্রযুক্তি নির্মাণে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ ম্যাসাচুসেটস ভিত্তিক একটি কোম্পানির কথা বলা যায়। তারা চীনের কাছে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কিট বিক্রি করে, যার মাধ্যমে চীন সরকার জিনজিয়াংয়ের উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর নজরদারি করেছিল। যেসব কোম্পানি স্বেচ্ছায় চীনের জনগণকে দমনে সাহায্য করছে কিংবা তাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজ করছে, তাদের শাস্তি দিতে হবে।
- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চীনের জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করার সাথে জড়িত অনেক চীনা কোম্পানি আমেরিকান শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত। এসব কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপান যদি এসব কোম্পানিকে তাদের পুঁজি বাজার থেকে সরিয়ে দেয়, তাহলে চীনের একনায়কতান্ত্রিক অ্যাজেন্ডার কুকর্মের সহায়তাকারী কর্পোরেট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া যাবে।
- চীনের বড় টেলিকম কোম্পানিগুলো বাইরের দেশগুলোর যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। চীনভিত্তিক বহুজাতিক টেক কোম্পানি হুয়াওয়ে চীন সরকারের নিরাপত্তা বিভাগকে সাহায্য করে আসছে। হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে নেয়া যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকা উচিত না। ২০১৯ সালে বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক তদন্তের মাধ্যমে হুয়াওয়ের টেলিযোগাযোগ সরঞ্জামগুলোর সাথে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। হুয়াওয়ের অনেক কর্মকর্তারা এই কোম্পানির পাশাপাশি চীনের নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত আছেন। আফ্রিকার একনায়কতান্ত্রিক নেতারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মোবাইল ফোন শনাক্ত করে গুপ্তচরবৃত্তি ও পরাস্থ করার জন্য হুয়াওয়ের কর্মীদের সাহায্য নিয়েছেন। মুক্ত সমাজব্যবস্থার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ফাইভ জি নেটওয়ার্কের মতো অবকাঠামোগত নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য নেটওয়ার্ক তৈরি করায় প্রাধান্য দেয়া উচিত। এসব অবকাঠামোর মাধ্যমে অবশ্যই সংবেদনশীল ও ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদ রাখতে হবে।
- চীনা নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ইউনাইটেড ফ্রন্ট ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্ট, চীনা শিক্ষার্থী ও স্কলার অ্যাসোসিয়েশনের মতো সংস্থা বিদেশে প্রভাব বিস্তারে কাজ করছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একইসাথে চীনের সাধারণ জনগণের সাথে আমাদের ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও এর সমমনা মুক্ত সমাজের দেশগুলোর উচিত চীনা জনগণের জন্য সহজে ভিসার ব্যবস্থা করা এবং নাগরিকত্ব দেয়া। এগুলো অবশ্যই করতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রেখে। যেসব চীনা নাগরিক মুক্তমনা দেশগুলোর সন্নিকটে এসেছে, তারাই বেশিরভাগ সময় চীন সরকারের অনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে। সেটা বিদেশ থেকে হোক কিংবা দেশে ফেরার পর।
- যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মুক্ত সমাজের দেশগুলোর উচিত নির্বাসিত চীনাদের শক্তি হিসেবে দেখা। নির্বাসিত চীনা অভিবাসীদের যদি তাদের সরকারের অনধিকারচর্চা ও গুপ্তচরবৃদ্ধি থেকে রক্ষা করা যায়, তাহলে তারা বেইজিংয়ের প্রোপাগান্ডা ও ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে জোড়ালো ভূমিকা রাখতে পারবে। চীনা নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থার তদন্ত করে চীনের শিকার দেশগুলোকে রক্ষা করার পাশাপাশি এসব দেশের চীনা নির্বাসিতদেরকেও রক্ষা করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও এর সমমনা দেশগুলো যদি উপযুক্ত জবাব না দেয়, চীন তার পরিসংখ্যানের অর্থনীতি ও একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রচারে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠবে। চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে তাদের মাঝে নিরাপত্তাহীনতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার যে শক্তিশালী সমন্বয় দেখেছি, তাতে আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের আর চলা উচিত নয়। তারা শুধুমাত্র পশ্চিমা উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করেই কাজ করছে। যেসব দেশ চীনের প্রজা রাষ্ট্র হয়ে থাকতে চায় না, তারা চীনের কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। অভ্যন্তরীণভাবেও কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হচ্ছে। লি কেকিয়াং এর মতো নেতাদের বাহাদুরি দেখে মনে হয় চীন স্বর্গের নিচে থাকা সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু স্বর্গের নিচে থাকা অনেকেই এর সাথে একমত না, হওয়া উচিতও না।