সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয়া হয়েছে এবং স্বভাবতই এ নিয়ে নানা তর্ক–বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্প ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেছেন এবং এজন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। কিন্তু ইসরায়েলি–ইমারাতি শান্তিচুক্তি ফিলিস্তিনি জনসাধারণ এবং ইমারাত ও ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিতর্কিত একটি ঘটনা। তদুপরি, ট্রাম্পকে ঠিক ‘শান্তিপ্রিয়’ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। এটা সত্যি যে, ট্রাম্প তার পূর্বসূরী বারাক ওবামা বা জর্জ বুশের মতো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো যুদ্ধ আরম্ভ করেননি।
কিন্তু মার্কিন সৈন্যরা এখনো সিরিয়ার একাংশ দখল করে রেখেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানি জেনারেল কাশেম সুলাইমানিকে খুন করার ফলে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বাঁধার উপক্রম হয়েছিল। ট্রাম্প ইয়েমেনে সৌদি–নেতৃত্বাধীন জোটের সামরিক অভিযান এবং সিরিয়ার তুর্কি সামরিক অভিযানকে সমর্থন করেছেন, যে দুইটি অভিযানই মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। সর্বোপরি, রাশিয়া, ইরান, উত্তর কোরিয়া, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ট্রাম্প ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধ’ অব্যাহত রেখেছেন এবং চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করেছেন। সুতরাং, ট্রাম্পকে নোবেল ‘শান্তি’ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয়াটা যে বিতর্কের সৃষ্টি করবে – এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যদিও, মনোনয়ন পেলেই যে কাউকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হবে, সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই।
অবশ্য নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে যে বিতর্ক সেটি নতুন নয়। ইতোপূর্বেও বেশ কয়েকজন যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়ককে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয়া হয়েছে এবং কেবল মনোনয়নই নয়, তাদেরকে এই পুরস্কারে ভূষিতও করা হয়েছে। চলুন, জেনে নেয়া যাক সেইসব যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনায়কের কথা, যারা ‘শান্তি’ স্থাপনের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
উড্রো উইলসন
উড্রো উইলসন ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম রাষ্ট্রপতি এবং ১৯১৩ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯১৯ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। উইলসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিশ্বের স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ‘জাতিপুঞ্জ’ (League of Nations) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার এই অবদানের জন্য তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল।
কিন্তু উইলসনের পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করলে একজন ‘শান্তিপ্রিয়’ শাসকের চিত্র ফুটে ওঠে না। কারণ তার শাসনকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কমপক্ষে ৮টি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। উইলসনের শাসনকালে মার্কিন সৈন্যরা নিকারাগুয়া দখল করে নেয় এবং ১৯২৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রটিকে কার্যত দখল করে রাখে। ১৯১৪ সালে মার্কিন সৈন্যরা মার্কিন–মেক্সিকান সীমান্ত বরাবর মেক্সিকোর অংশবিশেষ দখল করে নেয় এবং ১৯১৯ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি দখলে রাখে। ১৯১৫ সালে মার্কিন সৈন্যরা হাইতি দখল করে নেয় এবং ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রটি দখল করে রাখে। ১৯১৬ সালে মার্কিন সৈন্যরা ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে সৈন্য প্রেরণ করে এবং ১৯২৪ সাল পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রটি মার্কিন সামরিক দখলদারিত্বে ছিল। এছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯১৬ সালে কিউবায় এবং ১৯১৯ সালে হন্ডুরাসে সামরিক অভিযান চালায়। এসবের মধ্য দিয়ে মধ্য আমেরিকা অঞ্চলের প্রতি ‘শান্তির দূত’ এবং ‘জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রবক্তা’ উইলসনের সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।
উইলসনের যুদ্ধবাজ নীতি কেবল ল্যাটিন আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯১৭ সালের এপ্রিলে জার্মান নৌবাহিনী ‘অনিয়ন্ত্রিত সাবমেরিন যুদ্ধ’ শুরু করলে এটিকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে উইলসন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। তদুপরি, ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং বলশেভিকরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এর ফলে ক্ষিপ্ত মিত্রশক্তি ১৯১৮ সালে রাশিয়া আক্রমণ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। মার্কিন সৈন্যরা উত্তর ও পূর্ব রাশিয়ার অংশবিশেষ দখল করে নেয় এবং রাশিয়ায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, কিন্তু ১৯২০ সালের মধ্যে তারা পরাজিত হয়ে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
কর্ডেল হাল
কর্ডেল হাল ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (Secretary of State) এবং ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৫ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘জাতিসংঘ’ (United Nations) প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল এবং এজন্যই তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল।
কিন্তু একদিকে যেমন হাল ‘জাতিসংঘ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ও বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী পৃথিবীতে মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নীলনকশা সৃষ্টিতেও তার ভূমিকা ছিল। যে কাজটির জন্য হাল সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন, সেটি হচ্ছে ১৯৩৯ সালে শরণার্থী জাহাজ ‘এসএস সেন্ট লুইস’কে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা প্রদান। জার্মান এই জাহাজটিতে ৯৩৬ জন ইহুদি শরণার্থী ছিল, যারা গণহত্যা থেকে বাঁচতে জার্মানি থেকে পালিয়ে এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু হাল ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতিবিদরা এই শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং জাহাজটিকে ফিরে যেতে হয়। পরবর্তীতে এই শরণার্থীদের মধ্যে কমপক্ষে ২৫৪ জন জার্মানদের হাতে নিহত হয়।
জর্জ মার্শাল
জর্জ মার্শাল ছিলেন মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল, যিনি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ১৯৫০ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ সালে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মার্শাল যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা প্রদানের বন্দোবস্ত করেন, যেটি ‘মার্শাল পরিকল্পনা’ (Marshall Plan) নামে পরিচিতি লাভ করে। মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রাপ্ত সহায়তায় পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় এবং এজন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু বস্তুত মার্শাল পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোতে কমিউনিজম যাতে বিস্তার লাভ করতে না পারে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন এতদঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, এজন্যই এই পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। তদুপরি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালে মার্শাল কোরীয় যুদ্ধে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা করেছিলন। কোরীয় যুদ্ধে প্রায় ২০ থেকে ৩০ লক্ষ কোরীয় জনসাধারণ প্রাণ হারিয়েছিল এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ করার ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি কার্যকরী ভূমিকা রেখেছিলেন, তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল।
হেনরি কিসিঞ্জার
হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (১৯৬৯–১৯৭৫) এবং পরবর্তীতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭৩–১৯৭৫)। ১৯৭৩ সালে তাকে এবং ভিয়েতনামি নেতা লি ডাক থোকে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে তারা দুজন ভিয়েতনাম যুদ্ধকে সমাপ্ত করার জন্য প্যারিস শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন এবং এজন্য তাদের এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। অবশ্য লি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ তার মতে তখনো ভিয়েতনামে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। উল্লেখ্য, এর চার মাস পরেই ভিয়েতনামে আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
কিসিঞ্জার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিদের একজন। দায়িত্ব পালনকালে তিনি বহু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বা নেয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে খুন করেছিল, এবং এটি সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্বেও কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে এই যুদ্ধে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে চিলির মার্ক্সবাদী সরকার একটি সামরিক অভ্যুত্থানের ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং চিলির মার্কিনপন্থী সামরিক সরকার কমপক্ষে ৩,০০০ রাজনৈতিক বন্দিকে খুন করে ও প্রায় ৮০,০০০ রাজনৈতিক বন্দির ওপর চরম নির্যাতন চালায়। কিসিঞ্জার এটিকেও সমর্থন জানান। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। এই দুর্ভিক্ষের একটি অন্যতম কারণ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশকে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া, যে সিদ্ধান্তের পিছনে কিসিঞ্জার সক্রিয় ছিলেন।
১৯৭০–এর দশকে আর্জেন্টিনার সামরিক সরকার কমপক্ষে ৩০,০০০ রাজনৈতিক বন্দিকে গুম করে এবং কিসিঞ্জার ‘নোংরা যুদ্ধ’ নামে পরিচিত এই রাজনৈতিক নিষ্পেষণকেও সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৯৭৫–১৯৭৬ সালে ইন্দোনেশিয়া পূর্ব তিমুর দখল করে নেয় এবং সেখানকার প্রায় ৩ লক্ষ অধিবাসী ইন্দোনেশীয় সৈন্যদের হাতে নিহত হয়। কিসিঞ্জার ইন্দোনেশিয়ার এই কর্মকাণ্ডের প্রতিও মার্কিন সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন।
মেনাচেম বেগিন
মেনাচেম বেগিন ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি এবং মিসরীয় রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এই চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাদেরকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল।
কিন্তু বেগিন ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করেননি। চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের স্বায়ত্তশাসন দিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু বেগিন তাদেরকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেননি, বরং অঞ্চল দুইটিতে ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপনের জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন।
তদুপরি, নোবেল শান্তি পুরস্কারের মাত্র ৪ বছরের মাথায় ১৯৮২ সালে তিনি লেবাননে আক্রমণ চালান। এই যুদ্ধে প্রধানত ইসরায়েলি সৈন্যদের হাতে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ লেবানিজ নিহত হয় এবং লেবানন সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিশেষত ইসরায়েলি সমর্থনপ্রাপ্ত লেবানিজ খ্রিস্টান মিলিশিয়ারা ‘সাবরা’ ও ‘শাতিলা’ নামক দুইটি ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে গণহত্যা চালিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল।
ইৎঝাক রাবিন
ইৎঝাক রাবিন ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ ও ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দুই মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলি নেতা শিমন পেরেজের সঙ্গে যুগ্মভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯০–এর দশকে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেটির জন্যই তারা এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্যই ১৯৯৫ সালে একজন উগ্র ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাবিনকে খুন করে।
কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করলেও রাবিনের কর্মজীবনকে ঠিক শান্তিপূর্ণ বলা চলে না। রাবিন ছিলেন একজন সামরিক কর্মকর্তা এবং আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধে ইসরায়েলের বিজয় (ও আরব ভূমি দখলে) তার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তদুপরি, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৩ সালে রাবিন লেবানন আক্রমণ করেছিলেন। এই আক্রমণে শত শত বেসামরিক লেবানিজ প্রাণ হারিয়েছিল এবং প্রায় ৩ লক্ষ লেবানিজ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।
বারাক ওবামা
বারাক ওবামা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম রাষ্ট্রপতি এবং ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে অবদান রাখার জন্য তাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
ক্ষমতায় আসার পর ওবামা রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনা করছিলেন এবং ২০১০ সালে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই উদ্দেশ্যে ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এজন্য ওবামাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হলেও রুশ রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভকে কিন্তু এই পুরস্কার প্রদান করা হয়নি, যদিও নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সহযোগিতাই ছিল অত্যাবশ্যক।
ওবামা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কমপক্ষে ৭টি রাষ্ট্রে বোমাবর্ষণে লিপ্ত ছিল, যেগুলোর মধ্যে ছিল লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইয়েমেন ও সোমালিয়া। ২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক জোট লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে লিবীয় নেতা মুয়াম্মার আল–গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, এবং পরবর্তীতে লিবিয়া একটি প্রলম্বিত গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়। একই সময় যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার সরকারকে উৎখাত করার জন্য সিরীয় বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে শুরু করে এবং সিরিয়ার অংশবিশেষ দখল করে নেয়। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতিও তার সময়ে অব্যাহত ছিল এবং ইয়েমেন, সোমালিয়া ও পাকিস্তানে মার্কিন ড্রোন আক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।
সবশেষে একটি তথ্য দেয়া যাক। ১৯৩৯ সালে জার্মান নেতা অ্যাডলফ হিটলার এবং ১৯৪৫ ও ১৯৪৮ সালে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী জোসেফ স্তালিন নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছিলেন!