ভারতের পরবর্তী লোকসভার খুব বেশি দেরি নেই। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর কাছে বিষম ধাক্কা খাওয়ার পরে বিরোধী দলগুলো এবং তাদের নেতাদের কাছে সামনের বছরের সাধারণ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। কারণ, আরও একটি বড়সড় ধাক্কা খেলে তাদের অনেকেরই রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে। তাই সাধারণ নির্বাচনের আগে এই নেতা-নেত্রীরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন একটা মিলিত বিরোধিতা তুলে ধরার, যাতে এককভাবে না হলেও একসাথে মোদীর মোকাবেলা করা সম্ভব হয়।
এতদিন এমন মিলিত প্রয়াস বেশ কয়েকবার নেওয়া হলেও তা সফল হচ্ছিল না। গত সাড়ে চার বছরে মোদী এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে বেশ কিছু রাজ্য নির্বাচনে পরাস্ত হয় বিরোধীরা। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস তো একের পর এক রাজ্যে পর্যুদস্ত হতে হতে প্রায় খাদের ধারে পৌঁছে যাওয়ার পরে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে কোনোরকমে মুখরক্ষা করে। স্বস্তিতে ছিল না বেশ কিছু আঞ্চলিক দলও। আর বিরোধীরা যত নির্বাচনী ধাক্কা খাচ্ছিল, তত তাদের এই ঐক্যের প্রয়াস আরও নড়বড়ে হয়ে পড়ছিল। কংগ্রেস অধ্যক্ষ রাহুল গান্ধী বা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অথবা দলিত নেত্রী মায়াবতী বিভিন্ন সময়ে এমন ঐক্যবদ্ধ জোটের কথা বললেও, তা বাস্তবায়িত হচ্ছিল না নানা কারণে। বিজেপিও সময়ে সময়ে তাচ্ছিল্য করছিল এই প্রয়াসকে। জনমানসেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল না।
চন্দ্রবাবু নাইডু অন্য অনেক নেতার চেয়েই গ্রহণযোগ্য
কিন্তু এরপর এমন একজন নেতা এই ঐক্যসাধনের লক্ষ্যে উদ্যোগ নিলেন, হঠাৎ এই সমস্ত প্রকল্পটির মধ্যে যেন এক নতুন প্রাণ সঞ্চার হলো। এই নেতাটি হচ্ছেন দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু। তেলেগু দেশম পার্টি বা টিডিপি-র এই নেতা সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গিয়েছেন আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে- কখনও কর্ণাটকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া এবং তার পুত্র, রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামীর সঙ্গে; কখনো তামিলনাড়ুতে ডিএমকে দলের প্রধান এম কে স্ট্যালিন আবার কখনও বা কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। লক্ষ্য একটাই: সমস্ত মোদী-বিরোধী কণ্ঠস্বরকে একমঞ্চে আনা। কাজটি যদিও সহজ নয়, কিন্তু চন্দ্রবাবুর এই প্রয়াসের মধ্যে বিরোধীরা যদি আশান্বিত বোধ করেন, তবে তা অকারণে নয়।
নাইডুই দেশের প্রথম টেক-স্যাভি রাজনীতিক
এই আসার প্রথম কারণ চন্দ্রবাবুর রাজনৈতিক পরিচয়। ভারতীয় রাজনীতিতে টেক-স্যাভি রাজনীতিবিদ হিসেবে যিনি প্রথম নাম করেন, তিনি মোদী নন, চন্দ্রবাবু। অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশের ‘চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার’ হিসেবে চন্দ্রবাবু পরিচিত ছিলেন তার প্রযুক্তি-প্রেমের কারণে। তার রাজত্বকালে যদিও অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি সারা অন্ধ্রপ্রদেশ নয়, মনোনিবেশ করেছিলেন শুধু রাজধানী হায়দরাবাদের উন্নতির দিকে, কিন্তু বাইরের জগতের কাছে চন্দ্রবাবুর পরিচিত ছিল এক আধুনিকমনস্ক রাজনীতিক হিসেবেই। জাত-পাতের রাজনীতির সঙ্গেও তাকে মেলানো যায় না, ঠিক যেমনটি যায় না মোদীকে, তা তিনি অনগ্রসর শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলেও। যদি আজ মোদী-বিরোধী শক্তিরা আধুনিকতার নিরিখে তার একজন প্রতিদ্বন্দ্বী খোঁজেন, তাহলে চন্দ্রবাবুই তাদের সেরা বাজি হতে পারেন।
দক্ষিণ ভারতে নাইডু মোদীকে পিছনে ফেলে দিতে পারেন
দ্বিতীয়ত, মোদী-বিরোধী নেতৃত্বের বেশিরভাগ মুখই উত্তর বা পূর্ব ভারত-কেন্দ্রিক এবং তাদের জাতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্যতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয়। মমতা, মায়াবতী বা অখিলেশ এরা কেউই বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে সেরকম অর্থে গুরুত্বপূর্ণ নন আর তা মোদী-বিরোধী ফ্রন্টের সাফল্যের পথে এক বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অতীতে তামিলনাড়ুর দুই বড় নেতা জয়ললিতা এবং এম করুণানিধিকে জোটসঙ্গী পেয়ে দক্ষিণে ওজন বাড়ানোর চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে জাতীয় দল তথা বিজেপি এবং কংগ্রেসকে। বর্তমানে এই দুই নেতাই প্রয়াত এবং তাদের উত্তরসূরিরা সেভাবে এখনও নাম-যশ কিনে উঠতে পারেননি আর সেখানেই চন্দ্রবাবুর এক বড় সুবিধা। এক তো তিনি নিজেই দক্ষিণ ভারতের এক বড় নেতা এবং দক্ষিণ ভারতে, যেখানে বিজেপি এখনও সেভাবে পদ্ম ফুটিয়ে তুলতে পারেনি, সেখানে তার গ্রহণযোগ্যতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে তুল্যমূল্য বিচারে। দক্ষিণের একমাত্র যেই রাজ্যে কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছে, সেই কর্ণাটকেও তারা সম্প্রতি বিধানসভা ও উপনির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছে। আর এরই সুযোগ নিয়ে চন্দ্রবাবু ইতিমধ্যেই সেখানকার শাসক জোটসঙ্গী জনতা দল (সেকুলার) এবং তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-এর নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন মোদী-বিরোধী জোটকে উজ্জীবিত করতে।
কংগ্রেসের বদলে নাইডুর সামনে থাকাটা বিরোধীদের পক্ষে ইতিবাচক
তৃতীয়ত, যদিও মোদী-বিরোধী জোটকে সফল হতে গেলে দুর্বলতর কংগ্রেসের সমর্থনও তার প্রয়োজন, রাহুল গান্ধীর বদলে চন্দ্রবাবুর হাতে ঐক্যসাধনের লাগামটি থাকলে তা আখেরে লাভজনক বিরোধীদের পক্ষেই। কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে মায়াবতী এবং অখিলেশ একদিকে যেমন খুশি নন, তেমনই রাহুলকে নেতা হিসেবে মানতে অনেক আঞ্চলিক নেতারও আপত্তি রয়েছে কারণ, কংগ্রেস অধ্যক্ষ আজ অবধি মোদী এবং বিজেপিকে একটি নির্বাচনেও হারাতে পারেননি এবং তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করলে যে জোটের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই কমে যেতে পারে, সেটা অনেকেরই আশঙ্কা। এই অবস্থায় চন্দ্রবাবুকে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দেখতে আপত্তি করবেন না অনেকেই। কংগ্রেস থাকুক কিন্তু অগ্রভাগে নয়, এটাই বিরোধীদের মুখ্য বক্তব্য।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাইডুর কৌশলেও এসেছে পরিবর্তন
অনেকেই অবশ্য চন্দ্রবাবুর এই নয়া বিজেপি-বিরোধী অবতারের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন এক দ্বিচারিতা। বলা হচ্ছে, যে কংগ্রেসের আধিপত্য খর্ব করতেই তার টিডিপি দলের জন্ম (তার শ্বশুরমশাই এন টি রাম রাও-এর যুগে) এখন নিজের রাজ্যের টিকে থাকতে চন্দ্রবাবু কিনা তার হাতই ধরলেন। ব্যাপার হলো, এই মতামতের মধ্যে সারবত্তা বিশেষ নেই। রাজনীতিতে নির্দিষ্ট শত্রু বলে কিছু হয় না, তা সে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো আঙিনাতেই নয়। আশির দশকের মাঝামাঝি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে টিডিপি তেলেগু গর্বের আগুন জ্বালিয়েছিল, তার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বর্তমানে চন্দ্রবাবু যেই প্রেক্ষাপটে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ছেন, তা ভিন্ন। যদিও দুটি ঘটনার মধ্যে যে যোগাযোগ রয়েছে, তা হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনার অভিযোগ। আর ২০১৯-এর লোকসভা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভার আগে চন্দ্রবাবু নানা রাজনৈতিক পরিকল্পনাকে একত্র করেই মাঠে নেমেছেন, কারণ তিনি জানেন একটি লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে অন্যটিকে জলাঞ্জলি দিলে চলবে না।
সমালোচকরা তবু বলছেন যে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলা চন্দ্রবাবুর কাল হয়ে দেখা দিতে পারে, কারণ অন্ধ্রের মানুষ রাজশেখর রেড্ডি-পরবর্তী কংগ্রেসকে বর্জন করেছে দুই হাতে; জনপ্রিয়তা বরং বেড়েছে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীর পুত্র জগনের, যার ওয়াইএসআর কংগ্রেস আগামী নির্বাচনে শাসকদল টিডিপিকে বিনা লড়াইয়ে সূচাগ্র জমিও ছাড়তে রাজি নয়। জগনের থেকে এগিয়ে থাকার মরিয়া প্রয়াসে চন্দ্রবাবু যখন দেখলেন যে কিছুতেই কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে অন্ধ্রের জন্যে বিশেষ তকমার দাবি আদায় করতে পারছেন না, তিনি বিজেপির জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স থেকেও বের হয়ে এলেন যাতে গণদরবারে এই বার্তাই যায় যে তিনি নন, আসলে অন্ধ্রপ্রদেশের হিতসাধনে ইচ্ছুক নন নরেন্দ্র মোদী সরকারই। এই রাজনৈতিক চালটির পিছনে এখন চন্দ্রবাবু জাতীয় বিরোধী জোট তৈরির অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে জাতীয় এবং রাজ্য নির্বাচনের প্রেক্ষিতটিকেও জুড়ে দিচ্ছেন।
বিরোধীরা এতে অখুশি হবে না। প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের পরে কী হবে?