মানবসভ্যতার ভয়াবহতম আর সবচেয়ে বিস্তৃত যুদ্ধগুলোর একটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানির ফ্যাসিস্ট সরকারের শুরু করা এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ত্রিশের অধিক দেশ, গণহত্যা আর জাতিগত নিধনের চেষ্টার এ যুদ্ধে নিহত হয় সাড়ে সাত কোটি মানুষ। দুই কোটি সামরিক বাহিনীর সদস্যের পাশাপাশি নিহত হয় পাঁচ কোটির বেশি অসামরিক নাগরিক। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর ধ্বংসের অভিজ্ঞতা স্থায়ীভাবে বদলে দেয় আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে, রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সংঘাত সমাধানের জন্য তৈরি হয় জাতিসংঘের মতো অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বীকৃত হয় সার্বজনীন মানবাধিকার।
আটলান্টিক চার্টার অনুসারে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো স্বাধীনতা দিতে থাকে তাদের অধীনে থাকা উপনিবেশগুলোকে, এশিয়া আর আফ্রিকার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে তৈরি হয় জাতিরাষ্ট্র। স্বাধীনতা অর্জনের পরে তৃতীয় বিশ্বের এই দেশগুলোর নতুন লড়াই শুরু হয়, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লড়াই। বারবার সেসব দেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে, হরণ করেছে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার।
আবার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অস্থির সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে, অনেকগুলো রেজিম টিকে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়েও। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে গণতন্ত্রায়নের ঢেউ লাগে ইউরোপের এই রেজিমগুলোতে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো।
সত্তরের দশক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পূর্ববর্তী সময়ে অনেকগুলো ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে তৈরি হয়েছে অনেকগুলো দেশে। অনেকগুলো দেশে এসেছে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন, পরিবর্তন হয়েছে শাসকগোষ্ঠী। এ সময়ের যেসব রাজনৈতিক ঘটনা আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের সাথে জড়িত, কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক সেভা গুনিস্কায় সেসব ঘটনাকে চিহ্নিত করেছেন আধুনিক গণতন্ত্রের বিবর্তনের দশম ঢেউ হিসেবে, তার ‘ডেমোক্রেটিক ওয়েভস ইন হিস্ট্রিকাল পার্স্পেক্টিভ‘ নিবন্ধে।
আধুনিক গণতন্ত্রের দশম ঢেউ
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই ঊনবিংশ শতাব্দীতে ক্রমাগত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে পর্তুগাল, বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে রাজার ক্ষমতা নিয়ে, সাংবিধানিক শাসনের রূপরেখা নিয়ে। প্রথম রিপাবলিকের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় পর্তুগালে, শুরু হয় গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার যুগ।
তবে, দীর্ঘ শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা পর্তুগালের গণতান্ত্রিক সরকারকে স্থিতিশীলতা দিতে পারেনি, নিশ্চিত করতে পারেনি অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ১৯২৬ সালে পর্তুগালের শাসন ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী, চালু করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা, পরিচিতি পায় দ্বিতীয় রিপাবলিক নামে। একদলীয় শাসনের সময়ে নির্বাচনে ক্রমাগত কারচুপি করেছে ক্ষমতাসীন দল, রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে রাষ্ট্রকে কর্তৃত্ববাদী করে তুলেছিল শাসকশ্রেণি, সাথে ছিল অর্থনৈতিক শোষণ আর কতিপয়তন্ত্র।
এপ্রিল, ১৯৭৪। সামরিক বাহিনীর তরুণ কিছু অফিসার বিদ্রোহ করে পর্তুগালের তৎকালীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। অর্ধশতাব্দী জুড়ে একদলীয় শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় পর্তুগালের সাধারণ নাগরিকেরাও জড়িয়ে পড়ে সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যের এ বিদ্রোহে, ক্ষমতাচ্যুত হয় তৎকালীন সরকার, শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যায় পর্তুগাল। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে পর্তুগালের রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটে, গণতন্ত্রের দিকে রাজনৈতিক বিবর্তন শুরু হয় পর্তুগালের, স্বাধীনতা পায় আফ্রিকাতে পর্তুগালের অধীনে থাকা উপনিবেশগুলো।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই বারবার সামরিক শাসনের অধীনে গেছে পাকিস্তান, ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় ইচ্ছামতো অস্বস্তিতে ফেলেছে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকেও। সত্তরের দশকের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসেন জেনারেল জিয়াউল হক, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন প্রায় এক যুগ। ১৯৮৮ সালে এক রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন জেনারেল জিয়াউল হক, তার সাথে থাকা উর্ধ্বতন সামরিক বাহিনীর অফিসাররা ছাড়াও নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। জেলারেল জিয়াউল হকের মৃত্যু পার্লামেন্টরি গণতন্ত্রের পথ খুলে দেয় পাকিস্তানে। এপ্রিলের সামরিক বাহিনী অর্ডিন্যান্সে বিস্ফোরণ, মে মাসে গিলগিট-বেলুচিস্তানের জাতিগত সংঘাতের রেশ কাটিয়ে ১৯৮৮ সালেই পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনে জিতে মুসলিম বিশ্বের প্রথম নারী হিসেবে দায়িত্ব নেন বেনজির ভুট্টো, ৫৬টি আসন জিতে নেওয়াজ শরীফ হন বিরোধী দলীয় নেতা।
স্বৈরশাসকের মৃত্যু আর্শীবাদ হয়ে আসে ইউরোপের দেশ স্পেনের জন্যও। ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের মতো শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের জোয়ারে ১৯৩১ সালে বিলুপ্ত হয় স্পেনের রাজতন্ত্র, চালু হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। সমাজের রক্ষণশীল অংশের মতো এ পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনি সামরিক বাহিনীর একটি অংশ, খুশি ছিল না নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে থেকে কাজ করতে। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় স্পেনকে, ১৯৩৯ সালে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো।
জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয় রাজনৈতিক অধিকারকর্মীরা, গুম আর হত্যার মতো ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় বার্সেলোনার স্বাধীনতাকামীদের। ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় স্পেনে, ১৯৭৭ সালে হয় সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচিত সংসদ এক বছরের মধ্যেই তৈরি করে সংবিধান। এরপরও সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছে স্পেন, তবে ব্যর্থ হয়েছে ক্ষমতা দখল করতে, বাধাগ্রস্ত হয়নি স্পেনের গণতান্ত্রিক যাত্রা।
আশির দশকে আধুনিক গণতন্ত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। সুদূর অতীত থেকেই খেলাকে স্বৈরশাসকেরা বারবার ব্যবহার করেছে জনগণের মনোযোগকে প্রভাবিত করতে, খেলার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে শাসনকে দীর্ঘায়িত করেছে আধুনিক যুগের অনেক শাসকও। দক্ষিণ কোরিয়াতে ঘটে এর উল্টো ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মোটাদাগে সামরিক শাসনে অধীনে থাকা দক্ষিণ কোরিয়াতে গণতন্ত্রের পথযাত্রা শুরুর উপলক্ষ হয়ে আসে ১৯৮৮ সালের রিও অলিম্পিক। খেলার সময়টাতে আন্তর্জাতিক মনোযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে যান গণতন্ত্র প্রত্যাশীরা, প্রভাবিত করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতমোড়লদেরকেও। দ্রুতই সফল হন দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্র প্রত্যাশীরা, সামরিক শাসনের অবসান হয়ে শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র।
একই সময়ে বাংলাদেশেও আসে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই সামরিক শাসনের অধীনে চলে যাওয়া বাংলাদেশে জেনারেল এইচএম এরশাদের পতন হয় রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত আন্দোলনে, প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থা। এ সময়টাতে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন আসে তুরস্কের সাবেক উপনিবেশ গ্রিসে, শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন আসে পর্তুগাল, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের মতো লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও। সময়ের পরিক্রমায় আধুনিক গণতন্ত্রের দশম ঢেউয়ের প্রভাব পড়ে ৫০টিরও বেশি দেশে।
গণতন্ত্রায়নের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
সত্তরের দশকে পর্তুগালে শুরু হওয়া সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, একে একে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন আসে ৫০টিরও বেশি দেশে। আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন এ সময়কে ব্যাখ্যা করেছিলেন গণতন্ত্রের তৃতীয় ঢেউ হিসেবে। অনেকগুলো প্রভাবক এ রাজনৈতিক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে, ত্বরান্বিত করেছে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন।
প্রথমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাতে বদলে যায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল্যবোধ, বদলে যায় আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোও। শাসনব্যবস্থা বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্র এই সময়টাতে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে, সংস্কারপন্থীরা চেষ্টা করতে থাকেন শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন এনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে। ফলে, বিশ্বব্যাপী সামরিক শাসন একটি অজনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়, গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে সামরিক শাসকদের। জনমতের পরিবর্তন ভূমিকা রাখে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনে।
দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ায় ইউরোপের অর্থনীতি, অর্থনৈতিকভাবে ভালো অগ্রগতি অর্জন করতে থাকে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের গণতান্ত্রিক দেশগুলোও। এ পরিবর্তন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাথে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা ন্যারেটিভ তৈরি করে, বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পায় গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা। একই সময়ে কমিউনিস্টদের শাসনে থাকা দেশগুলোর অর্থনৈতিক দুরবস্থা শক্তিশালী করে এই ন্যারেটিভকে, একইরকম সূচক দেখা যায় সামরিক শাসনের অধীনে থাকা দেশগুলোতে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সামরিক বাহিনী যেহেতু মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক চাহিদাগুলোর সামনে রেখে ক্ষমতা দখলের প্লট খুঁজত, এই অর্থনৈতিক সূচকগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আবির্ভূত হয় শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনে।
তৃতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে চলে গণতন্ত্র আর কমিউনিজমের আদর্শিক লড়াই। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো পৃথিবীব্যাপী ওকালতি করতে থাকে গণতন্ত্রের, সোভিয়েত ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেয় কমিউনিস্ট দেশগুলোকে। গণতন্ত্রের পক্ষে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা প্রভাবিত করে শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনকে, প্রভাবিত করে রাষ্ট্রকাঠামো হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধমত দমনের ঘটনাগুলোও।
চতুর্থত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ভূমিকা রাখে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনে, তাদের চেষ্টায় বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তা পায় রাজনৈতিক অধিকার আর ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাগুলো। এ জনমত পরবর্তীকালে নিজেদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় সামরিক শাসনের প্রতি, ধাবিত হয় গণতান্ত্রিক শাসনের দিকে।
গণতন্ত্রের বিস্তারে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
সভ্যতার শুরু থেকে মানবজাতি শাসনব্যবস্থা নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গেছে মানবজাতি, শাসনের প্রয়োজনে তৈরি করে আমলাতন্ত্র, নিরাপত্তার জন্য তৈরি করেছে সামরিক বাহিনী। একটা দীর্ঘ সময় সামরিক বাহিনীই রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, বেসামরিক আমলাতন্ত্র সঙ্গী হয়েছে এ শাসনে। আটলান্টিক রেভ্যলুশনের পরবর্তী সময়ে শাসনব্যবস্থা ক্রমাগত রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে আসা শুরু হয়, সামরিক বাহিনীকে আনার প্রচেষ্টা হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে।
বিভিন্ন সময়ে শাসনতান্ত্রিক এ পরিবর্তন নিয়ে সংস্কারপন্থীদের সাথে সামরিক বাহিনীর বিরোধ হয়েছে, যার একটা অংশ ১৯৭৪ সাল থেকে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনগুলো। এই পরিবর্তনগুলো পরবর্তীকালে দীর্ঘমেয়াদে ভূমিকা রাখে একক শাসনতন্ত্র হিসেবে গণতন্ত্রের আবির্ভাবে।
প্রথমত, এই সময়টাতে দ্বিগুণ হয় গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক দেশ ছিল মাত্র ১২টি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে মাত্র ১৫ বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়, নতুন করে প্রায় দু’ ডজন দেশ শাসনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে।
দ্বিতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়টা পরিচিত পায় স্নায়ুযুদ্ধের সময়কাল হিসেবে, গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র আর কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। অর্ধশতাব্দী জুড়ে দুই পক্ষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একে অপরের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধে আবির্ভূত হয়েছে, চলেছে নিজেদের পক্ষে দেশের সংখ্যা বাড়িয়ে শক্তি সাম্যকে প্রভাবিত করতে। ১৫ বছরের টাইমফ্রেমে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া ভূমিকা রাখে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি টানতে, স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একক মতাদর্শ হিসেবে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে।
তৃতীয়ত, মানুষ রাজনৈতিক জীব। মানুষের যেকোনো কাজের পেছনে ভূমিকা থাকে আদর্শগত স্বার্থের, ভূমিকা থাকে অর্থনৈতিক স্বার্থেরও। আধুনিক গণতন্ত্রের দশম ঢেউয়ে প্রভাবিত হয়ে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন আনা গ্রিস, পর্তুগালের মতো অনেক দেশ পরবর্তী সময়ে সদস্য হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের। এটি সার্বিকভাবে ভূমিকা রাখে দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিকাশে, বৃদ্ধি পায় ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য।
চতুর্থত, এ সময়সীমার মধ্যে পৃথিবীর বড় একটা অংশের মানুষ নিশ্চয়তা পায় তাদের রাজনৈতিক অধিকারের, সুযোগ পায় রাজনৈতিক অধিকার চর্চার। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শুরু হয়, গড়ে উঠতে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। উক্ত দেশগুলোর মানুষ অংশ হয় বিশ্বায়নের, যুক্ত হয় বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের সাথে।
আধুনিক গণতন্ত্র ক্রমাগত আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গেছে, গেছে সংস্কারপন্থী মানুষদের আপোষহীনতার সঙ্গী হয়ে। আধুনিক গণতন্ত্রের দশম ঢেউয়ে প্রভাবিত হয়ে যেসব দেশে গণতন্ত্র এসেছিল, সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর জনগণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অভাবে অনেকগুলো দেশই চলে গেছে হাইব্রিড রেজিমে। আধুনিক গণতন্ত্র এ পর্বের পরেও আরো অনেক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে গেছে, স্নায়ুযুদ্ধে জিতে বদলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাঠামো। সে আলোচনা থাকবে পরবর্তী পর্বগুলোতে।